চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

পাহাড়ে বৈসাবির আমেজ

মনসুর আহম্মেদ, রাঙ্গামাটি: পাহাড়ে এখন বৈসাবি উৎসবের আমেজ বইছে। পাহাড়িদের উৎসব হলেও বৈসাবি হয় সর্বজনীন। বৈসাবী উপলক্ষে রাঙ্গামাটিতে শুরু হয়েছে তিন দিনের বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক, বিহু, মেলা ।

পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার প্রধান ৩টি পাহাড়ি সমাজের বর্ষবরণ উৎসবের অাদ্যক্ষর নিয়ে সমন্বিত নাম “বৈসাবি”। কিন্তু এ উৎসবটি ত্রিপুরাদের কাছে বৈসুক বা বৈসু, মারমাদের কাছে সাংগ্রাই এবং চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে বিজু ও বিষু নামে উদযাপিত হয়ে থাকে। আলাদা নামে হলেও যা সমতলের মানুষের কাছে বৈসাবি উৎসব নামে পরিচিতি পেয়েছে।

বৃহস্পতিবার বিকেলে রাঙ্গামাটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির ইনষ্টিটিউট প্রাঙ্গণে মেলার উদ্বোধন করেন সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার। ৭ এপ্রিল পর্যন্ত মেলা চলবে।

মেলায় পাহাড়িদের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী কৃষ্টি ও সাংস্কৃতির পসরা সাজিয়ে ৩০টি ষ্টল বসেছে। তিন দিনের এই মেলায় পাহাড়ি শিশুদের চিত্রাংকন, আলোকচিত্র প্রদশর্নী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা পরিবেশনার আয়োজন রয়েছে।

বাংলা বছরের বিদায়ে চৈত্র সংক্রান্তিতে আগামী ১২ এপ্রিল পাহাড়ি জনগোষ্ঠির ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব বৈসাবি শুরু হবে।

বৈসাবী নামকরনও করা হয়েছে এই তিনটি উৎসবের এর প্রথম অক্ষর গুলো নিয়ে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর এ বর্ষবরণ উৎসব  খুব জাকজমকপূর্ণ ভাবে পালন করে পাহাড়ের মানুষেরা। এটি তাদের প্রধান সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোরও একটি।

পাহাড়ের সবচেয়ে বড় এই আয়োজনের রঙে রঙিন হয় পাহাড়-অঞ্চল। আমেজ ছড়িয়ে পড়ে দুর্গম পাহাড়েও। চৈত্রের শেষের আগের দিন তথা ১২ এপ্রিল বৈসাবিতে ফুল বিজু’র মাধ্যমে উৎসবের সূচনা হয়। ১৩ এপ্রিল চৈত্রের শেষ দিনে পাহাড়ের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে ভাসানো হয় ফুল। রঙিন বাহারি পোশাকে তরুণ-তরুণী ও শিশু কিশোররা বিজুফুল, মাধাবী লতা, অলকান্দ, জবা, নয়নতারাসহ বিচিত্র সব ফুল নদীতে ভাসায়।

বৈসাবির অন্যতম আর্কষণ পানি খেলা বা ‘জলকেলি উৎসব’। এ উৎসব মারমাদের। এ উৎসব হয় ১ বৈশাখ তথা ১৫ এপ্রিল থেকে। এ ছাড়া বর্ণাঢ্য র‌্যালি, গড়িয়া-নৃত্যসহ থাকে নানাসব খেলাধূলার আয়োজন। উৎসবের রং ছড়ায় পাহাড়ের দর্শণীয় এলাকাগুলোতে।

বিজু/ বিষু
চাকমা জনগোষ্ঠীর কাছে উৎসবের প্রথম দিন ‘ফুল বিজু’, দ্বিতীয় দিন ‘মূল বিজু’ এবং তৃতীয় দিন ‘গোজ্যাপোজ্যা’ নামে পরিচিত। চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাগণ এ উৎসবটি ৩দিন ধরে পালন করেন। এ ৩ দিন হল চৈত্রের শেষ ২দিন ও বৈশাখের প্রথম দিন।

এর মাঝে চৈত্রের শেষ দিনটি এই উৎসবের মূল আকর্ষণ। এ দিন ঘরে ঘরে পাঁচ প্রকারের সবজি দিয়ে বিশেষ খাদ্য পাঁচন রান্না হয়। সকলে বিশ্বাস করেন এই পাঁচনের দৈব গুণাবলী আগত বছরের অসুস্থতা ও দুর্ভাগ্য দূর করবে। এদিন বিকেলে খেলা হয় ঐতিহ্যবাহী খেলা ঘিলা, বৌচি ইত্যাদি। তরুণীরা পানিতে ফুল ভাসিয়ে দেয়। বিজু ও বিষু উৎসবের এই ৩ দিন কেউ কোনো জীবিত প্রাণী হত্যা করে না।

সাংগ্রাই
মারমারা উৎসবের প্রথম দুই দিনের নাম দিয়েছে ‘পাইং ছোয়াই’ ও ‘সাংগ্রাইং’। তৃতীয় দিন ‘সাংগ্রাইং আপ্যাইং (তাকখীং)’। তাকখীং হলো মারমা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। মারমারা বর্ষবরণের এই উৎসব কে পালন করেন সাংগ্রাই নামে। এ উৎসব চলে ৪দিন ধরে। মারমারা সবাই বুদ্ধ এর ছবি সহকারে নদীর তীরে যান এবং দুধ কিংবা চন্দন কাঠের জল দিয়ে এ ছবিটিকে স্নান করানো হয়।

