পাকিস্তানীরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে আটক রেখে তাঁকে সেখানকার মাটিতেই হত্যা করতে চেয়েছিল, কিন্তু পারে নি। পারে নি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জোরদার হয়ে ওঠার কারণে, পারে নি পাকিস্তানী সেনারা আত্মসমর্পন করে বাংলাদেশের বিজয় অন্তত: তখনকার মত মেনে নিতে বাধ্য হওয়ায়-আর পারে নি আন্তর্জাতিক জনমতের চাপে।
১০ জানুয়ারি, ১৯৭১ বীরের বেশে শেখ মুজিব ফিরে এলন তাঁর প্রিয় এবং স্বপ্নেরর দেশ বাংলাদেশের মাটিতে। তাঁর বিশাল গণসংবর্ধনা ঢাকা বিমানবন্দরে এবং নিকটবর্তী সকল এলাকায় জনসমুদ্র স্বত:স্ফূর্ত শ্রদ্ধা আর ভালবাসা জানিয়ে আর এক ইতিহাস রচনা করেছিলেন সেদিন। বঙ্গবন্ধুর সফল স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং একের পর এক বিভিন্ন দেশ কর্তৃক বাংলাদেশের স্বীকৃতি জানানো এবং দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে ওই দেশগুলির সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ায় জাতির মনে নতুন করে আস্থার সৃষ্টি করেছিল এই মর্মে যে বাংলাদেশ গৌরবের সাথেই তার আদর্শ নিয়ে টিকে থাকবে আর বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বপ্নের দেশটিকে স্বহস্তে সোনার বাংলায় পরিণতও করবেন-তাঁর ঘোষিত আদর্শগুলিকেও নিজেই বাস্তবায়িত কর দেশটাকে প্রকৃতই গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করে তাঁর নিজের এবং বাঙালি জাতির স্বপ্ন বাস্তবায়িত করবেন। কিন্তু জাতির সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে দেওয়া হয় নি। পঁচাত্তরের ১৫ আগষ্টের কালরাতে পরিচিত ঘাতকেরা সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার মাধ্যমে।
জাতি সে দিন কেঁদেছিল। বহু লোকে রোজা পালন করেছিলেন, তাঁদের প্রিয় নেতাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যে। কিন্তু স্রষ্টা সে প্রার্থনা শুনেন নি-তিনি সশরীরে আর ফিরে আসেন নি-আসবেনও না।
কিন্তু অগণিত দেশবাসী রয়ে গেলেন শোকার্ত চিত্তে অশ্রু ভারাক্রান্ত। রয়ে গেল তাঁর ও মওলানা ভাষানীর হাতে গড়া দল, রয়ে গেলেন বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী ও বাম প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ।
তবে শুধু এঁরাই থাকেন নি। রয়ে গেল হত্যাকারীরাও দেশ ও বিদেশে। হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল তাদেরই মিলিত ষড়যন্ত্রে যার দেশীয় হোতা ছিলেন আওয়ামী লীগেরই অপর শীর্ষ নেতা খোন্দকার মোশতাক ও তাঁর সঙ্গী ষড়যন্ত্রকারীরাও।
এই ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করেই থেমে থাকে নি তারা তাঁর আবদ্ধ কাজগুলিকে বদলে দিতে সুরু করেন। প্রথমেই ঘোষণা দেন বাংলাদেশকে “ইসলামী রাষ্ট্র” হিসেবে গড়ে তোলা হবে এবং সেই লক্ষ্যে তাঁরা বহুদূর পর্য্যন্ত অগ্রসরও হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার সবচেয়ে বড় বেনিফিশিয়ারী হলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। মুশতাকের হাত থেকে কৌশলে জাসদের সহায়তায় ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রভূমি বানালেন ক্যান্টনমেন্টকে। সেখান থেকে ফরমান দিলেন সংবিধান শুরু হবে “বিসমিল্লাহির রাহমানুর রহিম” দিয়ে। বৈধ করে দিলেন ধর্মাশ্রয়ী স্বাধীনতা-বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম প্রমুখকে, ভিসা দিলেন জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমীর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী পাকিস্তানী নাগরিক এবং পাকিস্তানী পাসপোর্টধারী গোলাম আযমকে। শুরু হলো রাষ্ট্রের ও রাজনীতির ইসলামীকরণ বা পাকিস্তানীকরণ প্রক্রিয়া।
