পলাশ মাহবুব। কথাসাহিত্যিক, টিভি নাট্যকার। প্রায় দুই দশক ধরে লিখছেন ছড়া, প্রেমাণুকাব্য, রম্য, গল্প, উপন্যাস, শিশুতোষসহ সাহিত্যের সকল ধারায়। পেয়েছেন এসিআই আনন্দ আলো পুরস্কার, অন্নদাশঙ্কর রায় পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। আগামী অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৮ তে আসবে তার প্রায় দশটি বই। চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে লেখালেখি নিয়ে কথা বলেছেন জনপ্রিয় এই লেখক, নাট্যকার।
অমর একুশে গ্রন্থমেলা–২০১৮ তে আপনার কয়টি বই বের হবে?
১০টি বই বের হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কয়েকটা বই এখনো লেখা শেষ হয়নি। জানি না শেষ পর্যন্ত কয়টা বই বের হবে। তবে সাতটা বই লেখা শেষ। অষ্টম বইয়ের লেখা চলছে। ব্যক্তিগত ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় লেখায় সময় কম দিতে পারছি। না হলে নিশ্চিতভাবেই ১০টি বই বের হতো।
সাতটি বই লেখা হয়ে গেছে বললেন। বইগুলো সম্বন্ধে জানতে চাইছি।
গত তিন-চার বছরে আমার প্রকাশনী নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। মূলত এগুলো থেকেই আমার বই বের হয়। এরমধ্যে পাঞ্জেরী থেকে সবচে বেশি বই বের হয়। গত মেলায় পাঞ্জেরী থেকে চারটি বের হয়েছিল। এবার পাঁচটি বের হবে। পাঁচটিই কিশোরদের জন্য।
লজিক লাবু টু এবং সিন্দুকের সন্ধানে কিশোর উপন্যাস। গতবছর একটা সিরিজ উপন্যাস চালু করেছি। এবছর বের হবে লজিক লাবু সিরিজের দ্বিতীয় উপন্যাস।
টমোজ কিশোর উপন্যাস। আমরা যমজের গল্প অনেক শুনেছি। একই সাথে জন্ম, একই চেহারার দুইজন হলো যমজ। টমজ হলো একই চেহারার তিনজন। এটি মজার কিশোর উপন্যাস।
নিলুর আকাশ গল্পের বই। কিশোর উপযোগী গল্প।
ইচ্ছে ঘুড়ির ইচ্ছে পূরণ বইয়ে একটি ক্যারেক্টারের চারটি গল্প থাকবে।
না ঘুমানোর দল ছড়ার বই। প্রতিবছর আমার একটি মাত্র ছড়ার বই বের হয়। আগের বছর বের হয়েছিল ‘মা করেছে বারণ’। এবার বের হচ্ছে ‘না ঘুমানোর দল’।
জঙ্গলে জলছাপ অ্যাডভেঞ্চার কিশোর উপন্যাস। বের হবে কথা প্রকাশ থেকে।
একজন অদ্ভুত মানুষ বড়দের গল্পের বই। বড়দের গল্পের বই বললাম এই কারণে, এতক্ষণ যে কয়টা বইয়ের নাম বললাম সবগুলো কিশোরদের জন্য। মেলায় আমার ছোটদের বই বেশি থাকে বলে আলাদাভাবে বলে দিলাম হা হা হা। বের হবে কথা প্রকাশ থেকে।
পরীর কাছে জরির চিঠি ছোটদের ইলাস্ট্রেটেড বই। ছবি বেশি থাকবে। বইটির কাজ এখনো শেষ করতে পারিনি। তবে অচিরেই শেষ হয়ে যাবে। এটিও কথা প্রকাশ থেকে বের হবে।
প্রস্তাবিত স্বামী রম্যের বই। প্রতিবছর একটা করে বের হয়। এবারেরটা হলো প্রস্তাবিত স্বামী। এখনো প্রকাশনী ঠিক হয়নি। ১২টি গল্প লেখা হয়েছে। আরও কয়েকটি লিখতে হবে।
প্রেমাণুকাব্য তিন। আমি রম্য ম্যাগাজিনে দুই লাইনে বা একেবারে ছোট পরিসরে যে কবিতা লিখতাম সেটি প্রেমাণুকাব্য নামে পরিচিত। এর আগে দুইটি বই বের হয়েছে। এবার আসবে প্রেমানুকাব্য তিন।
বইগুলো ফাইনাল। এছাড়া টো টো কোম্পানি সিরিজের আটটি উপন্যাস বের হয়েছে। এবার আট উপন্যাসের সংকলন আসতে পারে অন্বেষা থেকে।
বইমেলা ঘিরে আপনার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি কেমন থাকে?
