দেশের যেসব উপজেলায় সুপেয় বা মিষ্টি পানির সংকট সবচেয়ে বেশি, খুলনার দাকোপ উপজেলা এর মধ্যে অন্যতম। একটি পৌরসভা, ৯টি ইউনিয়ন আর ১০৬টি গ্রাম নিয়ে দাকোপ উপজেলা গঠিত। চালনা পৌরসভার সাথে ইউনিয়নের মধ্যে রয়েছে পানখালি, দাকোপ, লাউডোবা, কৈলাশগঞ্জ, সুতারখালি, কামারখালি, তিলডাঙ্গা, বাজুয়া এবং বাণীশান্তা। নদ-নদীবেষ্টিত দাকোপের মোট জনসংখ্যা দুই লক্ষের কাছাকাছি। খুলনা সদর থেকে বটিয়াঘাটা উপজেলা পাড়ি দিয়ে দাকোপে যেতে হয়। পশুর, ভদ্রা, রুপসা, ঝপঝপিয়া এই উপজেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত অন্যতম নদী।
পুরো দাকোপেই মিষ্টি বা সুপেয় পানির সংকট। সমুদ্রের নিকটবর্তী হওয়ার কারণে পানিতে লবণাক্তের হার অনেক বেশি। কোথাও কোথাও আবার আর্সেনিকের মাত্রাও বেশি। নদ-নদী-পুকুর, সাধারণ টিউবওয়েলের পানি তাই খাবার অযোগ্য। সুপেয় পানির জন্য তাই প্রধান ভরসা বৃষ্টির পানি। রেইন হার্ভেস্টিং পদ্ধতিতে পানি ধরে রাখা হয়। এর বাইরে স্থানীয় জনসাধারণের দূরদূরান্তের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ওয়াটার পয়েন্ট থেকে থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়।
জীবনব্যাপী এই সংগ্রামের যেন শেষ নেই। এক কলস পানির জন্য দাকোপবাসীর যে কতোটা লড়াই করতে হয় তা সরেজমিনে বাস্তবতা না দেখলে বোঝা দায়। দাকোপের ১ নং পানখালি ইউনিয়নের লক্ষীখোলা গ্রামের দরিদ্র পরিবারের গৃহবধূ আম্বিয়া খাতুনের সুপেয় পানির লড়াই এর গল্পটা একটু শোনা যাক। কদিন আগে ওয়ার্ল্ডভিশন-এর সৌজন্যে দাকোপের পানখালি ইউনিয়নের লক্ষীখোলা গ্রামে আম্বিয়া খাতুনের মায়াময় উঠানে বসে তার সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। গৃহবধূ আম্বিয়া বসে বলেছিলেন, ‘সারা বছরই সুপেয় বা মিষ্টি পানির জন্য আমাদের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়।
এই পানি না পেলে আমাদের জীবন বাঁচানো কষ্ট। এখানে টিওবওয়েল, পুকুর, নদীর পানি খাওয়া যায় না। মাটির নিচে যে পানি আছে তাতে লবণ, আর্সেনিক বেশি। বৃষ্টির পানিই তাই বিকল্প। বৃষ্টি এলেই পানি ধরে রাখতে হয়। সেই পানি বিশেষ কৌশলে মাটির কোলা বা ট্যাংকে সংরক্ষণ করি। এভাবে আমাদের খাবার পানির চাহিদা পূরণ করতে হয়।’ আসলে যেসব এলাকাতে সরাসরি টিউবওয়েল থেকে পানি তোলার ব্যবস্থা আছে সেই সব এলাকার মানুষের পক্ষে এই কষ্ট বোঝা অসম্ভব।
পানির জন্যে সত্যিই এই এলাকার মানুষের কতো না কষ্ট করতে হয়। সেই কষ্ট আর পানির লড়াই-এর আরও গল্প শোনালেন আরেক গৃহবধূ মনিরা বেগম। মনিরার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল উঠানে বড় বড় মাটির কোলা বা মটকাতে বিশেষ ব্যবস্থায় পানি সংরক্ষণ করা। বৃষ্টির পানি তিনি ধরে রেখেছেন। তৃষ্ণা মেটাতে এই পানিই ভরসা। প্রতিটি মটকার মুখ সাদা কাপড় মুড়িয়ে দেওয়া। এর উপর আবার ঢাকনা দেওয়া দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।
