মেহেদী উল্লাহ। কথাসাহিত্যিক। ২০১৩ সালে ‘তিরোধানের মুসাবিদা’ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপির জন্য পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথা সাহিত্য পুরস্কার। তারপর প্রকাশ হয়েছে আরও তিনটি গল্পের বই। ‘রিসতা’, ‘ফারিয়া মুরগির বাচ্চা গলা টিপে টিপে মারে’ ও ‘জ্বাজ্জলিমান জুদা’। প্রতিটিই আলোচিত হয়েছে পাঠক ও বোদ্ধা মহলে। প্রথম উপন্যাস ‘গোসলের পুকুরসমূহ’ এইবার একুশের বই মেলায়। পুকুরকে উপলক্ষ্য করে তিনি হাজির করেছেন বাংলাদেশকেই! প্রতিটি অধ্যায়ে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের উপস্থিতি। এখানকার মানুষ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ইতিহাস, মিথ, কিংবদন্তি, পুরাণ, শিক্ষাব্যবস্থা, খেলা, বন্যা, স্বপ্ন, খোয়াব, আচার, উন্নয়ন, যোগাযোগ ইত্যাদি। সবমিলিয়ে আলাদা আলাদা তাৎপর্যবাহী ন্যারেশন হাজির করেছেন তিনি। তার সাথে চ্যানেল আই অনলাইনের কথা হল তার লেখালেখি ছাড়াও বিভিন্ন প্রসঙ্গে:
আপনার প্রথম উপন্যাস এলো। অভিনন্দন দিয়েই আলাপ শুরু করা যাক।
ধন্যবাদ আপনাকে। আলাপে স্বাগত!
আপনি ২০১৩ সালে জেমকন পুরস্কার পেলেন। সেই সূত্রে ইয়ংদের মধ্যে আপনি একধরণের আলোচনায় আছেন গত বছর পাঁচ ধরেই। তো প্রথম বইয়ের পুরস্কার যে দায় তৈরি করলো, তা আপনার মধ্যে কেমন চাপ তৈরি করেছিল? কাটাতে পেরেছেন?
পুরস্কার কেন্দ্রিক অনেক রাজনীতি আছে এখানে। আমার ভাগ্য ভালো সেসব বোঝবার আগেই, নিষ্পাপ অবস্থায় পেয়েছিলাম। এখন হলে হয়তো পেতাম না। মানে, দেওয়াই হতো না। পুরস্কারের মোহ পেয়ে বসেছে হাজারে হাজার! তারা বিভিন্ন দিক থেকে ক্ষমতাবান। নিজেরাই নিজেদের তোষামোদ করে। বইয়ের বিচার করে। আমি দূরে থেকে টের পাচ্ছি। পুরস্কার কোনো চাপ তৈরি করেনি। ‘তিরোধানের মুসাবিদা’ আমার প্রথম বই, গল্পের। ফলে গদ্য অনেক কাঁচা, একাডেমিক, গতানুগতিক হওয়ার কারণে ওটা হয়তো পুরস্কার পেয়েছে। দ্বিতীয় বই ‘রিসতা’য় আমি বদলেছি গদ্য। এরপরের বইগুলোতে আরো। এখানে যে সিস্টেম, আমি বরং একটু চাপ দিলে এখন বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেতে পারি কথাসাহিত্যে। কিন্তু একজন গরীব ও মেধাবি লেখক হিসাবে এটা নৈতিকভাবেই আমি পারি না। করব না। আমার লক্ষ বিদেশে বাংলা সাহিত্যকে পৌঁছে দেওয়া। যেটার ঘাটতি আছে।
আপনার প্ল্যান কি বিদেশে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে? আমরা ‘বাংলা ভাষা-বিশ্বের’ বাইরে কেমন করে পৌঁছুতে পারি?
প্ল্যান আছে। পরে প্রকাশ করব। ‘ফারিয়া মুরগির বাচ্চা গলা টিপে টিপে মারে’ গল্পের বইটা দেশে নন্দিত-নিন্দিত, ব্যাপকভাবে। নামটা নিতে পারেন নি অধিকাংশ পাঠক। কিন্তু এটা নিয়ে তাঁদের কৌতূহল আমাকে অবাক করে। বইটার ইংরেজির আয়োজন চলছে। কথা হচ্ছে বাইরের প্রকাশকের সঙ্গে। এটাই আমার এখন পর্যন্ত গল্পে সেরা কাজ।
ধরেন আফ্রিকা বা ল্যাটিন আমেরিকা যে ভাষায় লেখছে তার বহুদেশিয় ব্যাপ্তি আছে। আবার ওরা তাত্ত্বিক ভাবেও এগুচ্ছে। যেমন কলোনি প্রশ্নে। আবার দেখেন, তাদের অনেকেই ইউরোপে পড়ায় যেমন নোগোগি ওয়া থিয়োঙ্গো । এমন জায়গা থেকে পরিচয়হীন আমরা অনেকটা। ‘ফারিয়া মুরগির বাচ্চা গলা টিপে টিপে মারে’ না শুধু, বাঙলা থেকে যাই অনূদিত হোক, ওরা কেন নেবে? কেমন করে নিবে?
