কথায় আছে, যে রাধে সে চুলও বাধে! যার উদ্যম আছে, কিছু করার মানসিকতা আছে শত প্রতিবন্ধকতা স্বত্বেও সে তার চূড়ান্ত লক্ষ্যে এগিয়ে যাবেই। পৃথিবীর নানান পেশায় তাই বীরদর্পে বিচরণ করছেন নারী। নারীরা এখন শুধু আর ঘরকুনো হয়ে সংসারই সামলাচ্ছেন না। বরং বাইরের পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। নারী আজ আকাশে উড়ছে, যুদ্ধ করছে, জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়ছে গহীন সমুদ্রে। পেশাদারিত্বের সব জায়গাতেই নিজেদের সামর্থ জানান দিচ্ছেন তারা। শিল্প, সাহিত্য, কলা বিদ্যায়ও সিদ্ধহস্ত। সিনেমা নির্মাণেও রাখছেন নিজেদের স্বাক্ষর। ডিরেক্টর মানে এখন শুধু আর পুরুষ পরিচালককেই বোঝায়না! কারণ নারীরাও এখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতে শিখে গেছেন লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশান! পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দেয়া এমন এশিয় পাঁচ নারী নির্মাতার কথাই থাকলো এখানে…
মিরা নায়ার:
১৯৫৭ সালের ১৫ অক্টোবর ভারতের ওরিশায় জন্ম নেয়া এই নারী নির্মাতা নিজের প্রথম ফিচার ফিল্ম দিয়েই বাজিমাৎ করে ফেলেন। ১৯৮৮ সালে মুক্তি পায় তার প্রথম সিনেমা ‘সালাম বোম্বে’। প্রথম সিনেমা মুক্তির পরই দুনিয়া ব্যাপী তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। সালাম বোম্বে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘গোল্ডেন গ্লোব’ পুরষ্কার জিতে নেয়। এছাড়াও অস্কারে বিদেশি ভাষার শ্রেষ্ট সিনেমা হিসেবে মনোনিত হয় এটি। মিরা নায়ার একজন ভারতীয় বংশ্দ্ভুত আমেরিকান নাগরিক। তিনি অসংখ্য জাতিয় ও আন্তর্জাতিক পুরষ্কারে অভিসিক্ত হয়েছেন। তার উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলো হলো নেমসেক, ভ্যানিটি ফেয়ার, দ্য প্যারেজ ফ্যামিলি ও অ্যামেলিয়া।
সামিরা মাখমালবাফ:
সমকালীন সময়ে শুধু নারী নির্মাতাদের মধ্যে নয়, বরং সামগ্রিক বিবেচনায় সামিরা মাখমালবাফ নামটি জায়গা করে নিয়েছে বিশ্ব চলচ্চিত্রের তালিকায়। একজন প্রভাবশালী সিনেমা নির্মাতা হিসেবে তিনি এখন সুপ্রতিষ্ঠিত।
১৯৮০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে ইরানের তেহরানে তার জন্ম। বাবা আরেক স্বনামধন্য ও সৃজনশীল চলচ্চিত্র নির্মাতা মহসিন মাখমালবাফ। সিনেমার প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকায় সামিরার উচ্চবিদ্যালয়ের গন্ডিও পার হয়নি। পাঁচ বছর মেয়াদি সিনেমা নির্মার্ণের কোর্স করতে গিয়ে একাডেমিক পড়াশুনা ছেড়েছেন এই গুণী নির্মাতা। মাত্র দুটি ভিডিও প্রোডাকশন নির্মার্ণের পর মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি বিশ্ব চলচ্চিত্রের অঙ্গনে হৈচৈ ফেলে দেন ‘আপেল’ সিনেমাটি নির্মাণ করে। এই সিনেমা নির্মার্ণের পর বিশ্বের নানা প্রান্তের গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি ও পুরষ্কার যোগ হয় তার ক্যারিয়ারে।
‘আপেল’-এর পর তিনি‘ব্ল্যাকবোর্ড’ নামের অন্য একটি সিনেমা নির্মাণ করেও পৃথিবীর সিনেমা জগৎকে যেনো একটা ঝাঁকি দেন। সেপ্টেম্বর ১১, এট ফাইভ ইন দ্য আফটারনুন এবং টুলেগড্ হর্স নামের সিনেমাগুলও সমানভাবে সিনেমা ক্রিটিকদের প্রসংশা কুড়িয়েছে।
নার্গিস আবেয়ার:
বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ফিল্ম ফেস্টিভালগুলোতে এখন ইরানি সিনেমার জয়জয়কার। কান, বার্লিন কিংবা লোকার্নোসহ বিশ্বের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম ফেস্টিভালগুলোতেই এখন শক্ত অবস্থানে আব্বাস কিয়ারোস্তামির উত্তরসুরিরা। সমানভাবে ‘বিদেশি ভাষার সিনেমা’ বিভাগে অস্কারেও দাপট দেখান তারা। ৯০তম অস্কার অ্যাওয়ার্ড-এর সম্ভাবনাময় তালিকায় ছিলো ইরানের ছবি ‘ব্রেথ’! যে ছবিটির নির্মাতা একজন নারী। ইরানের ইতিহাসে প্রথম কোনো ঘটনা যেখানে অস্কারে পাঠানো হয় কোনো নারী নির্মাতার ছবি! নির্মাতার নাম নার্গিস আবেয়ার।
