দেশের প্রায় ৭০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ২৫ লাখের বেশী মানুষ হাজার বছর ধরে বংশপরম্পরায় ব্যবহার করছেন নিজস্ব মাতৃভাষা। পাশাপাশি বাঙালির সঙ্গে ভাব বিনিময়ে তারা ব্যবহার করেন বাংলা। সাম্প্রতিককালে রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস আদালতে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের উপস্থিতি চোখে পড়ে। সংখ্যায় তারা খুব কম। তবে বিষয়টা ইতিবাচক। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর তুলনায় তারা পিছিয়ে থাকছেন না। যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে মূল ধারায় যুক্ত হচ্ছেন। এদের অনেকে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজ নিজ ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করছেন। পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের দাবি অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তকে তাদের মাতৃভাষা যুক্ত হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা মাতৃভাষায় গ্রহণ করছে। প্রধান কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় তাদের ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। ভাষাগুলো হচ্ছে, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, গারো ও সাদ্রি। উত্তরবঙ্গের ওঁরাও, মুণ্ডা, মালো, মাহাতো, রাজোয়ার, তেলি, বাগদি, লহরা, কর্মকারসহ ১৫টি জনগোষ্ঠী সাদ্রি ভাষা ব্যবহার করে। বেসরকারি উদ্যোগেও চলছে নিজস্ব বর্ণমালায় চাকমা ও মারমা ভাষার প্রাথমিক বিদ্যালয়। এসব বিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি মাতৃভাষায় পড়ানো হয়। অন্যদিকে সাঁওতাল, গারো, ত্রিপুরা ও সাদ্রি- এই চার ভাষায় লিখিত চর্চা থাকলেও প্রাথমিক শিক্ষার জন্য নেই পর্যাপ্ত বই। এজন্য সরকারি উদ্যোগে এবং বুদ্ধিজীবীদের তত্ত্বাবধানে এই চারটি ভাষায় এখন পাঠ্যবই লেখার কাজ চলছে। বর্ণমালার বিতর্ক মীমাংসার অপেক্ষায় আছে সাঁওতালি ভাষা। আরো ইতিবাচক বিষয় হচ্ছে পার্বত্য অঞ্চলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা হয়েছে। সংরক্ষিত বন এলাকাও সম্প্রসারণ করা হয়েছে। কিন্তু এতোসব ভালো খবরের পরও সন্তুষ্ট নয় পাহাড়ী মানুষ। যদিও তাদের চাওয়া পূরণ করতেই ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে শান্তি চুক্তি হয়। চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ীদের সঙ্গে ৭০ দশক থেকে চলে আসা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান হয়। তবে পাহাড়ে রক্তপাত একেবারে বন্ধ হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির অভিযোগ—গত ১৯ বছরে চুক্তির একটি মৌলিক বিষয়ও বাস্তবায়িত হয়নি। দীর্ঘ ১৬ বছর সময় লাগিয়ে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনটি সংশোধন হয়েছে। কিন্তু সংশোধিত আইন প্রয়োগের জন্য বিধিমালা এখনো তৈরি করা হয়নি। আইন সংশোধনের পর ভূমি কমিশন কাজ শুরু করলেও তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমছেই। পাহাড়ীদের অভিযোগ হচ্ছে তাদের ভূমি দখল করে বসানো হয়েছে বিজিবি ক্যাম্প। তারা এটাকে সোজা ভাষায় ভূমি দখল বলছেন। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আইন প্রণয়ন করা হয়েছে এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে মনোনীত সদস্য সংখ্যা বাড়াতে আইন সংশোধন করা হয়েছে। পাহাড়ীরা এটাকে ইতিবাচক চোখে দেখছেন না। তাদের মতে আইন সংশোধনের মাধ্যমে পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোতে দলীয় নেতা-কর্মীদের পুনর্বাসন করা হবে। এটাকে তারা জেলা পরিষদ নির্বাচনকে বিলম্বিত করার চেষ্টা বলেও অভিযোগ করছেন। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন হয় না প্রায় ২৭ বছর। এসব অভিযোগ নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ ক্ষুব্ধ। দেশের বড় একটি জনগোষ্ঠীকে অসন্তুষ্ট রেখে সে অঞ্চলে শান্তি কামনা অবাস্তব। তাদের কথায় কান না দিলে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যে উদ্দেশ্য নিয়ে শান্তি চুক্তি করা হয়েছিল তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।