ডাচ ঘরানার রোমান্টিক, দৃষ্টিনন্দন ফুটবল দর্শনকে বিদায়। বাংলাদেশের ফুটবল এবার ইতালির রক্ষণাত্মক ফুটবল পরম্পরার মনোযোগী অনুসারী। অস্ট্রেলিয়া থেকে জর্ডান, বিশ্বকাপ বাছাইয়ের দুই ম্যাচের চারদিনের ব্যবধানেই ফুটবল দর্শনের খোলনলচে বদল। একেবারে একশো আশি ডিগ্রি সামারসল্ট।
বাংলাদেশের ফুটবল সংগঠকদের জন্য এমন আচমকা উল্টোপথে হাঁটা নতুন নয়। ১৯৭৮ থেকে ২০১৫, মাত্র ৩৭ বছরে জাতীয় ফুটবল দলে নিয়োগ পেয়েছেন ১৬ বিদেশী। সাম্প্রতিক রিক্রুট ফ্যাবিও লোপেজকে নিয়ে এই ১৬ বিদেশী ফুটবল গুরুর মিছিলে ছিলো ফুটবল পরাশক্তি জার্মানি, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, নেদারল্যান্ডস। তালিকাকে পূর্ণতা দিলেন ইটালির লোপেজ।
বাফুফে কর্মকর্তারা এবার গর্ব করে বলতে পারেন, দেশের ফুটবল মানকে আন্তর্জাতিক স্তরে তুলতে তারা বিশ্ব মানচিত্র চষে বেড়াচ্ছেন, বিশ্বকাপ জেতা প্রায় সবদেশের কোচকে নিয়োগ দিয়েছেন। শুধু ইউরো-লাতিন ফুটবল পাওয়ার নয়, এশিয়ার ইরান, ইরাক, সাউথ কোরিয়া, ভারত এমনকি ইউরোপের হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, ইংল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, মেসিডোনিয়া, সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া থেকেও কোচ আনা হয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় কোচরা তো আছেনই। এরপরও সবকিছুই বৃথা। বাংলাদেশের ফুটবল এখনো ‘যেই লাউ, সেই কদু’ স্তরে!
আমাদের বাকপটু ফুটবল কর্তারা ২০২২ সালের বিশ্বকাপের মূল আসরে লাল-সবুজ পতাকা ওড়াতে চান। তবে স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও ঠিক করতে পারেননি শারীরিক সামর্থ্য ও অন্যান্য ফ্যাক্টরের বিবেচনায় বাংলাদেশের ফুটবল কোন ঘরানার অনুসারী হবে? ইউরোপীয় পাওয়ার বেইসড নাকি লাতিন আমেরিকান স্কিলড বেইসড অ্যাটাকিং ফুটবল দর্শন! জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে পিছিয়ে থেকেও সুচিন্তিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় ক্রিকেট এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয়, তরুণ প্রজন্মের প্রাণের খেলা।
বিদেশে গার্মেন্ট পন্যের পর ‘টাইগার-ক্রিকেট’ সবচেয়ে পরিচিত ব্র্যান্ড। অথচ একসময়ের বাঙ্গালির প্রাণের খেলা ফুটবল কেন মুখ থুবড়ে পড়েছে তার সুলুক সন্ধান কি হয়েছে? জাতীয় দলের বিপর্যয়ে দেশী-বিদেশী মিলিয়ে বাফুফে বরখাস্ত করেছে অর্ধশতাধিক কোচ। একই কারণে বাফুফে’র কোনো কর্তা কখনো জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন?