অত:পর এলেন অপর একজন সামরিক শাসক জেনারেল হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ। তিনি এসে তাঁর ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে জিয়া মোশতাকের শুরু করা ইসলামীকরণ পাকিস্তানীকরণ প্রক্রিয়া আরও গতিবেগ সঞ্চারিত করেন। যার পরিণতিতে সংবিধানে সংযোজন করা হয়, “বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম”, এই রাষ্ট্র ধর্মের ধারণাটি অভিনব। পৃথিবীতে বহু সংখ্যক মুসলিম প্রধান দেশ আছে। কোন দেশের সংবিধানেই “রাষ্ট্রধর্ম” বলে ইসলাম বা কোন ধর্মকে ঘোষণা করা হয় নি। হিন্দু অধ্যুষিত দুটি দেশ-ভারত ও নেপাল-এই দেশ দুটিরও কোন রাষ্ট্রধর্ম নেই। নেপালে সাবেক শাসনামলে ঐ দেশের “রাষ্ট্রধর্ম হিন্দু” বলে সংবিধানে উল্লেখ ছিল কিন্তু বছর দশেক আগে আনা এক সংশোধনী বলে ওটা তুলে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। দূরপ্রাচ্যের দেশ চীন-জাপান প্রভৃতি রাষ্ট্রে বৌদ্ধরা বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু তারাও বৌদ্ধ বা অন্য কোন ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম বলে ঘোষণা করে নি। পৃথিবীতে সর্বাধিক সংখ্যক দেশে খৃষ্টানরা বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু তাদের কোন দেশই কোন ধর্মকে রাষ্ট্রওধর্ম হিসেবে ঘোষণা করে নি।
দুই সামরিক শাসক শ্রেফ তাঁদের অবৈধ ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার লক্ষ্যে মানুষকে ধর্শের নামে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে ওইভাবে সংবিধান সংশোধন করেন সামরিক আইন বলে।
এই বিধানগুলিকে অর্থাৎ দুই সামরিক শাসকের আনীত পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনীকে বে-আইনী ঘোষণা করে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল। রায়ে দুই সামরিক শাসকের ক্ষমতা দখল এবং সামরিক আইনবলে পাশ করা ওই সংশোধনীগুলিকে অবৈধ ঘোষণা করে ঐ শাসকদেরকে প্রচলিত আইনে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মামলা দায়ের করা উচিত বলেও অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। সে নির্দেশ কাগজে কলমেই রায়ে গেল-কার্যকর হলো না আজতক। অপরদিকে পঞ্চদশ সংশোধনীর মারফত জিয়ার বিসমিল্লাহ্ ও এরশাদের রাষ্ট্রদর্শকে সংবিধানের অন্তর্ভূক্ত করে ওগুলিকে স্থায়ী রূপ দেওয়া হয় এবং তা আজও অব্যাহত আছে।
সুক্ষ্মভাবে বিবেচনা করলে “রাষ্ট্রধর্ম” এবং “ধর্মনিরপেক্ষতা” পরস্পর সাংঘর্ষিক এবং বাহাত্তরের মূল সংবিদানের সাথে পূরোপূরি সাংঘর্ষিক। জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, হেফাজতে ইসলাম বা ধর্মাশ্রয়ী যে সকল দলের অস্তত্ব পাকিস্তান আমলে ছিল, বাহাত্তরের সংবিদান বলে সেগুলি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল-কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর কল্যাণে আজ ওই দলগুলিও বৈধ।
পরিণতিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বা বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে সৃষ্ট দলটি আজ আদর্শচ্যুত এবং বাকশাল গঠনকালে এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু নিজেই ভবিষ্যৎ বানী করে বলেছিলেন:
“আওয়ামী লীগ একটি মাল্টিক্লাস পার্টি। আমি তার আগে কৃষক শ্রমিক লাগিয়েছি বৈকি, কিন্তু দলটির চরিত্র এখনও বদলাতে পারি নি-রাতারাতি তা সম্ভবও নয়। আমার দলে নব্য ধনীরাও আছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় তাদের লুটপাটের মাত্রা বেড়ে গেছে।
আমি তাদের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্যেই বাকশাল করেছি। যদি এই ব্যবস্থা সফল করতে ব্যর্থ হই এবং আমার মৃত্যু ঘটে, তা হলে দলকে কব্জা করে ওরা আরও লুটপাটে উন্মত্ত হয়ে উঠতে পারে। এমন কি স্বাধীন বাংলাদেশের মূলমন্ত্রে শত্রু পক্ষের নীতিও চরিত্র অনুসরণ করে আওয়ামী লীগেরও নীতি ও চরিত্র পাল্টে ফেলতে পারে।