বইমেলা হলো লেখক-পাঠক মিথস্ক্রিয়ার জায়গা। সারাবছর রকমারি, বেঙ্গল, পাঠক সমাবেশ, দিপনপুরসহ নানা জায়গা থেকে বই কেনে। কিন্তু লেখকের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হওয়া, ভালো লাগা মন্দ লাগা জানানোর সুযোগ মেলে বইমেলায়। লেখকরা নিয়মিত যান বইমেলায়। আমরা যারা পাঠক নির্ভর লেখক তারা পাঠকের সরাসরি ফিডব্যাক পাই। বহু জরুরি কাজ ফেলে আমরা মেলায় চলে যাই। আমি মনে করি বইমেলা আমাদের সবচে বড় উৎসব। এবং মাসব্যাপী বইমেলার এমন আয়োজন পৃথিবীর কোথাও দেখা যায় না। এটা এক অনন্য মিলনমেলা। ফলে আমি সারাবছর বইমেলার জন্য অপেক্ষা করি।
আপনি কিশোরদের জন্য বেশি লিখছেন। কারণ কী?
আমার ৩৫ টা বই বের হয়েছে এখন পর্যন্ত। এবার ১০ টা বের হলে হবে ৪৫ টা। এর মধ্যে প্রায় ৭০ ভাগ বই কিশোর ধর্মী। তার মানে এই না শুধু কিশোরদের জন্য লিখছি। পত্রিকায় বলেন আর বইয়ে বলেন বড়দের জন্যও নিয়মিত লিখছি। আমি আসলে শুধুমাত্র শিশু সাহিত্যিক পরিচয়ে আবদ্ধ থাকতে চাই না। আমি সবার জন্য লিখি।
এতগুলো ধারায় লেখার ফলে পরিচয় সংকটে ভুগতে হয় কি না?
সে তো ভুগতে হয়ই। অনেকগুলো ধারায় লেখার ফলে পরিচয় কী হবে বা মানুষ আমাকে কী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেবে তা নিয়ে দ্বিধায় ভুগতে দেখি। কেউ ছড়াকার বলে, কেউ রম্যলেখক বলে, টিভি নাট্যকার, শিশুসাহিত্যিক বলে। তবে আমি সংক্ষেপে কথা সাহিত্যিক ও নাট্যকার হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করি।
লেখালেখির সময় কোন বিষয়টা মাথায় রাখেন?
