ছোটকালে আমরা রাক্ষসের গল্প শুনেছি। যেখানে রাক্ষসের ‘প্রাণ’ কোনো একটি পাখির মধ্যে লুকানো থাকতো। সেই ‘প্রাণপাখি’ আঘাত পেলে রাক্ষসের শরীরটা প্রতিক্রিয়া জানাত। এখন আমরা নতুন করে আবার সেই রাক্ষসের ‘প্রাণপাখি’ আর ‘শরীরের’ অস্তিত্ব দেখতে পাচ্ছি। কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমানের ফাঁসি কার্যকর করা হলো বাংলাদেশে। আর এ নিয়ে মায়াকান্নার শেষ নেই পাকিস্তান ও তুরস্কের। কৃতকর্মের শাস্তি হিসেবে নিজামীকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়েছে। আর এ জন্য ব্যথায় কঁকিয়ে উঠেছে তুরস্ক আর পাকিস্তান!
গত ১০ মে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করার পর থেকে যেসব দেশ এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তুরস্ক তার অন্যতম। এই ব্যথা সহ্য করতে না পেরে শোকে-দুঃখে-ক্ষোভে বাংলাদেশ থেকে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত ডেভরিম ওসতুর্ককে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট তাইয়েপ এরদোগান। ১২ মে এই ঘটনা ঘটে।
এর আগে তুরস্কের সাবেক প্রেসিডেন্ট আহমেত গুল বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের কাছে চিঠি লিখেছিলেন জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আযমকে যেন ফাঁসির দণ্ড দেওয়া না হয় তার অনুরোধ জানিয়ে। মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসি দেওয়ার প্রতিবাদে তুরস্কে কয়েকটি বিক্ষোভও হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ নিয়ে পাকিস্তানের মতো তুরস্কও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করে আসছে। বুধবার প্রথম প্রহরে ঢাকায় নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের পর তীব্র নিন্দা জানিয়ে একটি বিবৃতি দেয় তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এরপর তারা রাষ্ট্রদূতকেও প্রত্যাহার করে নিল।
তবে তুরস্ক সম্পর্কে আমাদের দেশের এক শ্রেণির মানুষের এখনও ভুল ধারণা রয়েছে। অনেকেই জানে না সাম্রাজ্যবাদের দোসর ন্যাটোসঙ্গী তুরস্ক এখন অপরাধী দেশ। সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রকাশ্য সমর্থন জুগিয়েছে তুরস্ক। তুরস্ক আমেরিকার স্বার্থসিদ্ধির জন্য নৃশংস, রক্তাক্ত যুদ্ধকে মদত দেওয়ার এক ধ্বংসাত্মক, বিপজ্জনক ভূমিকা পালন করেছে।
এই যুদ্ধের বাইরেও তুরস্কের নাম জড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে। এর মধ্যে কিছু যু্দ্ধাপরাধও আছে। সন্ত্রাসবাদের সমর্থক, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ও অন্যান্য বিশ্বের ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে আগ্রাসনের মতো অপরাধমূলক কাজ সংগঠিত করা, সত্যকে দিনের আলোয় নিয়ে আসার জন্য সাংবাদিক ও অন্যান্যদের ওপর দমনপীড়ন তুরস্কের সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ। মানবাধিকার ও সার্বভৌমত্বের প্রতি চরম শ্রদ্ধাহীন রাষ্ট্রপতি এরদোগান-এর আমলে তুরস্ক কার্যত একটি ‘দৃর্বৃত্ত-রাষ্ট্রে’ পরিণত হয়েছে।
এরদোগানের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলির প্রতি আগ্রাসন, ফ্যাসিবাদি কুখ্যাত অপরাধীদের মদত দেওয়া, দুর্নীতিসহ আরও গুরুতর। এমনকি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদীদের মদত জোগানো রাষ্ট্রের মধ্যে উচ্চারিত হচ্ছে তুরস্কের নাম।