মনিরা বেগম জানান, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে অনেক সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। নইলে সংরক্ষিত পানি পানের অযোগ্য হয়ে পড়ে। বললেন, মটকার মুখ খোলা থাকলে বা ফাঁক-ফোঁকর থাকলে অনেক সময় মশাসহ অন্যান্য কীটপতঙ্গ ঢুকে পড়ে। ঐসব কীটপতঙ্গ পানিতে আবার দ্রুত ডিম পাড়ে। ডিম পাড়লে পানি আর খাওয়ার মতো থাকে না, নষ্ট হয়ে যায়।
গৃহবধূ মনিরা আরও বলেন, এখানে প্রতি বাড়িতে পানি ধরে রাখার জন্য বিশেষ চালের ব্যবস্থা আছে। এটিই ‘হাভেস্টিং সিস্টেম’। সেরকারি বেসরকারি সংগঠনের কর্মকর্তারা হাভেস্টিং পদ্ধতি শিখিয়েছেন। প্রথমে বৃষ্টি এলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। এতে বৃষ্টিতে চালটা ভালো করে ধুয়ে যায়। এরপর পানি বেয়ে বেয়ে হাড়ি বা নির্দিষ্ট পাত্রে জমা হয়। এভাবেই বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হয়।
দাকোপে পানির লড়াইটা যেন অনন্তকালের এক যুদ্ধ। বাড়ির গৃহবধু, শিশুদের অনেক দূর-দূরান্ত যেতে হয় পানি সংগ্রহ করতে। জীবন-জীবিকার সাথে সুপেয় পানির নিরন্তর এই লড়াই-এর কষ্ট বর্ণনাতীত। এই লড়াই-এ সরকারের পাশাপাশি কাজ করছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়ন সংস্থা। এর মধ্যে অন্যতম আমেরিকান সরকারের আন্তর্জাতিক সংস্থা- ইউএসএআইডি’এর অর্থায়নে পরিচালিত ওয়ার্ল্ডভিশন-এর ‘নবযাত্রা’ প্রকল্পের কথা একটু আলাদা করে বলতে হয়। লক্ষীখোলা গ্রামের গৃহবধূ আম্বিয়া এবং মনিরা দুজনই ‘নবযাত্রা’ প্রকল্পের সক্রিয় সদস্য। এই প্রকল্পের সদস্য হিসেবে তারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা আরা দারিদ্র্য জয়ের জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। এই প্রকল্পের আওতায় ‘ওয়াশ’ নামে কার্যক্রম রয়েছে। এই কার্যক্রমের উদ্দেশ্য হলো- নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও স্বাস্থ্য বিধির চর্চা।
লক্ষীখোলা গ্রামের এ প্রান্ত ও প্রান্ত ঘুরে দেখা যায়, ওয়ার্ল্ড ভিশন এর নবযাত্রা প্রকল্পের কর্মীরা উঠান বৈঠকে বসে দরিদ্র মানুষদের নিরাপদ পানির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও সমাধান নিয়ে কথা বলেছেন। লোকায়ত জ্ঞান আর আধুনিক কলাকৌশল-এর কথা মানুষকে বোঝানো হচ্ছে। গ্রামের নারীরা দীর্ঘদিন ধরে প্রকল্পের সাথে থাকার কারণে তারা সুপেয় পানির চাহিদা সহজলভ্য বিষয়ে অনেক কিছু জেনেছেন, বুঝতে পেরেছেন। তাদেও আচারণেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। আম্বিয়া খাতুন জানান, তার বাড়িতে কখনই পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু এখন হয়েছে। তার বাড়িতে নিরাপদ ল্যাট্রিন স্থাপন করা হয়েছে প্রকল্পের সহায়তায়। আম্বিয়া খাতুন এমন একটা ল্যাট্রিন পেয়ে বেশ খুশি।
