কাশ্মীর সীমান্তে জঙ্গি হামলাকে কেন্দ্র করে পাক-ভারত সম্পর্কের পারদ ঊর্ধ্বসীমা ছুঁইছুঁই করছে। দু’দেশেই যুদ্ধযুদ্ধ জিগির তুলে সাধারণ মানুষকে ত্রস্ত ও উদ্বিগ্ন করে তোলার চেষ্টা করছে। গেল আগস্টে বেলুচিস্তান আর গত সপ্তাহে কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলাকে কেন্দ্র করে এই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়।
দুই দেশই একে অপরকে মোকাবিলা করতে রণপ্রস্তুতি নেয়ার পাশাপাশি বিশ্বনেতাদের নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে রাশিয়া ও চীন পাকিস্তানের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যা দিয়েছে আর ফ্রান্স ভারতকে পরমাণু বহন করার ক্ষমতাসম্পন্ন যুদ্ধজাহাজ সরবরাহ করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত-পাকিস্তান দু’দেশই পরমাণু ক্ষমতায় শক্তিশালী। এই বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত দুই দেশ হয়তো সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে না। পাকিস্তানের সঙ্গে কাশ্মীর নিয়ে বর্তমান সময়ের উত্তেজনায় সামরিক শক্তি প্রদর্শনের চেয়ে কূটনৈতিক চ্যানেলে দেশটিকে মোকাবিলা করতে বেশি আগ্রহী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যদিও তিনি এরই মধ্যে যথাযথ রণপ্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। নরেন্দ্র মোদি তার সরকারের সামরিকসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ৪৮ ঘণ্টায় একাধিকবার বৈঠকও করেছেন।
একথা ঠিক যে, দুই দেশের মধ্যে যে রকম উত্তেজনা ও বৈরিতা, তাতে এতদিনে যুদ্ধ বেধে গেলে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। ভারত-পাকিস্তান দুই দেশই পরমাণু শক্তিধর হওয়ায় একে অপরকে আক্রমণ করা থেকে বিরত রয়েছে। যে সুযোগে এই অঞ্চলের ১৪০ কোটি মানুষ এখনো অক্ষত রয়েছে। তবে সহসা এই দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান উত্তেজনা কমবে বলেও মনে হচ্ছে না। পাকিস্তান-ভারত বর্তমান সময়ের উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে ১৯৬০ সালে করা পানি চুক্তিতে প্রভাব পড়তে পারে। ভারত যদিও এই চুক্তি বাতিল করে, তবে দুই দেশের মধ্যে পানি নিয়ে যুদ্ধ শুরু হতে পারে। কেননা হিমালয়ের তিনটি নদী ভারতের ওপর থেকে নেমে পশ্চিম ও পূর্বদিকে প্রসারিত হয়েছে।
পশ্চিমদিকে যাওয়া নদীর পানি পাকিস্তান ১৯৬০ সালের চুক্তির বলে ব্যবহার করছে, যা পাকিস্তানের সেচ ও খাবার পানির অন্যতম উৎস। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত এই চুক্তি বাতিলের ইঙ্গিত দিয়েছে। এটা পাকিস্তানকে চাপে রাখার কৌশল কি-না সেটা অবশ্য স্পষ্ট নয়। উভয় দেশই সীমান্ত এলাকায় সৈন্য সমাবেশ করেছে। ভারতকেই অধিক আক্রমণাত্মক মনে হচ্ছে। চীন পাকিস্তানকে সমর্থন যোগালেও ভারত কিন্তু সামরিক শক্তিতে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়েই আছে। এর আগে ভারতের বিমান থেকে পরমাণু বোমা ছোড়ার মতো ক্ষমতা সম্পন্ন যুদ্ধবিমান ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি তারা ফ্রান্সের সহায়তায় তা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
চূড়ান্ত বিচারে যুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা কম। কারণ পরমাণু শক্তির অধিকারী এই দুই দেশই যুদ্ধের ক্ষত এবং ক্ষতি বোঝে। কিন্তু যুদ্ধ না হলে কী হবে, এ রণহুঙ্কার একটা অসুস্থ পরিবেশ তৈরি করছে। বৈরিতা আর বিদ্বেষ উৎপাদন করছে। উভয় রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা পুরো এলাকায় একটা স্থায়ী মানবিক সংকট তৈরি করছে। পাকিস্তানে তো নিয়ম করেই ভারত-বিরোধিতার বীজ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ইন্ডিয়া অ্যান্ড উইল রিমেন আওয়ার এনিমি নাম্বার ওয়ান। জানিয়েছিলেন প্রাক্তন পাক-সেনা প্রধান আসফাক পারভেজ কিয়ানি।