যদি তা হয়, সেটাই হবে আমার দ্বিতীয় মৃত্যু। সেজন্যে আগেই বলেছি, আমার দল, আমার অনুসারীদের হাতেই যদি আমার দ্বিতীয় মৃত্যু ঘটে, তা হলে দীর্ঘ কালের জন্য বিস্মৃতির অন্ধকারে চলে যেতে হবে। কবে ফিরব তা জানি না।”
শেষ কথাটি হলো, “কবে ফিরব তা জানি না”। তিনি বাংলার মাটিতে পুনরায় ফিরে আসতে আগ্রহ প্রকাশ করে সেটা কবে সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন-তবে যা যা ভবিষ্যত বানী করেছেন তা পূরোপূরি সত্র বলে প্রমাণিত হয়েছে। তাঁর ভাষায় তার “দ্বিতীয় মৃত্যু” ঘটেছে।
তাই বাংলাদেশ আজ নীতি আদর্শের ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বহু পেছনে চলে গেছে। প্রভূত শক্তি অর্জন করে ফেলেছে হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ধর্মান্ধ শক্তি। এই শক্তিগুলি বাহাত্তরের মূল সংবিধানের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি তো দূরের কথা তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায়ই বিশ্বাস করে না। তাই তারা সরকারের বন্ধু সেজে হয়তো আর একটা ১৫ আগষ্ট ঘটানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আর এই ষড়যন্ত্র যদি সফল হয়-তবে দেশ আরও ১০০ বছর পিছিয়ে যাওয়ার আশংকা।
বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনে প্রদত্ত ভাষণগুলির দিকে নজর দিলেই স্পষ্ট বুঝা যায় তাঁর জীবনের লক্ষ্য কি ছিল। বাঙালি জাতির প্রতি সীমাহীন ভালবাসা, সকল নির্য্যাতন, অত্যাচার ও অসাম্যের হাত বাঙালি জাতিকে মুক্ত করা, গণতন্ত্রের প্রতি এবং অসাম্প্রদায়িক ধর্মানিরপেক্ষতার নীতি প্রতি অবিচল আস্থা এবং একটি ঘোষণামুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রতি দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে তিনি তাঁর ৫৫ বছরের জীবনকাল অতিক্রম করেছেন। ‘আপোষ’ শব্দটিকে সর্বাধিক ঘৃণা করে চলেছেন আজীবন। যদি আপোষ করতেন, ছয় দফা পরিত্যাগ করতে সম্মত হতেন-তা হলে বঙ্গবন্ধু হতে পারতেন সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ছয় দফাকে, বাঙালি জাতির স্বার্থকে তাঁর জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করতে পেরেছিলেন বলেই বাঙালি জাতি একাত্তরে নয় মাসব্যাপী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক ও ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটাতে পেরেছিলেন।
সেই বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ, লড়াকু বাঙালি জাতির বাংলাদেশকে অবহেলায় বা কোন বিভ্রান্তির বশবতী হয়ে আমরা হারাতে পারি না। যদি তা হারাই তবে দেশের মানুষের কাছে ফিরে আসতে ইচ্ছুক বঙ্গবন্ধুকে ফেরাতে পারব না। অথচ তাঁকে ফেরাতেই হবে-এটাই বাঙালির জন আকাংখা।
কিন্তু কিভাবে?
এক.বঙ্গবন্ধুর আরব্ধ সকল কাজ তাঁর চিন্তাধারা অনুযায়ী সম্পন্ন করা;
দুই. পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে ধীরে ধীরে বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পের জাতীয়করণ করে তা শতভাগ উৎপাদন ও সততার সাথে পরিচালনার নীতি গ্রহন;
তিন. বাহাত্তরের মূল সংবিধানের, বিশেষ করে তার চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির পুনরুজ্জীবন। এ কাজের জন্য নভেম্বরের ৪ তারিখে সংসদ অধিবেশন ডেকে প্রয়োজনীয় সংশোধনী অনুমোদন;
চার . সকল সাম্প্রদায়িক দল ও সংগঠনকে অবিলম্বে বে-আইনী ঘোষণা এবং ২০০১ থেকে ২০ বছর যাবত সংঘটিত সকল সাম্প্রদায়িক সংহিস ঘটনায় মোকর্দমা দায়ের ও অপরাধীদের কঠোর শাস্তি প্রদান;
পাঁচ. করোনাকালে চরম সংকটে পড়া শ্রমিক, কৃষক ও নি¤œমদ্যবিত্তের জন্য উপযুক্ত প্রণোদনার ব্যবস্থা গ্রহণ ও
ছয়. দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান অবিলম্বে শুরু করা।
এই কাজগুলির মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধুকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব এর আর কোন বিকল্প নেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)