এটা আপনি ঠিক বলেছেন। আফ্রিকার বহু আগেই কলোনি প্রশ্নে নজরুল উচ্চকণ্ঠের ছিলেন, নজরুল এখনো পৌঁছুতে পারেননি সেভাবে। চিনুয়া আচিবেকে অনেক ফাইট দিতে হয়েছে পৌঁছাতে। তাঁর পাণ্ডুলিপি তারা অবহেলায় হারিয়ে ফেলেছিলেন। এরপর আচিবের এক শিক্ষকের মাধ্যমে সেটা প্রকাশিত হয়েছিল ‘থিংস ফল এপার্ট’। নয়া উপনিবেশের সাথেও এখন ফাইট দিতে হচ্ছে আমাদের। ওরা যে দৃষ্টিতে আমাদের দেখতে চায় এখনো আমরা তাই। এই সমস্যা নিজ দেশেই আছে। গত ত্রিশ-চল্লিশ বছরে দেশেই এমন এমন লেখককে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, ফিগার বানানো হয়েছে যাঁদের সাহিত্য পড়া মানে সময় নষ্ট! দেশে আলোচিতদের ইউরোপ পড়ে দেখে, হতাশ হয়, এদের দিয়েই সাহিত্য মাপে। ভাবে, অচল সাহিত্য হচ্ছে বাংলাদেশে। ফলে নয়া উপনিবেশ নিজ দেশেও মোকাবেলা করতে হচ্ছে। থিম অনেক বড় ব্যাপার। ‘গল্প কি দুধভাত’ প্রবন্ধে এসব নিয়ে আমি বলেছি। কীভাবে গল্পের বৈশ্বিক সংশ্লিষ্টতা তৈরি হয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ সফল গল্প যেগুলোকে ধরা হয়, আপনি দেখবেন সেগুলো গ্রাম ও শহরের ফাও বর্ণনা। এগুলোর স্থানিক প্রতিবেশ থাকলেও বৈশ্বিক কোনো কানেকশন নেই চিন্তার দিক থেকে। লেখায় একটা না একটা মিনিমাম বৈশ্বিক কানেকশন দরকার হয়। যেটা অনেক বেশি আইডিয়াগত ব্যাপার। প্লট স্থানিক হতে পারে। আমাদের সাহিত্যে তা নাই।
আমার মনে হয়েছে আপনি ‘ফারিয়া মুরগির বাচ্চা গলা টিপে টিপে মারে’তে ভাষার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সমসাময়িক হয়েছেন, মেট্রোপলিটন অনেকটা। কিছুটা লুসিড। গল্পের কনটেন্ট আগের দুইটার তুলনায় ‘হালকা’। কিন্তু আপনি এটাকে সেরা কাজ বলছেন। কেন? বৈশ্বিক পরিসরে এটাকে কেন প্রতিনিধি করতে চান, নিজের কাজ হিসেবে?