ভারত সম্পর্কে ঘৃণার এই শেকড়টি পাকিস্তানের গভীরে রয়ে গিয়েছে। ছোটবেলা থেকেই পাকিস্তানের শিশুদের মনে ভারত সম্পর্কে এই ঘৃণার বীজটি বপন করে দেওয়া হয়। পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খারও এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ছোটবেলা থেকেই পাকিস্তানের শিশুদের মনে ভারত সম্পর্কে ঘৃণা গেঁথে দেওয়া হয়। এটাই পাকিস্তানের জাতীয় পরিচয়ের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। প্রায় ছ’দশক ধরে পাক-শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে এই ঘৃণার লালন-পালন চলছে বলে জানিয়েছিলেন হিনা। আর যে কাশ্মীর নিয়ে এত ঝামেলা হচ্ছে, রক্তপাত হচ্ছে, পাকিস্তান কখনই যুদ্ধের মাধ্যমে কাশ্মীরের দখল নিতে পারবে বলে মনে হয় না। সে ক্ষেত্রে আলোচনাই এক মাত্র পথ। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন সুসম্পর্ক আর পারস্পরিক বিশ্বাস। ঘৃণার বাতাবরণে তা সম্ভব নয়।
ভারতের তুলনায় পাকিস্তান অনেক ছোট রাষ্ট্র। কিন্তু ভারতীয় মনস্তত্ত্বেও পাকিস্তান মানে সন্ত্রাস, এমন একটা আতঙ্ক তো আছেই। সেই সাতচল্লিশ থেকেই ভারতের নেতারা পাকিস্তানবিরোধী চেতনা লালন করে চলেছেন। জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করতে জওহরলাল নেহরু পাকিস্তান যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল এর ঘোর বিরোধিতা করেন। শেষ পর্যন্ত নেহরু পাকিস্তান যেতে পারেননি। কার্গিল যুদ্ধের পরেও অটলবিহারী বাজপেয়ী সার্ক সম্মেলন উপলক্ষে পাকিস্তান যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আদভানী আপত্তি করেন। সেবার সার্ক সম্মেলন বয়কট করে ভারত, সম্মেলনই ভণ্ডুল হয়ে যায়। মনমোহন সিংহও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মুম্বাইয়ের ২৬/১১-র ভয়াবহ নাশকতার পরেও পাকিস্তান যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসের শীর্ষনেতারা এতে রাজি হননি।
নরেন্দ্র মোদি অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। গেল বছর তিনি আকস্মিকই পাকিস্তান সফরে যান। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কন্নোয়নের ব্যাপারে অনেক ইতিবাচক কথাও শোনা যায় তার মুখে। কিন্তু কাশ্মীরে সাম্প্রতিক রক্তক্ষয়ী ঘটনা এবং সর্বশেষ ভারতীয় সেনাদের উপর অতর্কিত আত্রমণ পরিস্থিতিকে একেবারে পালটে দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ভারত-পাকিস্তানের এই রণহুঙ্কার কেন? পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে তিন-তিনটি যুদ্ধ হয়েছে। তাহলে আজ দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র কী করবে? তারা কি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সমাধানের রাস্তা পেতে পারে? যুদ্ধ কারা চায়? অস্ত্রব্যবসায়ী চায়, তার অস্ত্র বিক্রি হবে। কট্টরবাদীরা চায়, দাঙ্গা বাজেরাও চায়। কিন্তু সাধারণ মানুষ কি কখনও কোনও স্তরে যুদ্ধ চাইতে পারে?
সমস্যার সমাধান সর্বদাই আলোচনার মাধ্যমে করতে হবে। শান্তিপ্রক্রিয়ার আলাপআলোচনার কোনও বিকল্প নেই। ভারত-পাক সম্পর্কটা যেন তৈলাক্ত বাঁশে ওঠা আর নামা। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বারংবার। এর অবশ্য কারণও আছে। আসলে, পাকিস্তানের শরীরের মধ্যেও তো আছে অনেক পাকিস্তান। আইএসআই-সেনার পাকিস্তান, মোল্লাতন্ত্রের পাকিস্তান, আবার তুলনামূলক ক্ষুদ্র অবয়বের হলেও রাজনৈতিক গণতন্ত্রের পাকিস্তান। তাই নওয়াজের নেতৃত্বে পাকিস্তানের খোলসের মধ্য দিয়ে যখন আর এক পাকিস্তান বিকশিত হতে চাইছে তখন অন্যদের দায়িত্ব বেড়ে যায় অনেক অনেক বেশি। ইতিমধ্যে পাকিস্তানের পরিচিতি হয়ে ওঠেছে ‘সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর’ হিসেবে।
পাকিস্তানের প্রধান কাজ এখন তাদের এই পরিচিতির প্রবল ধারণাকে (পারসেপশন) বিশ্বের কাছে বদলানোর। আবার ভারতেরও দায়িত্ব দেশের মধ্যে সন্ত্রাসের বিরোধিতা করতে গিয়ে পারস্পরিক শান্তিপ্রচেষ্টায় জল না ঢালা। কৌশল যাই হোক, কিন্তু শান্তির পথকে শেষ সমাধান বলে ভাবতেই হবে! আরেকটি কথা। যুদ্ধ হলে কিন্তু আর কিছু নয়, কেবল নিরীহ কিছু মানুষের রক্ত ঝরবে৷ কিন্তু, রক্তের লাল রঙের সৌজন্যে কি কোনও দিন শান্তি ফিরেছে? শান্তির রঙ যে সাদা।
তাই সাদামাটা জীবন একটা কথাই জানে সবচেয়ে বড় বিপ্লব জীবন বাঁচিয়েই সাধন করা যেতে পারে, জীবন নিয়ে নয়। জীবনের মূল্য সেইজনই জানে, যেই জন ভালবাসতে জানে, ভালবাসতে শেখাতে জানে কল্যাণ আসে জ্ঞানের পথ ধরে। আর জ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমে আসে৷ যুদ্ধের মাধ্যমে আসেওনি, আসবেও না। দুই দেশের নেতারা এটা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন, দুই দেশের কোটি কোটি মানুষ, একইসঙ্গে মানবজাতির কল্যাণ ততই নিশ্চিত হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)