স্কুলটা বাড়ি থেকে বেশ দূরে। সোয়া কিলোমিটার। ছোট খোকা সেই স্কুল মানে গিমাডাঙ্গা টুঙ্গিপাড়া স্কুলের ছাত্র। তখন চলছে ভর বর্ষাকাল। চারদিকে ফুঁসে উঠছে পানি। নৌকা করে স্কুলে যেতে হয়। একদিন নৌকা দিয়ে স্কুলে থেকে বাড়ি ফেরার পথে ঘটল এক দুর্ঘটনা। বর্ষার পানিতে নৌকা ডুবে গেল। নৌকার মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিল। খোকা ভরা বর্ষার পানিতে হাবুডুবু খেয়ে কোনমতে পাড়ে এসে উঠল। এদিকে এ খবর দাদির কানে যাওয়া মাত্র তিনি মহা দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলেন।
সেদিন থেকে দাদির কড়া ঘোষণা খোকার স্কুলে যাওয়া বন্ধ। গোটা বংশের আদরের দুলাল এক রত্তি সোনার টুকরো নাতি বলে কথা! নাতিকে কলজের টুকরা বলে জ্ঞান করতেন। টুঙ্গিপাড়া থেকে স্কুল বদল করে খোকাকে পাঠানো হলো ওর বাবার কাছে। গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হলো তাকে। এরপর খোকার পুরো কৈশোর কেটেছে সেখানেই।
শৈশবের গ্রাম, চপলতা, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ, দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানো সব মিলিয়ে খোকার ছোটবেলাটা ছিল আর আট-দশটি আটপৌরে বাঙালীর মতোই। সেদিনের সেই ছোট্ট খোকা পরবর্তীতে নিজের প্রজ্ঞা আর দূরদর্শিতা দিয়ে পরিণত হয়েছিলেন মানুষের নেতায়। বাঙালীর স্বপ্নদ্রষ্টায়, বঙ্গবন্ধুতে, স্বাধীনতার স্থপতিতে। বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে অবিস্মরণীয় এক নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। যাঁর উচ্চতা ছাড়িয়ে গিয়েছিল আকাশতক। শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালীর আত্মমর্যাদার নাম। অহংকারের নাম।
বঙ্গবন্ধুর সিংহ হৃদয় মানুষের জন্য সবসময় প্রসারিত ছিল। মানুষকে পরম মমতায় নিজের করে নিতে পারার এক ঐশ্বরিক গুণ ছিল তাঁর। আর মানুষও তাঁর কথায় জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিজয় ছিনিয়ে এনে দেখিয়ে দিয়েছিল যে, হে মহান নেতা, তোমার জন্য আমরা সব অসাধ্য সাধন করতে পারি।যুদ্ধদিনে সাড়ে সাত কোটি বাঙালী বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বিশ্বের অন্যতম প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এক অসম যুদ্ধে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখে তাঁর অমোঘ বাণীকে সত্যে পরিণত করেছিল।
কী সেই বাণী?
‘আমাদের কেউ দাবায়া রাখতে পারবে না’। সত্যিই বাঙালীকে কেউ ‘দাবায়া’ রাখতে পারেনি। তখনও না। এখনও না। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ ধরে বাঙালী এগিয়ে চলেছে।
তাঁর অনেক পরিচয়। একের ভেতর অজস্র। পুত্র, ভাই, স্বামী, চাচা, মামা, দাদা, নানা, শ্বশুর, শুভাকাঙ্ক্ষী , নিকটজন, নেতা কত পরিচয়েই না তিনি পরিচিত। সব পরিচয়ের আড়ালে লুকিয়ে আছে একজন সজ্জন মানুষের প্রতিকৃতি, একজন বিনয়ী মানুষের অবয়ব সর্বোপরি সিংহ হৃদয় ও বাঙালী অন্তপ্রাণ। প্রতিটি পরিচয়ে নিজেকে উজাড় করে মেলে ধরার প্রয়াস রয়েছে। তাঁর এতসব পরিচয়ের বাইরে একটি পরিচয় নিয়ে কৌতূহল চেপে রাখা বেশ কষ্টকর। সেটা হলো পিতা হিসেবে কেমন ছিলেন বঙ্গবন্ধু?
