১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ স্রেফ অস্বীকার করে পাকিস্তান বিবৃতি দিয়েছে যে কোন যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়নি। তাদের এই বক্তব্য আমাদের জাতীয় চেতনার উপর আঘাতস্বরুপ এবং ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) সামরিক-রাজনৈতিক ব্যাপারে পাকিস্তানের জড়িত থাকার বিষয়ে পাকিস্তানের বিচার বিভাগীয় তদন্ত রিপোর্টের সাথে সাংঘর্ষিক, যেখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে যে যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের নির্দোষ মানুষের উপরে গণহত্যা চালানো হয়েছে। আরো আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল যে বিশ্বজুড়ে যেসব মানবাধিকার সংস্থা এবং জাতিসংঘ যারা কিনা বাংলাদেশে চলমান যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন, তারা পাকিস্তানের এই সাম্প্রতিক বিবৃতির ব্যাপারে একেবারে নিশ্চুপ।
পাকিস্তানের যুদ্ধাপরাধ অস্বীকার করার অর্থ হল মানবজাতির ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ গণহত্যাকে অস্বীকার করা। এটি ৩০ লাখ শহীদ, দুই লাখ ধর্ষিতা নারী এবং প্রায় ৩ কোটি গৃহহারা মানুষের প্রতি উপহাস ছাড়া কিছু নয়। পাকিস্তান এমন একটি বিষয় অস্বীকার করতে চাইছে, যা এমনকি স্কুলে পড়া একটি শিশু, যে কিনা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে, সেও জানে। কিন্তু কোন মানবাধিকার সংস্থাই পাকিস্তানের হাস্যকর এই দাবি খণ্ডন করতে এগিয়ে আসেনি।
এক এক করে ব্যাপারগুলো ব্যাখ্যা করা যাক। যখন দুজন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরি এবং আলী আহসান মুজাহিদকে ফাঁসি দেয়ার প্রক্রিয়া কার্যকর করা শুরু হল, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একটি বিবৃতি নিয়ে হাজির হল যেখানে বলা হয়েছে- ‘দুইজন বিরোধী দলীয় নেতা আসন্ন মৃত্যুদন্ডের সম্মুখীন হচ্ছেন, যাদের বিচার এবং আপিল প্রক্রিয়ায় গুরুতর ত্রুটি রয়েছে’।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে মানবাধিকারের এই রক্ষকেরা সালাহউদ্দিন কাদেরের মত একজন ব্যক্তির জন্য অতিমাত্রায় উদ্বিগ্ন যে ভুয়া অ্যালিবাই প্রমাণের জন্য আদালতে জাল সার্টিফিকেট উপস্থাপন করেছিল, এবং বিচার প্রক্রিয়ায় যুক্ত সকলের ওপর প্রতিশোধ নেবার হুমকি দিয়েছিল। উপরন্তু একটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বর্ণনা দিয়েছিলেন কিভাবে তিনি সালাহউদ্দিন ও তার পিতার দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিলেন।
অন্যদিকে মুজাহিদ যুদ্ধকালীন সময়ে বুদ্ধিজীবিদের পরিকল্পিত ভাবে হত্যার জন্য কুখ্যাত।যাই হোক, পাকিস্তানের সাম্প্রতিক বিবৃতি, যা যুদ্ধাপরাধ কে সরাসরি অস্বীকার করছে, এই ব্যাপারে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর কোন প্রতিক্রিয়া নেই। ন্যায়বিচারকে আরেকবার অবমাননা করে পাকিস্তান উপরোল্লিখিত মৃত্যুদণ্ডাদেশদ্বয়কে দুর্ভাগ্যজনক হিসেবে অভিহিত করে শোক প্রকাশ করেছে। কিন্তু এটি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিবেক কে জাগাতে সক্ষম হয়নি।
একই কথার প্রতিধ্বনি করে আরেক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এই বিচারকে ত্রুটিপূর্ণ বলে দাবি করে ফাঁসি কার্যকর বন্ধ করার দাবি জানিয়েছিলো। এমনকি রিভিউ আপীল ব্যবস্থাও এই বিচার ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত ছিল, আসামীপক্ষকে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যা এই বিচার কে ন্যুরেমবার্গ বা অন্যান্য ট্রাইব্যুনাল থেকেও স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচারে পরিণত করেছে। যদিও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কোন রায়ের ঠিক আগে বা পরেই মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিবৃতি নিয়ে হাজির হয়, তবে পাকিস্তানের হাস্যকর ও সত্যের অপলাপ বিবৃতির ব্যাপারে তারা বোবা কালা সেজে থাকেন। এ থেকেই তাদের পক্ষপাতিত্বের বিষয়টি প্রমাণ হয়।
মৃত্যুদণ্ডের অব্যবহিত পরেই আমরা লক্ষ্য করি যে জাতিসংঘ দেশে মৃত্যু্দণ্ড স্থগিত রাখার আহবান জানিয়েছে। সেই একই সংগঠন এড়িয়ে যায় যে বিশ্বে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দিক দিয়ে পাকিস্তান প্রথম, যুক্তরাষ্ট্র চতুর্থ। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো একজন ‘ব্যক্তি’র হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ডাদেশের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকলেও ‘গণ’হত্যাকারীদের রক্ষা করতে সোচ্চার।
কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী, মিরপুরের কসাই নামে পরিচিত কাদের মোল্লার ফাঁসির আগে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্র বিষয়ক সচিব জন কেরি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে এই ফাঁসি হয়তো জাতীয় নির্বাচনকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে। এটি কি পরোক্ষভাবে যুদ্ধাপরাধীদের দোসরদের নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারকে আইনের শাসনের ব্যাপারে আপোস করতে বাধ্য করার ইঙ্গিত নয়?
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের বিবৃতির ব্যাপারে কোন প্রতিবাদ করেনি। যুক্তরাষ্ট্র কি এখনো বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে তাদের অবস্থানে অনড় রয়েছে? যুক্তরাষ্ট্র কি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলার সময়ে তাদের সপ্তম নৌবহরকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পক্ষে পাঠানোর সিদ্ধান্ত যৌক্তিক হিসেবে প্রমাণ করতে চায়?
আসুন দেখা যাক সিরিয়ায় জিহাদী জন নামে পরিচিত আই এস সদস্যের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বিবিসি যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে, যিনি দাবি করেন এই হত্যাকাণ্ডের ফলে পৃথিবী বসবাসের জায়গা হিসেবে আরো নিরাপদ হয়েছে। আমরাও কি বলতে পারি না যে কুখ্যাত দুজন যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড মানবতা ও মুক্তি অর্জন এর পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ? আমরা মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অবস্থান বুঝতে পারি। কিন্তু যখন আমরা দেখি পাকিস্তান যেই বিবৃতির মাধ্যমে ৩০ লাখ শহীদের মানবাধিকার নিয়ে প্রহসন করে, সেই বিবৃতি নিয়ে এই সংস্থাগুলো নিশ্চুপ, তখন আমরা বুঝতে পারি যে তারা আমাদের রক্তাক্ত পথে অর্জিত স্বাধীনতার বিরোধীদের পক্ষে নির্লজ্জ পক্ষালম্বন করছে।