১৯৭০ সালের ৮ আগস্ট ইরানের তেহরানে জন্ম নার্গিসের। পড়াশোনা করেছেন ফারসি সাহিত্যে। লেখা লেখি দিয়েই তার সৃষ্টিশীলতা শুরু। প্রধান গল্প ও উপন্যাস লেখেই অভ্যস্ত তিনি। গল্প লেখতে লেখতেই একদিন সেটা দেখানোর বাসনা জাগে। সেই থেকে সিনেমা নির্মাণে আসেন এই নারী।
৯০তম অস্কার অ্যাওয়ার্ড-এর আসরে বিদেশি ভাষার ছবির শাখায় ইরান-ইরাক যুদ্ধ নিয়ে তৈরি ‘ব্রেথ’ দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি পেলেও নির্মাতা হিসেবে তার পরিচিতি এনে দেয় ‘ট্র্যাক ১২৩’ নামের চলচ্চিত্রটি। এছাড়াও তিনি নির্মাণ করেছেন ‘অবজেক্ট ইন মিরর’ নামের আরো একটি ফিচার ফিল্ম। বেশ কয়েকটি ডকুফিল্মও আছে তার। এরমধ্যে ‘ওয়ান ডে আফটার দ্য টেন ডে’, ‘দ্য এন্ড ডে’ এবং ‘কাইন্ড ডেড এন্ড’ উল্লেখযোগ্য। সর্বশেষ তিনি নির্মাণ করেছেন ‘নাইট অব দ্য ফুল মুন’(শাবি কে মহ কমেল শোদ) নামের একটি ছবি। যে ছবির জন্য এরইমধ্যে ফজর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ৬টি বিভাগে পুরস্কার অর্জন করেন নার্গিস।
হায়ফা আল মনসুর:
কবি আব্দুর রহমান মনসুরের বারো সন্তানের আটতম হায়ফার জন্ম ১০ আগস্ট ১৯৭৪। বাবার আগ্রহেই হায়ফা সিনেমার প্রতি আকৃষ্ট হোন। সৌদি আরবের মতো একটি কট্টর মুসলিম প্রধান দেশের প্রথম নারী সিনেমা নির্মাতার নাম হায়ফা আল মনসুর। শুধু কি নারী নির্মাতা হিসেবেই প্রথম? না, বরং সৌদি আরবের সিনেমা নির্মার্ণের ইতিহাসে হায়ফার নাম সর্বাগ্রে। কারণ তিনিই যে সৌদি আরবের মাটিতে দাঁড়িয়ে বলেছেন অ্যাকশন আর কাট!
তাই হায়ফা শুধু একজন সিনেমা নির্মাতাই নন, বরং আধুনিক সময়ের সিনেমার মানুষদের কাছে তিনি একজন জলজ্যান্ত ইতিহাসও বটে।
সৌদি আরবে একজন নারীর সিনেমা তৈরির প্যাশন খুব একটা সহজতো নয়ই, বরং কঠিনতর চ্যালেঞ্জের বিষয়। অথচ হায়ফা সেই কাজটিই করে দেখালেন। কায়রোর আমেরিকান ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে কাজের জন্য সৌদি ফিরে আসেন। সৌদিতে এসে দেখলেন নারীদের হিডেন লাইফ, পুরুষ শ্রেণির চাপিয়ে দেয়া বাধ্যবাধকতা, যা তাকে ভীষণ পিড়া দেয়। ফলে সৌদিতে নারীদের এমন জীবনাচরণের উপর ভীত্তি করেই তিনি ২০১২ সালে নির্মাণ করেন ‘ওয়াদজা’। পুরো সিনেমা খুব কৌশলে শুট করেন সৌদির রাস্তায়। কারণ সৌদিতে সিনেমা শুট করা নিষিদ্ধ।
‘ওয়াদজা’ মুক্তির পরই সমস্ত দুনিয়া সচকিত হয়ে উঠে হায়ফার এমন দুঃসাহসিক কাজে। বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভালগুলোতে প্রদর্শিত হতে থাকে ছবিটি। ব্যাপক প্রশংসা পান সবার, বাগিয়ে নেন বেশকিছু পুরস্কারও। ৮৬তম অস্কারের সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র কোটাতে পুরষ্কার জিতে নেয় হায়ফার ‘ওয়াদজা’। এবং প্রথম সিনেমা নির্মাণ করেই অস্কারপ্রাপ্ত দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় সৌদি আরবের নাম।
দীপা মেহতা:
ভারতীয় বংশজাত একজন কানাডিয়ান নাগরিক। তিনি ইন্দো-কানাডিয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে পরিচিত। বিতর্কিত নির্মাতা হিসেবে তার নাম উচ্চারিত হলেও তিনি তার ‘ট্রিলোজি’ নির্মার্ণের জন্য বিখ্যাত। তার ‘ইলিমেন্টস ত্রয়ী’ হচ্ছে ফায়ার-(১৯৯৬), আর্থ(১৯৯৮), ওয়াটার(২০০৫)।
দীপা মেহতা তার ছবিতে নারী হৃদয়ের ক্ষতকে যেনো আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। বিধবা নারীর সহমরণ, বাল্যবিবাহের প্রকোপ নিয়ে তিনি সফল কিছু কাজ করেছেন সিনেমার ভেতর দিয়ে। ‘ফায়ার’ সিনেমায় সমকামিতা দেখানোর জন্য হয়েছেন ব্যাপক ভাবে সমালোচিত। তার আলোচিত সিনেমার নাম ‘মিডনাইট চিলড্রেন’; যা বিখ্যাত লেখক সালমান রুশদির উপন্যাসের সফল চিত্রায়ন। তার আরেকটি চলচ্চিত্র ‘বিবা বয়েস’, যা বেশ প্রশংসিত হয়। সর্বশেষ তিনি নির্মাণ করেছেন ‘অ্যানাটমি অব ভায়োলেন্স’। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য আজীবন সম্মাননাসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তিনি স্বীকৃত হয়েছেন তিনি।