ভয়াবহ সেই নিমতলী ট্রাজেডির প্রায় নয় বছর পর চকবাজারে প্রায় একইভাবে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এরই মধ্যে ৭৮ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পুড়ে গেছে অন্তত পাঁচটি বাড়ি।
তবে চকবাজারেও নিমতলীর মতো বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরণ নাকি সিলিন্ডার বিস্ফোরণ বা অন্য কোনো কারণে আগুনের সূত্রপাত – তা এখনো জানা যায়নি।
পূর্ণিমা রাতে চকবাজারের বাতাসে কান্না আর পোড়া গন্ধে ভারী
চকবাজারের এই আগুনে যখন দাউ-দাউ করে জ্বলছিল কয়েকটি বাড়ি। সে সময় আকাশে ছিল পূর্ণিমার রূপালী চাঁদ। সেই আলোয় সেখানকার আকাশের চাঁদটি ছিল যেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘ঝলসানো রুটি’র মতোই।
সেখানে দাহ্য পদার্থের কারখানায় রাখা ছিল বিপজ্জনক সব কেমিক্যাল। ফলে আগুনের লেলিহান শিখা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। মুহূর্তেই আগুন আশপাশের ভবনেও ছড়িয়ে পড়ে। আহতদের আর্তনাদ আর চারপাশের মানুষের আহাজারিতে চকবাজারের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।
অন্ধকারাচ্ছন্ন চকবাজার যেন মৃত্যুপুরী
অগ্নিকাণ্ডের পরপরই চকবাজার থানা থেকে শাহী মসজিদ এলাকায় বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছিল। রাতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির লাল-নীল আলো আর হুইসেলে চকবাজার যেন পরিণত হয় এক মৃত্যুপুরীতে।
আগুনের ভয়াবহতা এতোটাই বেশি ছিল যে শুধু বাড়ি-ঘরে নয় রাস্তায় যানজটে আটকে থাকা মানুষজনেরা মৃত্যু থেকে রেহাই পায় নি। এলাকাবাসী জানায়, সিলিন্ডার অথবা ট্রান্সফরমার বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পর রাস্তায় পাশে থাকা মানুষগুলো প্রাণ আগে ঝরেছে।
আগুনের ঘটনার আগ মুহূর্তে নন্দ কুমার দত্ত রোডে রিকশায় যাত্রী নিয়ে যাচ্ছিল নূর আলম। বিস্ফোরণের পর একটি দেয়াল ভেঙ্গে তার মাথায় লাগে, সে ড্রেনে পড়ে যায়। কিন্তু তার জ্ঞান থাকায় সেখান থেকে বেঁচে ফিরতে পেরেছেন তিনি।
পর্যাপ্ত পানি ও রাস্তা চওড়া না থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে বিঘ্ন
পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারছিল না। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নানাভাবে চেষ্টা করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খাচ্ছিল। অগ্নিকাণ্ডের খবর দ্রুত পেলেও রাস্তা সরু হওয়ার কারণে এবং পানির অপর্যাপ্ততার জন্য তৎপরতায় বেগ পেতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের।
কারখানার দাহ্য পদার্থের কারণে পুরান ঢাকার চকবাজারের পাঁচটি ভবনে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান।
ফায়ার ফাইটারদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে এলাকাবাসী
আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ রেখে কাজ করে গেছে চকবাজারের এলাকাবাসীরা। ফায়ার সার্ভিস যখন পানির স্বল্পতায় ভুগছে তারা তখন শাহী মসজিদের পানির ট্যাঙ্কিসহ মটর দিয়ে পানি উঠানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
এছাড়াও আগুনের সর্বশেষ আপডেট তারা হ্যান্ড মাইক দিয়ে এলাকাবাসীদের পৌঁছে দিয়েছে। এলাকাবাসী বাদেও অগ্নিকাণ্ড সূত্রপাতের পর রেড ক্রিসেন্টের কর্মীরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আকাশে হেলিকপ্টার
আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ঘটনাস্থলের আকাশে বিমানবাহিনীর দুইটি হেলিকপ্টার দিয়ে উপর থেকে পানি নিক্ষেপ করেছে। এছাড়াও কাউকে উদ্ধার কিংবা প্রয়োজন হলে হেলিকপ্টারগুলো ব্যবহৃত হবে বলে জানানো হয়।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত বিমানবাহিনীর প্রশাসনিক কর্মকর্তা (ফায়ার সার্ভিস ইনচার্জ) স্কোয়াডন লিডার সঞ্জিব চৌধুরী চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, পানি স্বল্পতার খবর পেয়ে বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে চার গাড়ি পানি নিয়ে আসা হয়েছে। রিজার্ভ পানি যতটুকু প্রয়োজন হয় তা সরবরাহের জন্য বিমানবাহিনী প্রস্তুত রয়েছেন বলেও জানান তিনি।এছাড়া তেজগাঁও বিমানঘাটিতে আরো ৪টি হেলিকপ্টার স্ট্যান্ডবাই রাখার কথাও জানান তিনি।
প্রায় ১১ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে
ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তরের কন্ট্রোল রুম জানায় প্রায় ১১ ঘণ্টা পর চকবাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। প্রাথমিকভাবে সাড়ে ৪ ঘণ্টা পর আগুন কিছু নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও পরে আবার আগুন লাগে। ড্যাম্পিং শুরু করার পর ভবনের পেছন দিকে সেই আগুনের শুরু হয়। তা নিয়ন্ত্রণে আনতে ভোর ছয়টা বেজে যায়।
আগুনে দগ্ধ যারা
অগ্নিকাণ্ডের পর এখন পর্যন্ত ৪১ জন দগ্ধ ব্যক্তিরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে তাদের মধ্যে- রেজাউল (২১), জাকির হোসেন (৫০), সেলিম (৪৫) আনোয়ার (৫০) মোস্তাফিজ (৪০), জাহিদুল (২৮), ইভান (৩০), মাহমুদ (৫৭), রামিম (১২), সালাউদ্দিন (৫০), মোজাফ্ফর হোসেন (৩২) সোহাগ (২৬) সোহান (৩৫) ফজর আলী (২৫), হেলাল (২৫) ও সুজন (৪০) নাম ঠিকানা জানা গেছে। এদের মধ্যে প্রথম দু’জনের অবস্থা গুরুতর।
যারা আহত হয়েছেন তাদের মধ্যে- আল আমিন (৩৫), কাউছার (৩০), জাহাঙ্গীর (২৩), ছালাম (৩০), রবিউল (৪০), সালাউদ্দিন (৩৪), আনিছুর রহমান (৫০), তানজিল (১৪), রমজানের (১২) নাম জানা গেছে। এদের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত আছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া চ্যানেল আই অনলাইনকে জানান, দগ্ধদের কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর। জরুরি বিভাগ ও বার্ন ইউনিটে তাদের চিকিৎসা চলছে।
যেভাবে আগুনের সূত্রপাত
বুধবার রাত ১০টা ৩৮ মিনিটে চকবাজারের নন্দ কুমার দত্ত রোডের শেষ মাথায় মসজিদের পাশে ৬৪ নম্বর হোল্ডিংয়ের ওয়াহিদ ম্যানসনে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। এলাকাবাসী বলছে, ওই ভবনের কারখানা থেকে আগুন ছড়িয়েছে। ওয়াহিদ ম্যানসনের নিচতলায় প্লাস্টিকের গোডাউন ছিল। ওপরে ছিল পারফিউমের গোডাউন।
আগুনের সূত্রপাত কীভাবে, এ বিষয়টি এখনো নিশ্চিত না হলেও বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার থেকে চকবাজারে ভয়াভহ আগুনের সূত্রপাত হয় বলে জানিয়েছে স্থানীয় এলাকাবাসী। তারা বলছেন, প্রচণ্ড শব্দে বিদ্যুৎ বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিটার বিস্ফরণের পর তা থেকে ছুটে আসা আগুন দুটি গাড়িতে লাগে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি দুটি সিলিন্ডার সহ বিস্ফোরণ করে। আগুনের লেলিহান শিখা পাশে থাকা কেমিক্যাল গোডাউনে পড়লে সেখান থেকে অগ্নিকাণ্ড দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
যা বলছে ফায়ার সার্ভিস
গ্যাস সিলিন্ডার নাকি ট্রান্সমিটার বিস্ফোরণ, নাকি বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত- এমন এক প্রশ্নের জবাবে ফায়ার সার্ভিসের ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান বলেন, ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকনের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি গঠন হচ্ছে। তদন্ত করলেই নিশ্চিত হওয়া যাবে।
নিমতলীর ট্রাজেডির নয় বছর পরও সরেনি কেমিক্যাল কারখানা
২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর নবাব কাটরায় রাত ৯টার দিকে একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরণ ঘটে। তাতে একটি প্লাস্টিক কারখানায় আগুন ধরে যায়। সেখানে বিপজ্জনক কেমিক্যাল ছিল। ফলে আগুনের লেলিহান শিখা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। মুহূর্তে আগুন আশপাশের ভবনে ছড়িয়ে পড়ে।
শত শত মানুষের চোখের সামনে বহু মানুষ পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। সেই দুর্ঘটনায় ১২৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। পুড়ে যায় ২৩টি বসতবাড়ি, দোকান ও কারখানা।
নিমতলী ট্রাজেডির নয় বছর পরও রাজধানীর পুরান ঢাকা থেকে সরেনি কেমিক্যাল কারখানা। গত সপ্তাহে এক অনুষ্ঠানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন জানান পুরান ঢাকার যে কেমিক্যাল গুদাম রয়েছে তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
দাহ্য পদার্থের সংমিশ্রণে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই খুব দ্রুতই এগুলো সরানো হবে। কিন্তু তার আগেই আবারও কান্না, হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারী হয়ে উঠল পুরান ঢাকায়।