পাকিস্তানের একটি আইটি কোম্পানি ভুয়া সার্টিফিকেট বিক্রি করে বছরে কোটি কোটি ডলার আয় করছে। দেশটির বন্দর নগরী করাচিতে এই কোম্পানির রয়েছে ২ হাজারের বেশি কর্মী, ৩শ’ ৭০টি ওয়েবসাইট ও বিশ্ব জুড়ে হাজার হাজার গ্রাহক। মানুষ এটাকে বলে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় সফটওয়্যার কোম্পানি।
সোমবার নিউ ইয়র্ক টাইমস এই ব্যাপারে অনুসন্ধানী এক প্রতিবেদন ছাপার পর মঙ্গলবার কোম্পানির কার্যালয় সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে আটক করা হয়েছে কোম্পানির ২৮ জন কর্মীকে। সাইবার আইনে মামলা হওয়ার পর পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিসার আলী খান কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফআইএ’কে দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
এক্সঅ্যাক্ট এই কোম্পানি ইন্টারনেটে দেখলে মনে হবে সুবিশাল শিক্ষা সাম্রাজ্য। এর ওয়েবসাইটে শত শত বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল ও শিক্ষকের নাম দেয়া আছে। যারা এখান থেকে সার্টিফিকেট নিয়েছেন আছে তাদের নামও। কিন্তু এখান থেকে দেয়া সব সার্টিফিকেট ভুয়া।
লোকজনের জানা মতে এক্সঅ্যাক্ট মূলত সফওয়্যার আপ্লিকেশনস বিক্রি করতো। কিন্তু এর ওয়েবসাইটের পূর্ণ বিবরণ এবং একজন সাবেক কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এরা দীর্ঘদিন ধরেই ভুয়া একাডেমিক সার্টিফিকেট বিক্রি করে আসছে এবং ইন্টারনেট যুগে এসে বিশ্বব্যাপী এর জাল বিস্তার করেছে। ইন্টারনেটে যোগাযোগ সহজ হওয়ায় তাদের আবেদনে প্রচুর মানুষ সাড়াও দিয়েছে।
এক্সঅ্যাক্ট-এর প্রধান কার্যালয়ে কাজ করা একজন সাবেক কর্মকর্তা বলেন, সেখানে ২৪ ঘণ্টাই লোকজন কাজ করে এবং টেলিফোনে যদি কোনো গ্রাহক আসল ব্যাপার জানতে চায়, তাহলে সেই ফোন কেটে দেয়া হয়। আর সার্কিফিকেট ক্রেতাদের বলায় হয়, ডিপ্লোমা জ্ঞান অর্জনের জন্য জীবনের স্বাভাবিক অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট।
গত অক্টোবরে চাকরি ছাড়া ইয়াসির জামসেদ নামের ওই কর্মকর্তা আরও জানান, গ্রাহকরা ভাবতো এটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু তা নয়। ২০১৩ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানি মিডিয়ায় দেয়া এক সাক্ষাতকারে এক্সঅ্যাক্ট-এর প্রধান নির্বাহী শোয়েব আহমেদ শেইখ তার কোম্পানিকে একটি আইটি এবং আইটি নেটওয়ার্ক কোম্পানি বলে বর্ননা করেছিলেন। এটাকে ছোট-মাঝারি মানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান উল্লেখ করে দিনভিত্তিক কয়েক’শ প্রজেক্ট ও গ্রাহকদের একটি লম্বা তালিকা দেখান তিনি। তবে কে বা কারা তাদের গ্রাহক সেটা বলেননি শোয়েব।
এক্সঅ্যাক্ট-এর ব্যাপারে স্বয়ং পাকিস্তানিরাই খুব কম জানতো। শোয়েব শেইখ এক অনুষ্ঠানে বলেন, তার আয়ের ৬৫ শতাংশই তিনি চ্যারিটিতে ব্যয় করেন। এবং গত বছর ও ২০১৯ সালের মধ্যে পাকিস্তানি ১০ মিলিয়ন শিশুকে শিক্ষিত করার ঘোষণা দেন।
