চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

পেশাগত বৈচিত্র্যের প্রেক্ষাপটে স্বাবলম্বী সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন

একটি স্বাবলম্বী সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন আমরা দেখি, যে সমাজব্যবস্থায় প্রত্যেক মানুষের কাজের মূল্যায়ন থাকবে এবং প্রত্যেকের কাজকেই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে রাষ্ট্র তথা সরকার। কাউকে কোনভাবেই হেয় প্রতিপন্ন করা যাবে না, কারণ প্রত্যেকেই সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বাস করে থাকেন। পেশাগত মর্যাদায় উঁচু-নিচু, ছোট-বড় ভেদাভেদ যতই কমিয়ে আনা যাবে সমাজের জন্য ততই তা সুখকর হবে।

সমাজ মূল্যায়ন করতে পারে তার কর্মদক্ষতাকে। যে যেই পেশাই থাকুক সে পেশা বা তার কর্মপরিধিকে কখনোই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই কিংবা একজন বিবেকসম্পন্ন মানুষ কখনোই তা করতে পারে না। তাহলে এই বিভেদটা কারা করে-তারাই করে যারা হীনমন্য, অন্যকে ছোট করার প্রয়াস খোঁজে। সমাজের এই কুপমুন্ডুক মানুষগুলিই অন্যকে খাটো কিংবা বিভেদ করার সুযোগ খোঁজে। একজন ধোপা কিংবা হরিজন ও সমাজের অংশ, তাই তার কাজকে কখনোই অবমূল্যায়নের সুযোগ নেই।

ধরুণ, আমি একটি প্রতিষ্ঠানের করণিকের কাজ করে থাকি। আমার ড্রাফট করা চিঠিই প্রতিষ্ঠান প্রধান স্বাক্ষর করে উপরের মহলে পাঠায়, আবার কখনো কখনো আমার লেখা চিঠি কিছুটা সংশোধন করে প্রতিষ্ঠান প্রধান প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে ব্যবহার করে থাকেন।সুতরাং এখানে আমার কাজটা কি ছোট হয়ে গেল। অনেকেই বলবেন, আপনি করণিক, আপনার কাজ তো ছোটই হবে। কিন্তু এই করণিকের করা কাজই প্রতিষ্ঠান প্রধান ব্যবহার করে থাকেন। আমি বলবো এখানে করণিকের কাজটি মোটেই ছোট নয়, কারণ করণিকের করা কাজ দিয়েই মূলত প্রতিষ্ঠানের অনেক কিছু পরিবর্তন হচ্ছে, নতুন নতুন বিষয়ের সংযোজন হচ্ছে। তাই করণিককে তার উপর অর্পিত কাজের মেধাশ্রম দিয়ে মূল্যায়ন করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে আপনার নিজের কাজটি যদি আপনি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে শেষ করতে পারেন তাইলেই আপনি আপনার কর্মক্ষেত্রে একজন সফল কর্মী।

সুতরাং মানুষের পছন্দসই কর্মক্ষেত্রে সে কিংবা তিনি যদি সফলকাম হতে পারেন তাহলেই তাকে মর্যাদাসই গুরুত্ব দিতে হবে। নচেৎ সমাজের শৃঙ্খল কাঠামো ভেঙ্গে যেতে পারে কিংবা থাকলেও সামঞ্জস্যতার অভাবে তা সমাজ কাঠামোর ইতিবাচক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে না। যেমন কারো ক্রিকেট খেলার প্রতি ঝোঁক আছে, তাকে যদি আমরা কিংবা পরিবার কোন কারণে ফুটবল খেলার সাথে এডজাস্ট করিয়ে দেই তথাপি সে কিন্তু সর্বোচ্চ ফলটা আনতে পারবে না। কারণ তার আকর্ষণ ক্রিকেটের প্রতি। তাকে যদি ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হতো তাহলে নেশা এবং পেশার কারণে সর্বোচ্চ ফলাফলটা পাওয়া যেতো।কাজেই পেশা নির্বাচন এবং চাপিয়ে দেওয়ার পূর্বে বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে ভাবনায় নেওয়া উচিত।

পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্রে পরিবার এবং সমাজব্যবস্থা একটি বাঁধা হিসেবে কাজ করে থাকে। সমাজব্যবস্থার কারণে অনেকেই ট্র্যাকচ্যুত হয়ে ভিন্নধারায় যেতে বাধ্য হয় বা হয়ে থাকেন। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও এর জন্য কম দায়ী নয়। প্রকৃতঅর্থে পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যক্তির পছন্দকে গুরুত্ব দিতে হয়, জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্য কোন ইতিবাচক ফলাফল আসতে পারে না আসেও না। যার কারণে আমরা এখন আর কোন রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলকে পাচ্ছি না, আমরা পাচ্ছি না কোন জগদীস চন্দ্র বসুকে।