তুরস্কের জঘন্য অপরাধের বিশ্লেষণ করতে গেলে শুরু করতে হয় সিরিয়ায় সন্ত্রাসবাদ বিস্তারের প্রতিক্ষেত্রে তুরস্কের কেন্দ্রীয় ভূমিকা দিয়ে। সিরিয়ার জমানা বদলের ডাক খোলামেলাই দিয়েছেন এরদোগান। ফ্রি সিরিয়ান আর্মি থেকে জাভাত আল নাসরা (সিরিয়ার আল-কায়েদা) এবং ইসলামিক স্টেট (আইসিস/আইএসআইএল/দায়েশ) এদের প্রত্যেককেই সমর্থন, অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা, সংবর্ধনা ও সেনা দিয়ে মদত দেওয়া এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরাসরি প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিয়েছে এরদোগানের সরকার।
২০১২সালে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর প্রতিবেদনে বলা হয় তুরস্কের সীমানা ব্যবহার করেই সি আই এ আসাদ-বিরোধী শক্তির হাতে অস্ত্রসহ অন্যান্য সামরিক উপকরণ পাঠিয়েছে। এক্ষেত্রে সিআইএ, মুসলিম ব্রাদারহুড-এর সঙ্গে তাদের যোগাযোগকেই কাজে লাগিয়েছে।
‘জামহুরিয়েত’-এর প্রধান সম্পাদক সি দুনদার প্রকাশ্যে আনেন আল-নাসরা গোষ্ঠী ও অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীদের অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছে। এই কাজের কেন্দ্রে তথা সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছে তুরস্কের গোয়েন্দা বাহিনী।
তুরস্ক সরকারই একমাত্র চিঠি দিয়ে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করার জন্য তদ্বির চালায়। জামায়াত, ব্রাদারহুড, হামাসসহ পৃথিবীর অনেক সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীর পরম বন্ধু এই তুরস্ক। আইএস, আল-কায়েদার মদতদাতা। ন্যাটোর সদস্য। মার্কিনীদের প্রিয় বন্ধু। এমনকী ইজরায়েল এবং ইহুদিবাদীদের সঙ্গে আছে তুরস্কের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।
গত বছরের জুন মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় ১ নভেম্বর নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে মৌলবাদী দলটি ফ্যাসিস্ট কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখে। গত বছর অক্টোবরে তুরস্কে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও বামপন্থীদের সমাবেশে বোমা হামলা চলে। প্রাণ হারান শতাধিক বামপন্থী কর্মী। অসংখ্য মানুষ আহত হন। হাজার হাজার মানুষ এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে। কিন্তু গায়ের জোরে সব রকম বিরোধিতা দমন করা হয়। নৃশংসতার প্রতিবাদকে অধিক সৃশংসতা দিয়ে দমন করা হয়।
তুরস্ক বর্তমানে আই এস-কে রক্ষা করতে সিরিয়ার আসাদ-বিরোধীদের মদত দিতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মূল হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। যে কাজ ইজরায়েলের হাত দিয়ে করানো জটিল হচ্ছিল, তার সবকিছুই এখন তুরস্কের ক্ষমতাসীন মৌলবাদীরা আরব জনসাধারণের বিরুদ্ধে করে যাচ্ছে। এই তুরস্ক ইরাকের বেশকিছু অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে দখল করে রেখেছে আর দখলমুক্ত করে দেওয়ার জন্য ইরাকিদের বারংবার আহ্বানকে অগ্রাহ্য করেছে।
তুরস্কে কোনও স্বাধীন গণমাধ্যমের অস্তিত্ব নেই। সরকারের সমালোচনা করতে পারে এমন কোনও পত্রিকা ওখানে দেখা যাবে না। নির্বাচনের কিছুদিন আগেই সমস্ত টিভি চ্যানেলে সরকারের গোয়েন্দাবাহিনী অভিযান চালায়। নিউজরুম থেকে অনেক সংবাদপাঠককে গ্রেফতার করা হয়। ধ্বংস করা হয় ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যাবতীয় অধিকার। তুরস্ক থেকে ট্রাক ভর্তি অস্ত্রে সিরিয়ার আইএস-কে পাঠানোর ছবি একটি বিদেশি পত্রিকার পাঠানোর অভিযোগে দু’জন সাংবাদিককে গুপ্তচর হিসেবে চিহ্নিত করে প্রহসনের বিচার চলছে।
