চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

পূর্ণ অধিকার দিলে প্রতিবন্ধীরাও উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে

প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে সচেতনতার প্রসার এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মর্যাদা সমুন্নতকরণ, অধিকার সুরক্ষা এবং উন্নতি সাধন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিবছর ৩ ডিসেম্বর বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য (Inclusion matters: access and empowerment of people of all abilities) ‘একীভূতকরণ: সক্ষমতার ভিত্তিতে সকল প্রতিবন্ধী মানুষের ক্ষমতায়ন’।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান মতে, বিশ্বের জনসংখ্যার ১০-১৫ শতাংশ মানুষ কোন না কোনভাবে প্রতিবন্ধী। এদের মধ্যে ধরণ অনুসারে- দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ৩২ শতাংশ, শারীরিক প্রতিবন্ধী ২৭.৮ শতাংশ, শ্রবণ প্রতিবন্ধী ১৮.৭ শতাংশ, বাক প্রতিবন্ধী ৩.৯ শতাংশ, বুদ্ধি বা মানসিক প্রতিবন্ধী ৬.৮ শতাংশ এবং বহুবিধ প্রতিবন্ধী ১০.৭ শতাংশ।

বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ মানুষ প্রতিবন্ধী। তার মধ্যে ৫২ ভাগ পুরুষ ও ৪৮ ভাগ নারী। আর শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ৪০ লাখ, মানসিক প্রতিবন্ধী ৩৮ লাখ, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ৩৩ লাখ। আর বাক, শ্রবণ ও নানা ধরনের মিলে মোট ২৫ লাখ প্রতিবন্ধী রয়েছে।

শারীরিক ও মানসিক ত্রুটির কারণে জীবনের স্বাভাবিক গতি যাদের বাধাগ্রস্ত, তাদেরকে বলা হয় প্রতিবন্ধী। অন্যভাবে বলা যায়, স্বাভাবিক কাজকর্ম বা চিন্তা করতে যাদের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তারা প্রতিবন্ধী। আরও একটু পরিষ্কার করে বলতে গেলে বয়স, লিঙ্গ, জাতি, সংস্কৃতি বা সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী সাধারণ মানুষ যে কাজগুলো করতে পারে প্রতিবন্ধিতার কারণে সে কাজগুলো প্রাত্যাহিক জীবনে করতে না পারাটাই হচ্ছে প্রতিবন্ধিতা। প্রতিবন্ধীতার কোনো প্রতিষেধক না থাকলেও আছে প্রতিরোধের উপায়। সেক্ষেত্রে প্রতিরোধের জন্য প্রতিবন্ধীতা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা খুবই জরুরি।

দুর্ঘটনাজনিত কারণে মানুষ বয়সের যে কোনো স্তরে প্রতিবন্ধী হতে পারে। এছাড়া অন্যান্য যেসব কারণে প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম নিতে পারে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কম বা বেশি বয়সে সন্তান ধারণ, মায়ের অপুষ্টিজনিত সমস্যা, শিশু গর্ভে থাকাবস্থায় মা রোগাক্রান্ত বা দুর্ঘটনার শিকার হওয়া, ভুল চিকিৎসা গ্রহণ, প্রসবকালীন সমস্যা কিংবা শিশু জন্মের পর রোগাক্রান্ত হওয়া বা মাথায় আঘাত পাওয়া অথবা অপুষ্টির শিকার হওয়া।

অজানা অনেক কারণেও শিশু প্রতিবন্ধী হতে পারে। জন্মের সময় মস্তিষ্কের বিন্যাসগত অসামঞ্জস্যতা অথবা জিনগত অস্বাভাবিকতাসহ জন্ম নিলে শিশু প্রতিবন্ধী হয়। প্রতিবন্ধী হওয়ার যেসব কারণ আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি সেগুলো নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমরা প্রতিবন্ধিতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।

এজন্য প্রতিবন্ধিতার কারণগুলো যেমন জানতে হবে তেমনি সবার মধ্যে তা ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে। শারীরিকভাবে অসম্পূর্ন মানুষদের প্রতি সহমর্মিতা ও সযোগীতা প্রদর্শন ও তাদের কর্মকন্ডের প্রতি সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যেই এই দিবসটির সূচনা। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ১৯৯২ সাল থেকে এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে উত্তরাধিকার সম্পত্তির অধিকার দান, গণমাধ্যমে প্রতিবন্ধী সম্পর্কে নেতিবাচক শব্দ ব্যবহার না করা, প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকলে প্রতিবন্ধী সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুয়োগ দেয়া, গণপরিবহনে মোট আসনের ৫ ভাগ আসন প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত করাসহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সামন সুযোগ ও অধিকার নিয়ে ২০১৪ সালের ৩ অক্টোবরে জাতীয় সংসদে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা বিল-২০১৩’ পাস হয়েছে।

একীভূত শিক্ষা এবং প্রতিবন্ধী শিশু বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদসহ শিশু অধিকার সনদ (১৯৮৯), বাংলাদেশ বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন (১৯৯০), প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সনদ (২০০৬) এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইন ও নীতিমালাসমূহে সর্বজনীন শিক্ষার অধিকারের কথা বলা থাকলেও প্রতিবন্ধী শিশুরা শিক্ষার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।