সাংবাদিকতা পেশায় পাচ্ছি না তফাজ্জল হোসেন মানিকের মত প্রতিভাবান কাউকে। পাচ্ছি না নুরুল ইসলামের মতো পেশাজীবী ডাক্তারকে, মিলছে না সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো তরুণ কবির সন্ধান। এর পিছনে মূলত মূল কারণ ওই একটাই, ব্যক্তিক পছন্দ কিংবা ভালবাসা থেকে সেভাবে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা পেশাকে তেমনভাবে পছন্দ করে বেছে নিতে পারছে না। আর কেউ কেউ বেছে নিলেও সুবিধামতো পরিবেশ এবং সহযোগীতার অভাবে নিজের প্রতিভাটাকে মেলে ধরার যথেষ্ট পরিমাণ সুযোগ মিলছে না।

বাস্তব চিত্রের কথা তুলে ধরলে বিষয়টা অনুধাবনে আরো সহজতর হবে। বাংলায় চার বছর মেয়াদী অনার্স ও ১ বছর মেয়াদী মাস্টার্স পাশ করার পর ছেলেটি ব্যাংকে যোগদান করে আবার হিসাববিজ্ঞানে পাশ করা ছেলেটি মার্কেটিংয়ে যোগদান করে জীবনযাত্রা শুরু করে থাকে। বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই পারিবারিক দায়িত্ব পালনে সকলকেই এ ধারায় চলতে হচ্ছে। অথচ বাংলায় পাশ করা ছেলেটি ব্যাংকিংয়ে বিভিন্ন টার্ম আত্নস্থ করতেই বছরখানেক সময় লেগে যায় কিন্তু এখানে যদি হিসাববিজ্ঞানের ছেলেকে নিয়োগ দেওয়া হতো তাহলে কতটাই না ভালো হতো। তৎসাপেক্ষে বাংলার ছেলেটিকে যদি বাংলার সংস্কৃতি, ইতিহাস সংরক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হতো তাহলে শতভাগ না হলেও কাছাকাছি ফল পাওয়া যেত।

এখানে আমি শুধুমাত্র উদাহরণস্বরূপ একটি বিষয়ের আলোকে বিষয়টাকে তুলে আনার চেষ্টা করেছি। প্রত্যেক বিষয়ের ব্যবহারিক আবেদনের ক্ষেত্রে এমন চিত্রই লক্ষ্য করা যায় বাংলাদেশে। কিন্তু বাস্তবায়নের সাপেক্ষে পরিবর্তন অবশ্যাম্ভাবী হয়ে পড়েছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাই শিক্ষার্থীদের এমন অবস্থা বেছে নিতে বাধ্য করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ছেলেটি কিংবা মেয়েটি চিন্তা করে কিভাবে একটি চাকুরির ব্যবস্থা করা যায়। তাই কারিকুলামের পড়া তথা ব্যবহারিক গবেষণায় গুরুত্ব না দিয়ে চাকুরির পিছনে দৌড়াতে থাকে যার ফলে স্বাভাবিক চিন্তা ও ভাবনার ছেদ ঘটে থাকে। এ পদ্ধতির বিলুপ্তি ঘটানো উচিত কেননা একজন ছাত্র ৫-৭ বছর যে বিষয়ে পড়াশোনা করেছে চাকুরিক্ষেত্রে সে যেন সেই বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশে ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিষয়টি বর্তমান চ্যালেঞ্জিং বিশ্বে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ বিষয়টিতে সাধারণত পুলিশ, পুলিশিং, গবেষণা, অপরাধ তদন্ত, বিচারব্যবস্থা, শাস্তিদান ও কারা পরিচালনা বিদ্যা, আইনবিদ্যা, সন্ত্রাসবাদ, ফরেনসিক সায়েন্স, জুভেনাইল ডেলেনকোয়েন্সি, সংশোধন পদ্ধতি, সাইবার ক্রাইম, হোয়াইট কলার ক্রাইম, সিকিউরিটি, পুলিশ ম্যানেজমেন্ট সহ জেন্ডার ও সমসাময়িক ইস্যু নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে কলমে পাঠদান করানো হয়। এ বিভাগের শিক্ষার্থীদের যদি পুলিশ, তদন্ত, বিচারব্যবস্থা, গবেষণা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কোঠার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে দেশ ও দেশের মানুষ এ বিভাগের শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞানের মাধ্যমে সর্বোচ্চ সেবা পেতে পারবে।এ রকমভাবে বিষয়ভিত্তিক চাকুরির ব্যবস্থা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

সুতরাং উপযুক্ত আলোচনার মাধ্যমে স্পষ্ট করার চেষ্টা হয়েছে-পেশা বাছাইকরণ তথা বাছাইকরণের সুবিধা পাওয়া মানুষের জীবনে সফল হওয়ার একটি নির্দেশক হিসেবে কাজ করে থাকে। আবার নির্দিস্ট পছন্দের পেশায় আপনি যেরূপ সফলতা পাবেন ভিন্ন জায়গায় তার আনুপাতিক মাত্রার হার কিয়দংশ হলেও কম হবে। তাই সরকারের কাছে নিবেদন, বিষয়ভিত্তিক চাকুরির ব্যবস্থা করার সুযোগ সৃষ্টি করা এবং সে অনুযায়ী পলিসি প্রণয়ন ও চাকুরির সার্কুলার নিশ্চিতকরণ করতে হবে। এ রকম সময়পোযোগী উদ্যোগ গ্রহণের ফলে দেশ ও দেশের মানুষ লাভবান হবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)