রোববার সকাল সাড়ে এগারটা। আকাশে মেঘ। বইছে বাতাস। সাথে কড়া রঙের রোদ। বৃষ্টি নামছি নামছি করেও নামছে না। তবে রোদ কড়া হলেও কেমন যেন নিরুত্তাপ। সব মিলিয়ে প্রকৃতি মেতেছে অদ্ভুত এক খেয়ালে। নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মাকে বিদায় জানাতে প্রকৃতিও যেন ব্যথাতুর।সিদ্ধান্তহীন।
শুক্রবার ভোর চারটার দিকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ৮৮ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন লেখক, নিসর্গবিদ ও প্রকৃতিমানব দ্বিজেন শর্মা। তার প্রতি সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সকালে মরদেহ অানা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। লেখকের বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষীদের ভিড়ে শোকে ভারাক্রান্ত শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ।
এক সময় ফুলে ফুলে ভরে যায় দ্বিজেন শর্মার কফিন রাখা ছোট মঞ্চটি। ব্যক্তি ও বিভিন্ন সংগঠন প্রিয় মানুষকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। শেষবারের মতো একপলক দেখেন প্রকৃতিমানবের মুখ। পাশেই ছানায়ট ও জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের শিল্পীরা গাইছেন, আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে…।’
দ্বিজেন শর্মার মরদেহে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান ইমপ্রেস টেলিফিল্ম ও চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর। ছড়াকার ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আমিরুল ইসলাম। শিক্ষাবিদ মফিদুল হক, সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, গোলাম কুদ্দুস, রাজনীতিবিদ জোনায়েদ সাকি, শিশু সাহিত্যিক ও উপস্থাপক আলী ইমাম, প্রাবন্ধিক ড. হায়াত মাহমুদ, জীবন ও প্রকৃতি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু প্রমুখ।
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, নজরুল ইনিস্টিটিউট, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন, গণ সংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব, বাংলাদেশ ঘুড়ি ফেডারেশন, স্থাপত্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ রাশিয়া মৈত্রৗ সমিতি, শিল্পকলা একাডেমিসহ প্রকৃতি, পরিবেশ, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
দ্বিজেন শর্মাকে স্মরণ করতে গিয়ে মুকিত মজুমদার বাবু বলেন, ‘দ্বিজেন শর্মা প্রকৃতি ও পরিবেশকে ভালোবেসে তার জীবন উৎসর্গ করেছেন। তিনি বটবৃক্ষের মতো আমাদের ছায়া দিয়েছেন। তার দেখানো পথ ধরে এগিয়ে গেলে বাংলাদেশ ভালো থাকবে, তার আত্মা ভালো থাকবে।’
মফিদুল হক বলেন, ‘দ্বিজেন শর্মা বৃক্ষলতা ও তরুপল্লবকে মানব জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলেছিলেন। মানব জীবন ও প্রকৃতি কিভাবে একে অপরের পরিপূরক সেটা দেখিয়েছেন।’
দ্বিজেন শর্মার ছেলে সুমিত্র শর্মা বলেন, ‘আমি দেশে-বিদেশে যেখানেই গিয়েছি সবাই বাবার কথা জিজ্ঞেস করেছেন। বাবাকে কেউ ভুলতো না। বাবা শুধু যে প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন না কিন্তু না। প্রকৃতিও বাবাকে ভালোবাসতেন। আজ বৃষ্টি হওয়ার কথা থাকলেও চমৎকার পরিবেশই তার প্রমাণ।’
গোলাম কুদ্দুস বলেন, ‘তিনি আমাদের একটি একটি করে গাছ চিনিয়েছেন। তরুলতা চিনিয়েছেন। নগর জীবনে বেড়ে ওঠা প্রজন্মকে প্রকৃতি চিনিয়েছেন।’
দুপুর পৌনে বারটায় তাকে নটরডেম কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর সেখান থেকে সবুজবাগের কালীবাড়ি শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে দাহ করার পর তার চিতাভষ্ম সিলেটের বড়লেখার শিমুলিয়ায় গ্রামের বাড়িতে সমাহিত করা হবে বলে জানিয়েছেন দ্বিজেন শর্মার ছেলে সুমিত্র শর্মা।
দ্বিজেন শর্মা ১৯২৯ সালের ২৯ মে সিলেটের বড়লেখা থানার শিমুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ভিষক চন্দ্রকাণ্ড শর্মা এবং মাতার নাম মগ্নময়ী দেবী। বাবা ভিষক বা গ্রাম্যভাষায় কবিরাজ ছিলেন, আর মা ছিলেন সমাজসেবী। শৈশবে পাথারিয়া পাহাড়ের জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছেন। সেখান থেকেই হয়তো গাছপালার প্রতি তার অসীম ভালোবাসা জন্মে। “কবিরাজ বাড়ি” বলে বাড়ির বাগানেই অজস্র গাছগাছালি ছিল, তার মাঝে ছিল স্বর্ণচাঁপা, কনকচাঁপা, মধুমালতীসহ নানা রঙবেরঙের ফুল।
বসন্ত শেষের বৃষ্টির পর সারা বাড়ি যখন ফুলে ফুলে ভরে উঠতো, দ্বিজেন শর্মা তখন সকালে পূজার ফুল তুলতেন। সেসময়ই মনের অজান্তে দ্বিজেন শর্মাও প্রকৃতির প্রেমে পড়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা করে যোগ দেন শিক্ষকতা পেশায়।
দীর্ঘদিন অনুবাদক হিসেবে কাজ করেছেন রাশিয়ার মস্কোয়।শ্যামলী নিসর্গ, ফুলগুলি যেন কথা, গাছের কথা ফুলের কথা,জীবনের শেষ নেই, গহন কোনো বনের ধারে, বাংলার বৃক্ষসহ প্রায় ১৭টি বই লিখেছেন।
ছবি: মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