সম্প্রতি তিনি উদ্যোগ নেন পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রভাবশালী মিডিয়া মোঘল হওয়ার। গত দুই বছরে তিনি নিজস্ব ব্রডকাস্টিং স্টুডিও বানিয়েছেন যেখানে ‘বোল’ নামে নতুন টেলিভিশন চ্যানেলের যাত্রা শুরু হওয়ার কথা এবং দেশের বিশিষ্ট সাংবাদিকদের নিয়োগ দিতে যাচ্ছিলেন। তাদের মালিকানাধীন কয়েক পত্রিকাও এ বছর প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু শোয়েব শেইখের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায় মিডিয়ায় তার এবং তার কোম্পানির অবৈধ, অনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রকাশ হওয়ার পর। এক্সঅ্যাক্ট’র অবৈধ কার্যক্রম ধরতে তদন্ত করেছেন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই’র এজেন্ট অ্যালেন জেল। তিনি বলেন, আমার দেখা অন্যতম বড় অপারেশন এটি। এক্সঅ্যাক্ট’এ কাজ করে পাকিস্তানে স্মার্ট তরুণরা। তারা ইংরেজি ও আরবি দুটো ভাষাই অনর্গল এবং পরিস্কার বলতে পারেন। তারা গ্রাহকদের হাইস্কুল ডিগ্রি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি পর্যন্ত অফার করে। স্কুলে জন্য ৩শ’ ৫০ ডক্টরেটের জন্য ৪ হাজার ডলার। তারা এমন ডিগ্রি দেয় যা বিদেশেও গ্রহণযোগ্য।
এক্সঅ্যাক্ট-এর সববেয়ে বেশি গ্রাহক মধ্যপ্রাচ্যে। এছাড়া সেখান থেকে সার্টিফিকেট নিয়েছে প্রতিবেশি ভারতের অনেক নাগরিকও।এমনকি বাদ যায়নি যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের নাগরিকরাও। এখানকার ভুয়া সার্টিফিকেটের জন্য এক সৌদি নাগরিক খরচ করেছেন চার লাখ ডলার।
বিল গেটসকে ছাড়িয়ে যাওয়া ইচ্ছা: পাকিস্তানে স্বঘোষিত টাইকুন শোয়েব শেইখ চ্যারিটিতে প্রচুর টাকা দিতেন। তার ইচ্ছে ছিল এক সময় বিশ্বের শীর্ষ ধনী হওয়া।এক অনুষ্ঠানে নিজে বলেছিলেন, তিনি বিল গেটসকে ছাড়িয়ে যেতে চান। শোয়েব শেইখ কখনও ই-মেইল বা সেলফোন ব্যবহার করেন না। গত বছর তিনি ২০ হাজার কর্মী কাজ করতে পারবে এমন একটি বিল্ডিং তৈরি করেন। তিনি তার কর্মীদের অনেক বেশি বেতন দেন। তবে অজানা কারণে কর্মীরা অসুখী ছিল। তার কিছু কাজ অনেক সময় সরকারকেও বিপদে ফেলতো।
এক কর্মীর তথ্যানুযায়ী ২০০৬ সালে এক্সঅ্যাক্টে’র দৈনিক আয় ছিল ৪ হাজার ডলার। বর্তমানে সেই আয় ৩০ গুণ বেড়েছে। পাকিস্তানে তাদের ০ দশমিক ৬ মিলিয়ন নিবন্ধিত শেয়ার আছে। আর পাকিস্তানি মুদ্রায় তাদের সম্পদের পরিমাণ ৭ মিলিয়ন রুপি। পাকিস্তানের বাইরে দুবাই, বেলিজ ও ব্রিটিশ ভার্জিনিয়া দ্বীপে কোম্পানির নিবন্ধন করেছে এক্সঅ্যাক্ট।
এক্সঅ্যাক্টের ডিগ্রি নিয়ে গ্রাহকরা যে বিপদে পড়েননি তা নয়। ২০০৮ সালে শুধু ওয়াশিংটনেই এ ভুয়া ডিগ্রির জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৩৫০ জন কর্মীর ওপর তদন্ত করা হয়। আর ২০০৭ সালে এই ৭শ’ কেস ধরা পড়ে ব্রিটেনে। সেসব কর্মীরদের ওপর সন্দেহ এবং দীর্ঘ তদন্তের পরই সোমবার প্রকাশিত হয় এক্সঅ্যাক্টের সীমাহীন অপরাধের ফর্দ।