সারাটা জীবন মানুষের জন্য ব্যয় করেছেন এই সিংহ হৃদয়ের বাঙালী। মানুষের সুখে-দুঃখে, কষ্টে, বেদনায় তিনি তাদের পাশে থেকেছেন। অন্যায়-জুলুমের প্রতিবাদ করেছেন। শোষিতের পক্ষে অবিচল থেকেছেন। দেশ, ভাষা আর মানুষ এই তিন ছিল তাঁর রাজনীতির মূল মন্ত্র। তাঁর রক্তে, অস্থিমজ্জায় রাজনীতি মিলেমিশে একাকার হয়েছিল। সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি মানুষকে নিয়ে থেকেছেন জীবনে এর কোন প্রত্যয় হয়নি কিংবা কথাটাকে এভাবেও বলা যেতে পারে যে, বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনে এ অঞ্চলের খেটেখাওয়া, অধিকারবঞ্চিত মানুষের পক্ষে লড়াই করাকে ধ্যান-জ্ঞান বলে গণ্য করতেন। বাঙালীর জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন।
শাসকদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে মৃত্যুর পরোয়ানা কাঁধে নিয়ে নির্বিকারভাবে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময়ও বলব আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালী একবার মরে, বারবার মরে না।’
আকৃতিগত দিক থেকে বাঙালী গড়পড়তায় খর্বকায় হলেও দীর্ঘ আকৃতি পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এই উচ্চতা প্রভাব ফেলেছিল তার স্বভাব ও চরিত্রেও। রাজনীতিতে সবাইকে পেছনে ফেলে তিনি অনন্য এক উচ্চতা তৈরি করেছিলেন। রাজনীতি গবেষকরা তাদের গবেষণায় বলছেন, বাংলা, বাঙালী, বাংলাদেশ এই তিনের অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনে। পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু কেমন ছিলেন?
এ বিষয়টি জানা যায় তাঁর বড় মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা থেকে। ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থে শেখ হাসিনা অপার মমতায় পিতার প্রতিকৃতি তৈরি করেছেন। তিনি পিতার প্রতিকৃতি তৈরি করতে গিয়ে এক শ্রেষ্ঠ বাঙালীর চিত্রই তৈরি করেছেন।
পিতা বঙ্গবন্ধু ছোটবেলায় কেমন ছিলেন তা বর্ণনা দিতে গিয়ে শেখ হাসিনা লিখছেন, “দাদা আমাদের কাছে গল্প করলেন যে, ‘তোমার আব্বা এত রোগা ছিল যে, ফুটবলে জোরে লাথি মেরে মাঠে গড়িয়ে পড়ত। আব্বা যদি ধারেকাছে থাকতেন তবে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করতেন। আমরা তখন সত্যিই খুব মজা পেতাম। এর পেছনে মজার ঘটনা হলো মাঝে মাঝে আব্বার টিম ও দাদার টিমের মধ্যেও খেলা হতো। আমি যখন ঐ সমস্ত এলাকায় যাই, অনেক বয়স্ক লোকের সঙ্গে পরিচয় হয় যারা আব্বার ছোটবেলার কথা বলেন।”
১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের সময় বাবা কলকাতায় পড়াশোনা করেছেন। ‘আমার জন্মের সময় বাবা কলকাতায় পড়তেন, রাজনীতি করতেন। খবর পেয়েও দেখতে আসেন বেশ পরে।’
বড় মেয়ে হিসেবে বাবাকে বেশ কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। রাজনীতিতে তখন বঙ্গবন্ধুর ব্যস্ততা বাড়তে শুরু করেছে। বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্বে, চিন্তা-ভাবনায় হৃদয়বান মানুষের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে উঠত। ‘দাদির কাছে গল্প শুনেছি, যখন ছুটির সময় হতো তখন দাদি আমগাছের নিচে এসে দাঁড়াতেন। খোকা আসবে দূর থেকে রাস্তার ওপর নজর রাখতেন। একদিন দেখেন তাঁর খোকা গায়ের চাদর জড়িয়ে হেঁটে আসছে, পরনের পায়জামা-পাঞ্জাবি নেই। কী ব্যাপার, এক গরিব ছেলেকে তাঁর শত ছিন্ন কাপড়ে দেখে সব দিয়ে এসেছেন।’
ছোটবেলা থেকেই দান-দক্ষিণায় উদারহস্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু। শেখ হাসিনার লেখা থেকে এর প্রমাণ মেলে। পড়াশোনার পাশাপাশি সাধারণ ছাত্রদের প্রাপ্য অধিকার আদায়ের ব্যাপারে জোরালো ভূমিকাও রাখতেন তিনি। গোপালগঞ্জ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি এবং সেখান থেকে ১৯৪৬ সালে বিএ পাস করেন। এই সময় দেশভাগ হলে দাঙ্গা শুরু হয়। দাঙ্গা দমনে বঙ্গবন্ধু সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
দেশভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। তখন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন দেন ও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। সচিবালয়ে অবস্থান ধর্মঘটে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। ১৯৪৯ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্র সমাজের গড়ে ওঠা আন্দোলনে তিনি ছিলেন সোচ্চার। এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকার জন্য বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়।
এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা তাঁর পিতাকে নিয়ে একটি অসাধারণ মানবিক ঘটনার কথা উল্লেখ করছেন, ‘এই আন্দোলনে ১৯৪৯ সালে আমার আব্বা গ্রেফতার হন। আমি তখন খুবই ছোট্ট আর আমার ছোট ভাই কামাল কেবল জন্মগ্রহণ করেছে। আব্বা ওকে দেখারও সুযোগ পাননি। এক টানা ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তিনি বন্দী ছিলেন। সেই সময় আমাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে আমার মা দাদা-দাদির কাছেই থাকতেন। একবার একটা মামলা উপলক্ষে আব্বাকে গোপালগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়। কামাল তখন অল্প অল্প কথা বলা শিখেছে। কিন্তু আব্বাকে ও কখনও দেখেনি, চেনেও না। আমি যখন বার বার আব্বার কাছে ছুটে যাচ্ছি ‘আব্বা আব্বা’ বলে ডাকছি ও শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে। গোপালগঞ্জ থানায় একটা বড় পুকুর আছে, যার পাশে বড় খোলা মাঠ। ঐ মাঠে আমরা দুই ভাই-বোন খেলা করতাম ও ফড়িং ধরার জন্য ছুটে বেড়াতাম। আর মাঝে মাঝেই আব্বার কাছে ছুটে আসতাম। অনেক ফুল-পাতা কুড়িয়ে এনে থানার বারান্দায় কামালকে নিয়ে খেলতে বসেছি। ও হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “হাসুপা তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।” কামালের সেই কথা আজ যখন মনে পড়ে তখন চোখের পানি রাখতে পারি না। আজ ও নেই, আমাদের আব্বা বলে ডাকারও কেউ নেই।’
পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন বন্ধু বৎসল ছেলেমেয়েদের সঙ্গে যখন সময় কাটাতেন তখন তিনি যেন সত্যি সত্যি ‘ছোটদের’ মতোই হয়ে যেতেন। ছোটদের মতো মন খুলে সব কথা বলতেন বড় মেয়ের কাছে। রাজনীতিতে পুরোপুরি আচ্ছন্ন থেকেছেন।
শেখ হাসিনা লিখেছেন, “বাবার কাছাকাছি বেশি সময় কাটাতাম। তাঁর জীবনের ভবিষ্যত নিয়ে অনেক আলোচনা করার সুযোগ পেতাম। তাঁর একটা কথা আজ খুব বেশি করে মনে পড়ে। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘শেষ জীবনে আমি গ্রামে থাকব। তুই আমাকে দেখবি। আমি তোর কাছেই থাকব।’ “কথাগুলো আমার কানে এখনও বাজে।”
পিতার মতো কৈশোরে চঞ্চলতা, দুষ্টুমি শেখ হাসিনাকেও মাতিয়ে রাখত। পিতার কথা বলতে গিয়ে তিনি নিজের ফেলে আসা ছোটবেলার কথা নির্বিঘ্নে জানান দিচ্ছেন, “বৈশাখে কাঁচা আম পেড়ে কুচি কুচি করে কেটে সর্ষেবাটা ও কাঁচামরিচ মাখিয়ে, তারপর কলাপাতা কোনাকুনি করে সেই আমমাখা পুরে, তার রস টেনে খাওয়ার মজা ও স্বাদ আমাকে এখনও আপ্লুত করে রাখে। কলাপাতা এই আমমাখা পুরে যে না খেয়েছে। সে কিছুতেই এর স্বাদ বুঝবে না আর কলাপাতায় এ আমমাখা পুরলে তার ঘ্রাণই হতো অন্যরকম। এভাবে আম খাওয়া নিয়ে কত মারামারি করেছি। ডাল ঝাঁকিয়ে বরই পেড়ে কাড়াকাড়ি করে খেতাম। গ্রামের বড় তালাপের (পুকুর) পাড়ে ছিল বিরাট এক বরই গাছ। ঝাঁকুনির ফলে লালের আভা লাগা সব থেকে টলটলে বরইটা পুকুরের গভীর পানিতে গিয়ে পড়ত এবং কারও পক্ষে কিছুতেই সেটা যখন তুলে আনা সম্ভব হতো না তখন সেই বরইটার জন্য মনজুড়ে থাকা দুঃখটুকু এখনও ভুলতে পারলাম কই।”
‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বইটি পড়তে পড়তে পাঠকের মনে গভীর রেখাপাত তৈরি করবে। একজন আটপৌরে বাঙালী কী করে একজন দায়িত্ববান পিতা হয়ে উঠতে পারে এ বই তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)