কনটেন্ট আগের তুলনায় হালকা-আমি কনফিউজড হয়ে গেলাম। এই বইয়ের কনটেন্টগুলো দেখেন, ব্রেকাপের ব্যাকাপ গল্পে ব্রেকাপের যে উদযাপন, উদ্দীপনা আর মূল্যবোধ সেটা একালের প্রেমের রীতি অথচ এখনো দেখবেন এক শ্রেণির লেখক ‘রাধা’র বিরহকেই ব্রেকাপের স্ট্যান্ডার্ড ধরেন। প্রতিষ্ঠিত লেখকদের কথাই বলছি, যারা সাহিত্য করেই খান। নামগল্প ‘ফারিয়া মুরগির বাচ্চা গলা টিপে টিপে মারে’। এই গল্পে দেখানো হয়েছে, সে কেন মারে সেই প্রশ্নটাই তাকে করার সাহস পাচ্ছে না তার প্রেমিক আমির। তার সাহস নাই। অর্থাৎ, কর্তৃপক্ষ যেন প্রশ্নের উর্ধ্বে। পুরো দুনিয়ার একই অবস্থা। চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি, কিন্তু নো কোশ্চেন! বাংলাদেশে রোহিংগা পাঠিয়ে দিল লাখে লাখে মিয়ানমার। তাদের কেউ প্রশ্ন করেছে? উল্টো বাংলাদেশ যেন আশ্রয় দেয় সেই ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। ইসরাইলকে জাতিসংঘ বা অন্য মোড়ল কয়বার প্রশ্ন করেছে, কেন দখলদারিত্ব তাদের? ট্রাম্প বা মোদীর গন্তব্য কোনদিকে? কেউ প্রশ্ন করছে? অথবা এখানে যা যা, কেউ প্রশ্ন করছে? লেখক হিসাবে আমিও পারছি না। এছাড়া নাম নেওয়া যেতে পারে, ‘ভুতের বাড়ির নির্মাণ কৌশল’ গল্পের। আসলে প্রতিটি গল্পই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের, কনটেন্টও, তবে প্লট ও প্রতিবেশ দেশের।
আপনি বয়ান ভঙ্গিতে সহজ হয়েছেন। আর বইটাও আপনার কথায় ‘অসিরিয়াস’। তবে আপনি যেভাবে রিলেট করলেন, এটা ভালো লাগলো। আপনার উপন্যাস নিয়ে কথা বলতে চাই। তার আগে আসলে গল্প নিয়ে আরও একটু শুনতে চাই। যেমন, আমি আবার ভাষার প্রসঙ্গ ধরে এগুই, আপনার ‘তিরোধানের মুসাবিদা’ ও ‘রিসতা’র তুলনায় ‘ফারিয়া মুরগির বাচ্চা গলা টিপে টিপে মারে’তে ভাষা সহজ হয়েছে। মানে কম একাডেমিক। এই দিকে কেন টার্ন করলেন? ‘তিরোধানের মুসাবিদা’ থেকে থেকে ‘জ্বাজ্জলিমান জুদা’- এই জার্নিটা নিয়ে বলুন…
আমি মুখের ভাষার কাছাকাছি থাকতে চেয়েছি। যা অধিক জীবন্ত। গল্পগুলো বেশিরভাগই শহরের প্রতিবেশের। ফলে সে শহরের মানুষ যেভাবে কথা বলে এসেন্স ক্রিয়েট করে তাই ধরতে চেয়েছি। এছাড়া গল্পের প্রতিবেশ যে ভাষা কাঠামো দাবি করেছে সে অনুযায়ী ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। ‘অসিরিয়াস’ বলেছি উত্তরাধুনিক অর্থে। যার বহু মিনিং ও সত্য তৈরির সুযোগ ও স্বাধীনতা পাঠকের রয়েছে। সে কারণে আমি এগুলো নিয়ে সিরিয়াস না। কোনো কেন্দ্র গড়তে চাই নি। বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে জনে জনে। সেজন্য বলেছি, পাঠক সিরিয়াস হলে হতে পারে। দশের দশ রকমের সিরিয়াসনেস আমাকে একক সিরিয়াসনেসে পৌঁছাতে দেয় না।
আচ্ছা! ভালো কথা, আপনার গদ্যের ভাষা আর মুখের ভাষা আমার কাছে বেশ কাছাকাছি মনে হয়। আপনি মুখের ভাষা ও গদ্যের ভাষার এই সম্পর্কটা কেমন করে স্থাপন করেছেন বা কখন থেকে এই বিষয়ে সচেতন হয়েছেন?