মারমারা সেই আদিকাল থেকে অন্যান্য সম্প্রদায় থেকে ভিন্ন আঙ্গিকে পুরনো বছরের বিদায় এবং নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানাতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করে আসছে, যা মারমা ভাষায় সাংগ্রাই নামে পরিচিত।

সাংগ্রাইয়ে পানি উৎসবটি প্রতিটি এলাকাতেই কমবেশি জনপ্রিয়। এটিও বৈসাবী উৎসবেরই একটি অংশ। এ উৎসবে পাহাড়িরা সবাই সবার দিকে পানি ছুঁড়ে উল্লাসে মেতে ওঠেন যেন গত বছরের সকল দুঃখ, পাপ ধুয়ে যায়। এর আগে অনুষ্ঠিত হয় জলপূজা। এর মাধ্যমে পরস্পরের বন্ধন দৃঢ় হয়। তা ছাড়া মারমা যুবকরা তাদের পছন্দের মানুষটির গায়ে পানি ছিটানোর মাধ্যমে সবার সামনে আনন্দ প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে পরস্পরের বন্ধন দৃঢ় হয়।

বৈসুক
ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বৈসাবি উৎসবের নামগুলো হলো: হারি বৈসুক, বৈসুকমা ও বিসিকাতাল। নাম ভিন্ন হলেও উৎসবের রূপ অভিন্ন।

উৎসবের প্রথম দিনে পাহাড়ের ছেলেমেয়েরা খুব ভোরে উঠে ফুল সংগ্রহ করে আনে বিভিন্ন জায়গা থেকে। বাড়িঘর বিভিন্ন রকমের ফুল, পাতা দিয়ে সাজানো হয়। মূলত অতিথিকে বরণের জন্যই এই আয়োজন। পাহাড়িরা দল বেঁধে নদীতে স্নান করে। এ ছাড়া গৃহপালিত পশুপাখিদের খাবার দেয়া হয়। কিয়াঙে (বৌদ্ধবিহার) প্রদীপ প্রজ্বালন করা হয়। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যেমন- গান, কবিতা আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

ত্রিপুরাদের ভাষায় বৈসুক মানে নবজন্ম। তাদের মতে, এই দিনে ত্রিপুরা বর্ষপঞ্জিকা প্রবর্তিত হয়। পঞ্জিকাটি সৌরবর্ষ নামে পরিচিত। এই দিনে পৃথিবীতে দেবতাদের মহাদেব গরয়ার আগমন ঘটে বলে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস।ত্রিপুরারা বিশ্বাস করে, গরয়া দেবতার আশীর্বাদে শান্তি বিরাজ করে।

দ্বিতীয় দিনেই আয়োজিত হয় মূল উৎসব। খুব ভোরে উঠে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর নারীরা জুম থেকে তুলা সংগ্রহ করে। চালার পানিতে ঘিলা, কাঁচা হলুদ মিশিয়ে তৈরি করা হয় কোঁচা পানি। তারপর ঘরে ছিটানো হয়। এদিনে সবাই নতুন জামাকাপড় পরে। আয়োজন করা হয় ঐতিহ্যবাহী খেলা, যেমন- ডাংগুলি, গুদু ইত্যাদি। হরেক রকমের সবজির মিশ্রণে রান্না হয় পাজন বা পাজোন। পাজন শব্দটি মূলত চাকমা নৃগোষ্ঠীর। ৩০-৩২ রকমের ভিন্ন সবজি দিয়ে পাজন রান্নার চেষ্টা চলে। এই দিনে কমপক্ষে সাত বাড়িতে খাওয়ার প্রচলন আছে। চাকমাদের বিশ্বাস, এতে পারস্পরিক বন্ধন দৃঢ় হয়।

ত্রিপুরাদের কাছে এটি পাচন নামে পরিচিত। একসময় তারা ১০৮ রকম সবজি দিয়ে খাবারটি রান্না করত। সবজির এই মিশ্রণকে ঔষধি মনে করে তারা। যদিও এখন সব ধরনের সবজি সংগ্রহ করা কঠিন। তাই হাতের নাগালে যা পাওয়া যায়, সেগুলো নিয়েই রান্না হয় পাচন। এ ছাড়া খাদ্যের তালিকায় পায়েস, পিঠা, সেমাই ইত্যাদিও থাকে। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য তৈরি হয় বিশেষ পানীয়। ত্রিপুরাগণ শিবএর পূজা ও তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থণার মাধ্যমে এ দিবসটি পালন করেন।

পাচন
বৈসাবি উৎসবে রান্না হয় মূলত আদিবাসীদের প্রধান ও জনপ্রিয় খাবার পাচন এ খাবার সবার ঘরে রান্না হয়। এর পাশাপাশি নানা ধরনের পিঠা, সেমাই, বিভিন্ন ধরনের ফলমূল ও পানীয়ের আয়োজন করা হয়। সবজির বিশেষ পদটি রান্না হয় মূলত ২৫ থেকে ৩০ ধরনের সবজির সংমিশ্রণে।

উৎসবের এই তিন দিন চেনা-অচেনা সবার জন্য প্রত্যেকের গৃহ উন্মুক্ত থাকে। সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে আপ্যায়ন করা হয়। সব মিলিয়ে বৈসাবি পাহাড়ি জনপদের মিলনোৎসব।