আপনি জানেন আমি ছোটদের, বড়দের গল্প উপন্যাস লিখি। ছড়া লিখি, রম্য লিখি, টিভি নাটক লিখি। আমি প্রায় সবই লিখি। ফলে লিখতে বসে একটু সমস্যায় পড়তে হয়। একটা প্লট নিয়ে ভাবি গল্প লিখব। কিন্তু লিখতে গিয়ে দেখা গেল সেটা উপন্যাস হয়ে গেল। উপন্যাস লিখতে গেলে সেটা টিভি নাটক বা রম্য হয়ে গেল। কখনো দেখা যায় উপন্যাসের প্লট নিয়ে লিখতে বসেছি কিন্তু সেটা হয়ে গেল ফেসবুক স্ট্যাটাস। ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে আবার একসময় গল্প বা উপন্যাস হয়ে গেল। বলা যায়, অনেক কিছু পরিকল্পনা করি। অনেককিছু পরিকল্পনা মতো হয়। আবার হয় না।
প্রেমাণুবাক্য লিখেছেন। আর আপনার হাত ধরেই ছোট ছড়ার এই ধারাটা জনপ্রিয় হয়েছে। প্রেমাণুকাব্যের পথচলার গল্পটা শুনতে চাই।
লেখালেখির শুরুতে জাতীয় পত্রিকার রম্য ম্যাগাজিনে লিখতাম। ২০০০ সালে প্রেমাণুকাব্য শিরোনামে লেখা শুরু করলাম। দুই লাইনের ছড়া। দুই লাইনের হলেও এতে চিন্তার খোরাক থাকে। থাকে চমক। শব্দের খেলা থাকে বলেই এতটা জনপ্রিয় হয়েছে। ২০০২ সালের ঘটনা। তখন একেবারেই তরুণ। ঐতিহ্য নামে একটি প্রকাশনীর আবির্ভাব হয়। বড় বড় লেখকের বই বের হয়। সেখান থেকে পত্রিকায় প্রকাশিত ও অন্যান্য লেখা নিয়ে প্রেমাণুকাব্যের বই বের হয়ে গেল। এরপর দীর্ঘ বিরতি। প্রেমাণুকাব্য লিখছি। কিন্তু বই করা হয় নাই। এর চৌদ্দবছর পর ২০১৬ সালে ‘প্রেমাণুকাব্য দুই’ বের হলো। এবার বের হবে প্রেমাণুকাব্য তিন।
এখন তো অনেকেই প্রেমাণুকাব্য নামে লিখছে?
শুধু এখন না, আমি লেখা শুরুর পর শতাধিক লেখক প্রেমাণুকাব্য নামে প্রেমের অণুকাব্য লেখা শুরু করে। এটা আমার ভালো লাগার একটা জায়গা। থিমটা ভালো লেগেছে বলেই তারা গ্রহণ করেছে।
অণুকাব্য আর প্রেমাণুকাব্যে মধ্যে পার্থক্য কী?
অণুকাব্য হলো যে কোনো বিষয় নিয়ে ছোট ছড়া। প্রেমাণুকাব্য আকারে ছোট কিন্তু প্রেমকে ধারণ করে। প্রেম, বিরহ, কাছে পাওয়ার আকুলতা, প্রেমের পরিণতি ইত্যাদি। ছড়াটা প্রেম কেন্দ্রিক হবে।
টোটো কোম্পানি সিরিজ লিখেছেন। এখন চলছে লজিক লাবু সরিজ। সিরিজ ধরে উপন্যাস বা গল্পের সুবিধা–অসুবিধা কী?
সিরিজ লিখতে গেলে লেখকের একটা দায়বদ্ধতা তৈরি হয়। পাঠক অপেক্ষা করছে, ফলে লিখতেই হবে। এছাড়া চরিত্রগুলো বৈশিষ্ট্য ধরে রাখা একটা চ্যালেঞ্জ। চরিত্রগুলো পাঠক গ্রহণ করলে দ্রুত সেটা পরিচিতি পায়।
কিশোরদের জন্য লেখার চ্যালেঞ্জ কী?
কিশোররা বড়দের মতো রাখঢাক করে না। ভালো লাগলে যেমন মুখের উপর বলে দেয়। খারাপ লাগলেও তেমন মুখের উপর বলে দেয়। ফলে এটা বাড়তি চাপ।
তবে যখন মেলায় দেখি কেউ বাবা-মায়ের কাছে পেনসিলে লেখা বইয়ের তালিকা ধরিয়ে দিয়েছে। অনেক ভালো লাগে।
লেখা লেখালেখিতে প্রাপ্তির খাতায় যোগ হয়েছে বেশকিছু পুরস্কার ও সম্মাননা। উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননার কথা জানতে চাই।
‘মা করেছে বারণ’ বইয়ের জন্য ২০১৬ তে পেয়েছি এসিআই আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার। ২০১৪ সালে কলকাতা থেকে পেয়েছি অন্নদাশঙ্কর রায় সাহিত্য পুরস্কার। ভারত সরকারের আমন্ত্রণে তৎকালীন ভারতীয় প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির রাষ্ট্রপতি ভবনে আমন্ত্রণ পেয়েছি। এছাড়া টুকটাক আরও কিছু পুরস্কার পেয়েছি। এ মুহূর্তে সবকিছু মনে পড়ছে না। তবে মজার বিষয় হচ্ছে পুরস্কার পাওয়ার চেয়ে আমি নমিনেশন বেশি পাই। হা হা হা।
বিগত বছরগুলোর আলোকে মেলার আয়োজন নিয়ে কোন প্রত্যাশা আছে কি না?
