চলতি বছরে ইরানে একটি সিনেমা মুক্তি পায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই ছবির প্রচারণার জন্য শহরের বিভিন্ন জায়গায় টাঙানো হয় সিনেমার পোস্টার। সিনেমার নায়ক কে, নির্মাতা কে কিংবা সিনেমায় নায়িকা আছে কি নেই, এসব না দেখেও শুধুমাত্র পোস্টারটি দেখেই নাকি সিনেমা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে শত শত মানুষ। পাবলিকের এই স্রোত ঠেকাতে নাকি হিমশিম খেয়েছিল সিনেমা হলটির নিরাপত্তা কর্মীরাও। এ পর্যন্ত পড়ে কি ভাবছেন? নিশ্চয় ভাবছেন, সিনেমার পোস্টারটিতে এমন কিছু ছিল যা দেখে মানুষ সিনেমাটি দেখতে আসে? নান্দনিকতায় ঠাসা ছিল পোস্টারটি? জীবনের কোনো গূঢ়অর্থ ছিল পোস্টারে? তবে জেনে রাখুন, পোস্টারটি নান্দনিকতার জন্য নয়, কারণ সিনেমার নাম ছিল ‘কর্মী চাই’!
ইরানের সিনেমার পোস্টারটিকে রিয়েল লাইফ জোকস হিসেবে নিতে পারেন। কিন্তু বাস্তবিক অর্থেই সিনেমা হলে দর্শক টানতে একটা সময় পোস্টারের ছিল এমন জোর। কথায় আছে, ‘আগে দর্শনধারী, তারপর গুণ বিচারী’!
সিনেমা হিট করতে পোস্টার খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা না রাখলেও, একটা সিনেমা সম্পর্কে প্রথমেই কিছুটা ভাবতে সুযোগ করে দেয় পোস্টার। প্রথম দর্শনে সিনেমার পোস্টার যদি কারো মনে ধরে তাহলে সিনেমাটি দেখতে হয়তো ইন্ধন যোগাতে পারে সেই ভালোলাগাটুকু। এইতো ক’দিন আগে এক পরিচিত দর্শক বললেন, তিনি কখনোই ডুব ছবিটি দেখতে যেতেন না। কিন্তু একটা মানুষের ভেতর দিয়ে পাহাড় চলে যাওয়ার দৃশ্যসম্বলিত পোস্টারটি দেখে এক ধরনের অর্থ তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন, ছবির ভেতরের গল্প জানতে তিনি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। যার ফলেই ছবিটি শেষ পর্যন্ত দেখতে হলে গিয়েছেন!
বর্তমানে সিনেমার প্রচারণায় নানা অনুষঙ্গ যোগ হলেও এক সময় প্রচারণায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতো সিনেমার পোস্টার। এমনকি পত্রিকায় সিনেমার পোস্টার দিয়েই বিজ্ঞাপন পর্যন্ত দেয়া হত। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় হয়তো মোশন পোস্টার, টিজার, ট্রেলারের প্রচলন শুরু হয়েছে, কিন্তু পোস্টারের যে চিরায়ত আবেদন তা অস্বীকার করছেন না এই সময়ের নির্মাতারাও। তাদের মতে, প্রযুক্তি যতো উৎকর্ষতাই দিক সিনেমা হলে যেতে প্রচারণার জন্য পোস্টারের কোনো বিকল্প নেই। যুগের সাথে হয়তো পোস্টারে নান্দনিকতা কিংবা কনসেপ্টে পরিবর্তন আসবে, কিন্তু পোস্টার বিলীন হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নিকট অতীতে দেখছেন না তারা।