শুধু ইউএসএআইডি-এর অর্থায়নে পরিচালিত ওয়ার্ল্ডভিশন-এর ‘নবযাত্রা’ প্রকল্প নয়, ওয়াটার এইডসহ আরও কিছু উন্নয়ন সহযোগী মানুষের জন্য নিরাপদ পানি প্রাপ্তি সহজলভ্য করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক জায়গাতে তাই সোলার সিস্টেম পদ্ধতিতেও ‘ওয়াটার পয়েন্ট’ তৈরি করা হয়েছে। যেখানে নামমাত্র মূল্যে পানি কিনতে পাওয়া যায়। পাড়ায় পাড়ায় আবার ওয়াটসন কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা সবাই মিটিংএ বসেন। আলাপ-আলোচনা করে করণীয় ঠিক করেন।
ওয়ার্ল্ড ভিশন সূত্রে জানা গেছে, ‘নবযাত্রা’ প্রকল্পের কর্মএলাকায় এ পর্যন্ত ১ লক্ষ ৪৮ হাজার ৬৬ জন অধিবাসীর সুপেয় পানি প্রাপ্তিতে অভিগম্যতা তৈরি হয়েছে। কর্মএলাকায় ৪০০ ডিপটিউবওয়েল, ১৯১টি পন্ড স্যান্ডস ফিল্টার (পিএসএফ), ১৭টি সোলার পন্ড স্যান্ডস ফিল্টার, ২,৬৭২টি রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং সিস্টেম, ২টি কমিউনিটি রেইন হারভেস্টিং সিস্টেম, ১০টি রিভারস ওসমোসিস, ২৭টি আর্সেনিক আইরন রিমুভাল প্ল্যান্ট তৈরি করা হয়েছে।
ওয়ার্ল্ড ভিশন, খুলনা আঞ্চলিক অফিসের ওয়াস টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার হিসেবে কর্মরত মো. আয়েতুল্লাহ আল মামুন বলেন, সুপেয় পানি সংকট মেটাতে ওয়ার্ল্ডভিশন এর এই উদ্যোগগুলো দরিদ্র পরিবারগুলোর সুপেয় পানির সংকট মেটাতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে।
সুপেয় পানির সংকট নিয়ে কথা হয় দাকোপ উপজেলার জনস্বাস্থ্য বিভাগের উপসহকারি প্রকৌশলী মো. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ-এর সাথে। তিনি বলেন, দাকোপে মিষ্টি পানির সংকটটা খুবই তীব্র। এই এলাকার অন্যতম তিনটি চাহিদার একটি হলো- সুপেয় পানি। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের নানা উদ্যোগ দিয়ে এই সমস্যা নিরসনে সবাই কাজ করছে।
তিনি বলেন, এখানে পানিতে লবণ এবং আর্সেনিক দুটোই বেশি। স্যালো টিউবওয়েল, ডিপটিউবওয়েল- এর পানিও পান করা যায় না। এখানে তাই রেইন হার্ভেস্টিং-ই মূল ভরসা। বেশি বৃষ্টিপাত হলে এই এলাকার মানুষের জন্য সেটা মঙ্গলময়। কিন্তু বৃষ্টি কম হলে সুপেয় পানির সংকট আরও বেড়ে যায়। তিনি বলেন, সুপেয় পানির সংকট মোকাবিলায় নানান আধুনিক পদ্ধতি ও কৌশল কাজে লাগানো হচ্ছে। বর্তমানে ওয়াটার ডি-স্লাইনেশন প্ল্যান্টও স্থাপন করা হয়েছে।
দাকোপের পানখালির লক্ষীখোলা গ্রামের যে পানির লড়াই এর গল্প এখানে তুলে ধরা হলো সেটা প্রতীকী মাত্র। আসলে পুরো দাকোপ জুড়েই এই অসহায়ত্ব বিদ্যমান। আসলে সেই গানের মতো ‘আমার হাতের কাছে ভরা কলস তৃষ্ণা মেটে না’। চরম সত্য হলো এখানে নদীতে, খালে, পুকুরে পানি থাকলেও তাতে তৃষ্ণা মেটানো যায় না। সব উৎসেই রয়েছে লবণ আর আর্সেনিক-এর সমস্যা। যে পানি পান করলে মানবদেহে তৈরি হয় ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। নীতি-নির্ধারকদের উচিত এ বিষয়টি নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাবা। একই সাথে সুপেয় পানির এই সংকট সমাধানে সরকারের উচিত জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)