এরদোগান ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে সিরিয়া ও ইরাকের আই এস অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি থেকে তেল পাচার করে মুনাফা লোটার অভিযোগ উঠেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বেকার যুবক-যুবতীদের হতাশাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেই জাল বিছাতে শুরু করেছে আইএস। আর এক্ষেত্রে তুরস্কই হয়ে উঠেছে প্রশিক্ষণকেন্দ্র। কলেজ পাশ করে বসে আছেন। চাকরি মিলছে না? চিন্তা নেই। অর্থ, গাড়ি, বাড়ি— সবই মিলবে। বিনিময়ে শুধু নৃশংসভাবে খুন করতে হবে বিধর্মীদের। এমন টোপ দিয়েই হাজার হাজার তরুণ-তরুণীকে দলে টানছে ইসলামিক স্টেট (আইএস)।
অথচ একসময় এই তুরস্ককে নিয়ে আমরা কত গৌরববোধ করতাম। বলতাম মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ধর্মমুক্ত দেশ। কামাল আতাতুর্কের কথাও বলতাম, যে মানুষটির কারণে তুরস্ক মৌলবাদের হাত থেকে রেহাই পেয়েছিল। কী গর্ব করেই না আবৃত্তি করতাম, কামাল তুনে কামাল কিয়া ভাই! আতাতুর্কের সেই তুরস্ককে এখন এরডোগান দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। যে ধর্মীয় মৌলবাদ একসময় নিশ্চিহ্ন হয়েছিল, সেই ধর্মীয় মৌলবাদ এখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তুরস্কে। এক মৌলবাদী শক্তি আরেক মৌলবাদীর জন্য ব্যথিত হবে-এ আর বিচিত্র কী!
ওদিকে জামায়াতের নেতা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় পাকিস্তানেও মাতম শুরু হয়েছে। গভীর উদ্বেগ জানিয়ে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে ১১ মে সর্বসম্মতভাবে একটি নিন্দা প্রস্তাব পাস হয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এ ঘটনায় ‘গভীরভাবে মর্মাহত’। এ ছাড়া গণহত্যায় নিজামীর সম্পৃক্ততাকে ‘কথিত অপরাধ’ উল্লেখ করে দেশটি ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। সেই সঙ্গে বলেছে, ‘পাকিস্তানের সংবিধান ও আইন সমুন্নত’ রাখাই ছিল তাঁর অপরাধ। মতিউর রহমান নিজামীকে নিয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত এক সপ্তাহের মধ্যে দুই দফা বিবৃতি দিল। এর আগে ৬ মে বিবৃতি দিয়েছিল তারা।
আমাদের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম যথার্থই বলেছেন, পাকিস্তান অযাচিতভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। তিনি বলেন, নিজামী যদি পাকিস্তানের এতটাই অনুগত থেকে থাকেন তবে পাকিস্তান কেন তাকে নিয়ে গিয়ে নাগরিকত্ব দেয়নি?
তবে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে আবারও প্রমাণিত হলো, মতিউর রহমান নিজামীরা পাকিস্তানের পক্ষে রাজনীতি ও গণহত্যা চালিয়েছিল। পাকিস্তানে ‘আমিই নিজামী’ নামে অনলাইন ক্যাম্পেইনও চালু হয়েছে। ক্যাম্পেইনটি যথার্থ। অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে পাকিস্তানিরা আসলেই নিজামী। তুরস্কও রাষ্ট্রীয় ভাবে ‘আমিই নিজামী’ ক্যাম্পেইনটি চালু করতে পারে। তাদের জন্য এটাই যথার্থ!
পাকিস্তান ও তুরস্ক গণতন্ত্রের চর্চা করে না, জঙ্গি ও মৌলবাদকে প্রশ্রয় দেয়। নিজামীর ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করার পর তাদের এমন প্রতিক্রিয়ায় তাই দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। তাদের ব্যাপারে আমাদের সতর্ক ও সচেতন হওয়া উচিত। আর পারলে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদরে ধৃষ্ঠতার দাঁতভাঙ্গা জবাবও দেওয়া উচিত।
এমন দুর্বৃত্ত-রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখলে কী হয়? দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো! আমরা যদি বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের মাতব্বরীকেই উপক্ষো করতে পারি, তবে তুরস্ক আর পাকিস্তানকে পারব না কেন?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)