পোস্টারের চেঞ্জকে ইতিবাচক মন্তব্য করে ‘ভয়ংকর সুন্দর’ নির্মাতা অনিমেষ আইচ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, সময়ের সাথে সাথে সবকিছুরই চেঞ্জ হচ্ছে, সামনেও হবে। বিশ্বায়নের যুগে মানুষের রুচির কিন্তু একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে। বিশ্ব সিনেমার সাথে মানুষের প্রতিনিয়ত যোগাযোগ স্থাপন হচ্ছে। মানুষের আপগ্রেডেশন খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। ওয়ার্ল্ড ক্লাস রুচি তৈরি হচ্ছে। ফলে সিনেমার কন্টেন্টেও যেমন পরিবর্তন হচ্ছে, পোস্টারেও সেই ছোঁয়া লাগছে। এটাকে খুবই ইতিবাচক ভাবে দেখি।
‘ভয়ংকর সুন্দর’-এর পোস্টার ডিজাইন কে করেছেন জানতে চাইলে নির্মাতা বলেন, চারুকলার বড় ভাই আনিসুজ্জামান সোহেল ‘ভয়ংকর সুন্দর’-এর ডিজাইন করে দিয়েছেন। উনি বিখ্যাত ডিজাইনার। আর্ট ডিরেক্টর। মিডিয়া.কম-এ কাজ করছেন।
প্রথম বাংলা সিনেমা মুখ ও মুখোশ থেকে শুরু করে সত্তর, আশি ও নব্বই দশক পর্যন্ত পোস্টারের স্বকীয় একটা ভাষা ছিল। পোস্টার দেখেই সিনেমা সম্পর্কে অন্তর্নিহিত ভাবটাও কল্পনা করা যেত। বিশেষ করে বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণের শুরুর দিকের পোস্টারগুলো ছিল বেশ নান্দনিক, এবং অর্থবহ। সিনেমার পোস্টার, লেখার স্টাইল সব মিলিয়ে শিল্প মান সম্পন্ন একটা বিষয় ছিল। তার কিছুটা এখনো রিক্সা পেইন্টে অবশিষ্ট আছে। কিন্তু নব্বই দশকের পরে চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা ঢুকে গেলে পোস্টারেও লাগে সেই ছোঁয়া। বিশেষ করে এফডিসি নির্ভর সিনেমাগুলোর পোস্টার বাংলা সিনেমার পোস্টার হিসেবে সেই ঐতিহ্য ও শিল্প মান হারায়।
আমাদের সিনেমায় পোস্টারে নান্দনিক চর্চার উপস্থাপন নিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেন ‘ভুবন মাঝি’ নির্মাতা ফাখরুল আরেফিন। পোস্টার নিয়ে বলে, পোস্টারে নান্দনিকতার এই চর্চাটা আমরা নতুন করে করছি না কিন্তু। এটা পঞ্চাশ বছর ধরেই হচ্ছে। আগে যারা সিনেমা বানিয়েছেন তাদের পোস্টারেও ইনারফুল মিনিং ছিল। এটা ওয়েস্টার্ন ফিলসফির থট। কিন্তু আমরা এখন এসে এটা চর্চা করছি, আর কিছু না। আর দুঃখজনক হলেও সত্য, যারা ব্যবসায়ীক সিনেমা করেন তারা নান্দনিকতাকে চোখ বুঝেই এড়িয়ে যান। নারীদেহ সর্বস্ব একটা পোস্টার বানানোর চর্চার মধ্য দিয়ে মানুষকে সিনেমা দেখতে আহ্বান করেন। আর আমরা তাদের মতো করে না বানিয়ে একটু সৌন্দর্য নিয়ে চিন্তা করি।
এক ফাঁকে ‘ভুবন মাঝি’র পোস্টার ডিজাইন করেছেন আশরাফুল ইসলাম তামিম, এ কথাও জানান ফাখরুল আরেফিন।
বইয়ের ভেতরকার লেখার প্রতিনিধিত্ব করে বইয়ের প্রচ্ছদ। তেমনি একটা সিনেমার প্রতিনিধিত্ব করে পোস্টার। চলতি বছরের আলোচিত চলচ্চিত্র ‘ডুব’-এর পোস্টার যেন সে কথায় আরও গভীরভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়। ‘বুকের ভেতর বয়ে চলে পাহাড় নামের নদী। আহারে জীবন, আহা জীবন।’-এমন কথা আর সিনেমার গল্পকেই যেন ধারণ করে পোস্টারটি।
ডুব, ভয়ংকর সুন্দর এবং ভুবন মাঝি ছাড়াও চলতি বছরে বেশকিছু নান্দনিক পোস্টারের দেখা মিলেছে। এরমধ্যে সত্তা, সুলতানা বিবিয়ানা, পরবাসিনী, রাইয়ান, ঢাকা অ্যাটাক এবং হালদার পোস্টারের কথা উল্লেখযোগ্য।