হ্যাঁ, তা আছে। লেখক পাঠকদের বসার জায়গা থাকে না। বিশাল মেলা একজন পাঠক দুই তিন ঘণ্টা হেঁটে বেড়ান। তার অবশ্যই একটু বসার দরকার। বসার জায়গা করা দরকার। প্যাভিলিয়নগুলো একটু বড় করে আধুনিক প্রযুক্তিগুলো যুক্ত করা দরকার। যেহেতু এটা আমাদের প্রাণের মেলা।
আরেকটা কথা আছে। মেলা শেষ হয় রাত আটটায়। বইমেলা কেন আটটায় শেষ হবে? ঢাকা শহরের যে অবস্থা, উত্তরা থেকে কেউ অফিস করে মেলায় আসতে আসতে মেলা শেষ। মেলার সময় বাড়ানো উচিৎ।
সবশেষে লেখালেখির শুরুর গল্পটা বলুন-
আমার স্কুল জীবন কেটেছে কঠোর অনুশাসনে। ক্লাস সেভেন কী এইটে স্কুলে বিজ্ঞান ক্লাব এর কমিটি করা হলো। ক্লাস নাইন টেনের বড় ভাইয়েরা বড় বড় সব পদ পেল। আমি ছোট বলে আমাকে দেওয়া হলো ‘গুরুত্বহীন’ সাহিত্য সম্পাদকের পদ। সারাবছর আমার কোনো কাজ নেই। তবে বছরের একটা সময় সাহিত্য সাময়িকী বের করা হবে। তখন পুরো কাজটা আমার হাতে এসে গেল। সবার লেখা সংগ্রহ করলাম। প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি আসবেন উদ্বোধন করতে।
এই সাহিত্য সাময়িকীতে সাহিত্য সম্পাকদের লেখা না থাকলে কেমন হয়? একটা ছড়া লিখলাম। বিজ্ঞানের ছড়া। আমার ছবিসহ ছড়া ছাপা হলো। স্কুলে সবাই আমাকে আলাদাভাবে দেখতে শুরু করল। তখন মনে হলো, লিখে দেখি কী দাঁড়ায়।
উঠেপড়ে লিখতে শুরু করলাম এসএসসি পরীক্ষার পর। যে ফাঁকা সময়টা থাকে সে সময়। বাসা থেকে পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে পত্রিকা পড়তাম এবং লেখা পাঠাতাম। একদিন দেখি প্রথম আলোতে স্পেশাল ছয়জন ছড়াকারের ছড়া ছাপিয়েছে। লুৎফর রহমান লিটন, আমিরুল ইসলাম, আনজির লিটন, ওবাদুল গনি চন্দন, রোমেন রায়হান এবং পলাশ মাহবুব।
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। এত বড় লেখকদের সাথে আমার লেখা। সাইকেল চালিয়ে বাসায় যাচ্ছি। পত্রিকাটা আমার হাতে। আমার মনে হচ্ছে সবাই আমাকে দেখছে। সবাই মনে হয় লেখাটা পড়েছে।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ভালো সাবজেক্ট পাওয়ার পরও সাংবাদিকতায় ভর্তি হই। যাতে লেখালেখি করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দুই হাতে লিখতে শুরু করি। সেই থেকে শুরু। গত ১৭ বছর ধরে প্রতিবছর আমার বই বের হচ্ছে।