বিগত দু’দশক ধরে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে জনসচেতনতা ও কার্যক্রম বৃদ্ধি পেলেও প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থা দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় নয় বরং এটি সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যা প্রতিবন্ধী শিশুকে শিক্ষার মূল স্রোত ধারায় নিয়ে আসতে বাধা হিসেবে কাজ করছে। দেশের মূল শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তে পৃথকীকরণের ধারায় গড়ে ওঠা বিশেষ শিক্ষা ও সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থায় বেশির ভাগ প্রতিবন্ধী শিশু শিক্ষা লাভ করছে।

ইউনেস্কোর গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা ৪ জন প্রতিবন্ধী শিশু স্কুলে যাওয়ার উপযোগী হলেও তাদের পক্ষে স্কুলে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে অসচেতনতা ও স্কুল ভবনগুলোর অপ্রবেশগম্যতা। পিইডিপি-২ এর অধীনে নির্মিত স্কুল ভবনগুলো প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রবেশগম্য করে গড়ে তোলার কথা থাকেলেও তা হয়নি। প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষায় অর্ন্তভূক্ত করার পূর্বশর্ত হলো একীভূত শিক্ষা, সালামাল্কা ঘোষণার মধ্যে দিয়ে যার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ সনদে (সিআরপিডি) প্রতিবন্ধী শিশুদের অন্যান্য সকল শিশুদের সাথে সমতার ভিত্তিতে মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার ভোগ করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ এ সনদে স্বাক্ষর ও অনুস্বাক্ষর এর মাধ্যমে। সনদে প্রতিবন্ধী শিশুর প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষা প্রদানের উদ্যোগ প্রদানের কথা বলা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে আলোকপাত করা হয়েছে একীভূত শিক্ষা। প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা পৃথিবীব্যাপী ৮ মিলিয়ন শিশু তাদের জন্মের ৫ বয়সের মধ্যেই মারা যায় এবং তাদের ৯৯ ভাগই উন্নয়নশীল দেশের বাসিন্দা।

বাংলাদেশে বেসরকারী ভাবে পরিচালিত প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক এক সমীক্ষায় জানা যায় যে, ০ থেকে ৫ বছর বয়সীদের মধ্যে ২% কোন না কোন ধরনের প্রতিবন্ধিতার শিকার। এ সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে যে,বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে মৌলিক চাহিদা হিসাবে স্বাস্থ্য সেবার কথা উল্লেখ আছে। অপরিহার্য স্বাস্থ্যসেবা জনগনের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য নিয়মিত হয়েছে কমিউনিটি হেল্থ সেন্টার। সরকার অটিজম এবং অন্যান্য বিকাশকালীন প্রতিবন্ধিতা দ্রুত সনাক্তকরনের জন্য জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরনে শিক্ষার পাশাপাশি স্বাস্থ্যখাতেও সর্বোচ্চ বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। ৫ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুর হার হাজারে ৮৮ থেকে ৬৫ তে কমিয়ে আনায় সম্ভব হয়েছে। উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারের সাফল্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা “এমজিডি ২০১০” পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুসারে, কোন দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৫ ভাগ কোন না কোন ধরনের প্রতিবন্ধী। অর্থাৎ আদমশুমারী,২০১১ অনুসারে বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি মানুষ প্রতিবন্ধিতার শিকার। আর এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশের সংবিধানে অনুচ্ছেদ ২৭ অনুযায়ী সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী হলেও প্রতিবন্ধী মানুষের দিকে তাকালে এর ভিন্নতার বহু উদাহরণ পাওয়া যায়। প্রতিবন্ধিতা ও প্রান্তিকতা একই সূত্রে গাঁথা। এদেশের বেশীরভাগ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিই বঞ্চিত হয় সর্বপ্রকার মৌলিক অধিকার থেকে। শিকার হয় অবহেলা আর বঞ্চনার। বিদ্যমান এই পরিস্থিতিতে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের কাছে। বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ।

দরিদ্রতা ও প্রতিবন্ধিতা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। তথ্যহীনতা তাদের বিপদাপন্নতাকে বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। তথ্যের অভাবে তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক নিরাপত্তা বলয় প্রদত্ত সেবা সহ অন্যান্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় প্রতিনিয়ত। এছাড়া রয়েছে সামাজিক কুসংস্কার,পারিবারিক অবহেলা। যা তাদের বিকাশের প্রধান অন্তরায়। একজন ইশারাভাষী মানুষের ভাষা না বুঝার কারণে তাকে বিড়ম্বনার পড়তে হয়। প্রতিবন্ধী সনদ, ভাতা, শিক্ষা উপবৃত্তি পেতে তারা বেশির ভাগই দুর্নীতির শিকার হয়। যেহেতু দুর্নীতি দারিদ্র ও সব ধরনের অবিচার বাড়ায়, প্রতিবন্ধী মানুষের সামগ্রিক উন্নয়নও এর কারণে ব্যাহত হয়। দেশের প্রতিবন্ধীদের পেছনে ফেলে ডিজিটাল বাংলাদেশ অর্জন সম্ভব হবে না।

সাহায্য নয়, তাদের পূর্ণ অধিকার দিলে তারও জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে সম্পৃক্ত করতে না পারলে কখনো দেশ অগ্রসর হতে পারবে না। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করনের মাধ্যমে তাদের ও দেশের উন্নয়ন সম্ভব।