জাতীয় দলের বিপর্যয় মানেই কোচদের গিলোটিনে মাথা দেয়া। যেমন অস্ট্রেলিয়ার সাথে কম গোল খাওয়ার জন্য কোচ হিসাবে বাহবা পাওয়া লোডভিক ডি ক্রুইফের ‘গর্দান গেলো জর্ডানের কাছে হেরে’।
একটু পেছন ফিরে তাকানো যাক। বাংলাদেশ থেকে চাকরি হারিয়ে জার্মান কোচ অটো ফিস্টার সৌদি আরবে চাকরি পেয়ে সেই দেশকে নিয়ে গিয়েছিলেন বিশ্বকাপের মূলপর্বে। বাংলাদেশে যোগ দেয়ার আগে আফ্রিকায় কাজ করতে গিয়ে আফ্রিকান ফুটবলে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন ফিস্টার। দারিদ্রপীড়িত ‘আফ্রিকান ব্ল্যাক-স্টার’ ঘানার ফুটবলের বিশ্ব পর্যায়ে উঠে আসাতো তার হাত ধরেই।
সাংবাদিক ক্যারিয়ারের শুরুতে স্টেডিয়াম পাড়ায় দেখা ফিস্টারের হতাশায় নুয়ে পড়া সেই চেহারা আজো চোখে ভাসে। বিএসজেএ কার্যালয়ে এক দুপুরে ফিস্টার সিনিয়র সহকর্মীদের হাত ধরে আকুল কণ্ঠে বলেছিলেন, প্লিজ আমাকে তোমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অন্তত: একবার দেখা করিয়ে দাও, তাকে বুঝিয়ে বললে তার সহযোগিতা পাবো। তোমাদের কর্মকর্তারা আমাকে কোনো কাজ দিতে পারেন না। বাংলাদেশে সম্ভাবনাময় ফুটবলারের অভাব নেই। একটু সহযোগিতা পেলেই আমি তোমাদের ফুটবলকে অনেকদুর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো।’
জার্মান সরকারের ক্রীড়া ও সংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তির আওতায় বিনা পয়সায় পাওয়া এমন দূর্দান্ত এক কোচ শেষ পর্যন্ত কাজ না পেয়ে হতাশ হয়ে এদেশ ছেড়েছিলেন। তখনকার বাফুফে’র কর্মকর্তাদের অটো ফিস্টারকে নিয়ে আগ্রহ ছিলো না, আগ্রহ ছিলো তার ব্যবহারের জন্য জার্মান দূতাবাসের দেয়া পাজেরো জিপটির দিকে। ফিস্টার চলে যাওয়ার পর সেই পাজেরো এস্তেমাল করেছিলেন সেসময়ের বাফুফে’র প্রভাবশালী কর্মকর্তারা।
বাফুফেতে এখনো আছে সেই ধারা একটু ভিন্ন আঙ্গিকে, যদিও এখন কর্মকর্তাদের চেয়ারে সাবেক তারকা ফুটবলাররা। তাদের আবার টিভি পর্দায় মুখ দেখানো আর মিডিয়ায় অকারণ হাইপ তোলার বাতিক। হতেই পারে! কিন্তু সবাই তো আর বেকেনবাওয়ার, রুমেনিগে কিংবা মিশেল প্লাতিনি নন যে খেলোয়াড়ি জীবনের মতোই সংগঠক হিসেবেও সফল হবেন।
বাংলাদেশের খেলাধুলা বা শো-বিজে অসাধারণ এক উচ্চতায় বাফুফে সভাপতি ও সাবেক ফুটবল লিজেন্ড কাজী সালাউদ্দিন। সাত বছর আগে বাফুফে’র দায়িত্ব নেয়ার পর গোটা ফুটবল অঙ্গন নড়েচড়ে বসেছিলো। আশা ছিলো তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের ফুটবল ফিরবে কক্ষপথে। সেই আশা এখন কুহকিনি। সাত বছরে তিনি বিদায় করেছেন ছয় বিদেশী ও দুই দেশী কোচকে। এরমধ্যে দেশী সাইফুল বারি টিটো’কে একবার এবং বিদেশী ডি-ক্রুইফকে দুইবার।
৪০ বছর আগে বিদেশের পেশাদার লিগ খেলা সালাউদ্দিন আজ পর্যন্ত উপস্থাপন করতে পারেননি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামোগত পরিকল্পনা। চার বছর আগে মেসির আর্জেন্টিনাকে এক ম্যাচের জন্য ঢাকায় এনে ৩০ কোটি টাকা খরচ করা নাকি সেই উদ্দেশ্যেই। ওই টাকায় একটা অত্যাধুনিক ফুটবল একাডেমি চালু করা অগ্রাধিকারের শীর্ষে থাকা উচিত ছিলো। কেনো হচ্ছে না সেই প্রশ্নের উত্তর আজো মিলেনি।
‘সালাউদ্দিন-যুগে’ কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে বাফুফে। কিন্তু বিশাল বাফুফে ভবনের এক ফ্লোরে ফুটবলাদের ফিটনেস ধরে রাখার জন্য লাখ দশেক খরচ করে একটা অত্যাধুনিক জিমন্যাশিয়াম তৈরি করার সামান্য কাজটুকুও হয়নি। বড় বড় কথা বলে বিদেশী কোচ নিয়োগ দেয়া হয়। তারপর তাদের বেকার বসিয়ে রাখা, মাসের পর মাস বেতন না দেয়া নিয়মিত ঘটনা। এরপর বকেয়া বেতন চাইলেই কোচের যোগ্যতা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে বরখাস্ত করাই যেনো বাফুফে’র হাল ফ্যাশন।