‘তিরোধানের মুসাবিদা’র গল্পগুলো মৃত্যু বিষয়ক। এই বইয়ে আমি মৃত্যু থেকে জীবনের দিকে রওনা দিয়েছি, যে জীবন পূর্ববাংলার, বাংলাদেশের। এখানকার চর্চিত সংস্কৃতির কথা স্পষ্ট করে বলতে চেয়েছি। বাংলাদেশ তো আলাদা, না? ফলে সেই বাংলাদেশ। ‘রিসতা’ বইয়ে মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশের মানুষের সম্পর্ককে বুঝতে চেয়েছি, যা কোনো ভাবেই ইসলাম বনাম সেক্যুলার না, ইসলাম বনাম গণজাগরণ না, ইসলাম বনাম ইত্যাদি না। ‘জ্বাজ্জলিমান জুদা’র গল্পগুলো কম শব্দের। আমি ম্যাচবক্সে মসলিন শাড়ি রাখতে চেয়েছি। এই ব্যাখ্যা অবশ্য আমার কবি বন্ধু তানিম কবিরের।
এই বিষয়ে কয়েক বছর আগে ফার্মগেটে বসে কথা হচ্ছিল কথাসাহিত্যিক মাহবুব মোর্শেদের সাথে। আমাদের আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি বললেন, ‘সৈয়দ হকের উল্টোটা হবে। ভাষা লেখকের ব্যক্তিত্ব। লেখক যে ভাষায় কথা বলেন সেভাবেই লেখা উচিত।’ তাঁর পরামর্শ আমার মনে ধরেছে। এটা আমারও ভাবনা, তবে তাঁর মত স্পষ্ট করে ভাবতে পারি নাই সেসময়।
গত বইটা আপনার খুবই ছোট ছোট গল্পের। ইচ্ছা করে আমি অনুগল্প শব্দটা এড়ালাম। প্রশ্ন হচ্ছে, এমন ছোট গল্প থেকে উপন্যাসে এলেন। অনেকটা উল্লম্ফন। যদিও আপনার আগের বইগুলো একজন ভাবী ঔপন্যাসিকে পরিচয় করায়। তো আপনি যে প্রসঙ্গগুলো তুললেন, মানে ইসলাম বনাম সেক্যুলার না, ইসলাম বনাম গণজাগরণ না ইত্যাদি বিষয় আপনার উপন্যাসে এসেছে। এই সূত্র ধরেই আমরা উপন্যাসে ঢুকতে পারি। উপন্যাসটা নিয়ে বলুন…
এই উপন্যাসে আমি বাংলাদেশকে হাজির করেছি। নানা দিককার বাংলাদেশ। পুকুর উপলক্ষ মাত্র! আমার অনুলক্ষ্য প্রেম আর লক্ষ্য বাংলাদেশ। প্রতিটি অধ্যায়ে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের উপস্থিতি। এখানকার মানুষ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ইতিহাস, মিথ, কিংবদন্তি, পুরাণ, শিক্ষাব্যবস্থা, খেলা, বন্যা, স্বপ্ন, খোয়াব, আচার, উন্নয়ন, যোগাযোগ ইত্যাদি। সবমিলিয়ে আলাদা আলাদা তাৎপর্যবাহী ন্যারেশন। এটি আমার প্রথম উপন্যাস। তাই ব্যাপারগুলো বিস্তৃত। উপন্যাসের কথকের সন্তান পৃথিবীতে মাত্র একঘণ্টার আয়ু নিয়ে এসেছে, এরপর মারা গেল তার স্ত্রী। কথক ফিরে যায় তার স্মৃতিমুখর জীবনে। যে স্মৃতি সে স্মরণ করতে পারে তার গোসলের পুকুরসমূহের সাহায্যে। এই উপন্যাসে কোনো সময়কালের ব্যবহার নেই। বার বার সালের প্রসঙ্গ এলে বলা হচ্ছে, ‘অনেক বছর আগে’। ফলে পুকুরই সময়। এটা জাস্ট একটা আইডিয়া। কিন্তু বলতে চেয়েছি বাংলাদেশ, যা কেউ বলেনি। পাঠক পড়লেই বুঝতে পারবেন, ধরতে পারবেন আমি নতুন কী কী বিষয় বয়ানে এনেছি। আমি বলতে চাই না, পাঠক পড়ুক, ব্যাখ্যা দিক নিজের মত। আমি শুধু বলব, এই গোসল বাংলাদেশের নানা সংকট, সম্ভাবনার নিমজ্জন, এই পুকুর বাংলাদেশের ইতিহাসের আধার। জীবনের নানা নন্দন! আপনি উপন্যাসটি পড়তে শুরু করেছেন ইতোমধ্যে, আপনার কেমন লাগছে সেটা শুনি। বলুন!
আমি আসলে শেষ করেছি পড়ে। কনটেন্ট হিসেবে আপনার উপন্যাসটা পড়ার পর আমার অভিনব মনে হয়েছে, আপনি পুকুরকে মেটাফর হিসেবে নিয়েছেন, মাছকে, সময়, ঘড়ি… স্মৃতির ভেতর থেকে বর্ণনা, সময়কে ভেঙে দিয়ে। আপাতত এক কথায় ভালো লেগেছেতে থেমে আপনার কথাই শুনতে চাই। উপন্যাসে লোক-মিথগুলো ভালো মতো ব্যবহার হয়েছে, এটা আমাদের গল্পে নতুন না। মনসা বা বেহুলার কথা ইত্যাদি। কিন্তু আমার চোখে যে জিনিসটা পড়েছে সেটা হল আমাদের ‘কনটেম্পোরারি মিথ’! যেমন বয়স্ক মানুষ, মানুষের মাথায় গজানো শিং, কিংবা অমর ভারতির প্রসঙ্গ… এসব গল্প উপন্যাসে ব্যবহার হয় না প্রায়। পত্রিকায় ‘চিত্র-বিচিত্র’ ইত্যাদি নিউজে ছাপে। আপনি এসবকে আনার পেছনে কী প্রেরণাবোধ করেছেন?
এসব আসলে গল্পের প্রয়োজনেই এসেছে। এরা পৃথিবীর বেশি আয়ুপ্রাপ্ত মানুষ, যারা নানা কারণে অদ্ভুত। আপনি ‘ইচ্ছামৃত্যু হবে তুমি’ অধ্যায়ের কথা তুললেন বোধয়। এই অধ্যায়ের শুরুতে আমি মহাভারত থেকে উদ্ধৃত করেছি। রাজা শান্তনু ভীষ্মকে ইচ্ছামৃত্যু বরদান করেন। এই অধ্যায়ে আমি এদেশের মানুষের বেঁচে থাকার ইচ্ছার প্রসঙ্গ এনেছি। কচ্ছপের খোলে ভাত খেলে আয়ু বাড়ে, কিংবা পুকুরে কচ্ছপ ভেসে উঠতে দেখলে মারা যায় এসব আমার নিজের তৈরি করা বিশ্বাস। যা আমি চালিয়ে দিয়েছি তাদের উপর। কিন্তু এখানে আয়ুপ্রাপ্ত হওয়ার ব্যাপারটি প্রাকৃতিক নয়, মনুষ্যকৃত! একজনের বেঁচে থাকা আরেকজনের বেঁচে থাকার কারণ। বৃদ্ধা কচ্ছপের খোলে ভাত খেয়ে আয়ু বাড়াচ্ছে, সে নিঁখোজ পুত্রের অপেক্ষারত, অন্যদিকে হামজা মিয়া জানেই না, যে কচ্ছপের ভেসে উঠার অপেক্ষায় সে পুকুরঘাটে অপেক্ষা করছে সেটি ওই বৃদ্ধা অনেক বছর আগেই ধরে নিয়ে গেছে। এভাবেই মানুষের মানুষের বেঁচে থাকার কারণ। এটা সম্ভাবনা পৃথিবীর! অজান্তেই কারণ।
দুইটা প্রসঙ্গে আপনাকে আমার কম সাহসী মনে হয়েছে। একটা পদ্মা মেঘনা যমুনা রূপে বাংলাদেশ প্রশ্নে। আর এতিমখানার ইলম অংশে গুম হওয়া প্রশ্নে। আর একটু খোলামেলা হওয়া যেতো কি? একই প্রসঙ্গে বলি, আসলে লেখক হিসেবে আপনি কতটা স্বাধীন? কতটা লেখেন বা লেখতে পারেন?
আমি এই উপন্যাসের লেখক, কিন্তু আমাকে এটাও মাথায় রাখতে হয় আমি একটা দেশের নাগরিক। যে এই দেশকে ভালোবেসে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বাইরের হাতছানিগুলোকে বার বা ফিরিয়ে দিয়েছে। আমি আমার সময়কেই লিখেছে। লেখক হিসেবে এত বড় নই যে দেশের সময়কে কেটে ছোট করে ফেলব! বরং যা, সেটা তাই! আমি দেশকে ভালোবাসি। আমার কোনো বাড়াবাড়ি রকমের সংবেদনাশীলতার প্রভাব দেশের প্রজন্মের উপর পড়ুক তা আমি চাই না। উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের বন্ধু গুম হয়েছে। সে তার বন্ধুর নাম মুখে না নিয়ে বার বার বলছে জনৈক। বন্ধুর নামই রেখেছে ‘জনৈক’। এটা তার অস্তিত্বের সংকট। এভাবেই চরিত্রটির বিস্তার। লেখকের সাহস দেখানোর কিছু নাই এখানে। লেখক সমকালকে লেখেন মাত্র।
আলাপ গোটানো যাক। ভবিষ্যতে লম্বা আলাপের ইচ্ছা রইলো। আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলুন… আপনার ও উপন্যাসটার সাফল্য কামনা করি…
ধন্যবাদ আপনাকে। মধ্যরাতে ঘুম বিসর্জন দিয়ে সাহিত্য করার এবং করিয়ে নেওয়ার জন্য। আমি লিখব এটাই চূড়ান্ত। ভবিষ্যতে সিনেমা বানাব, এটা এক্সট্রা। গোসলের পুকুরসমূহ পাঠক পড়ুক। পড়লে ভালো লাগবে। পাঠকের সঙ্গে আমার বাজারে নয়, লাইব্রেরিতে দেখা হোক।