পলিথিনে ছেয়ে গেছে সারা দেশ, এর দূষণের যেন চলছে মচ্ছব! নিষিদ্ধ হলেও পলিথিনে ভরে গেছে রাজধানীসহ দেশের সব হাট-বাজার। পলিথিনের ব্যাগ বিক্রয়-বিতরণ, ব্যবহার ও মজুদ নিষিদ্ধ হলেও এ আইন মানছে না কেউ।
আইনি দুর্বলতার সুযোগে পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম পলিথিন এখন সহজলভ্য। যত্রতত্র ব্যবহারের ফলে ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, উর্বরতা হারাচ্ছে মাটি, ভরাট হচ্ছে নদী-খাল-বিল, পরিচ্ছন্নতা হারাচ্ছে সড়ক-গলিপথ।
এসব পলিথিনের বাজারজাত ও ব্যবহারে নেওয়া হচ্ছে নানা কৌশলের আশ্রয়। এর একটি হলো টিস্যু ব্যাগ। সম্প্রতি বাজারে আসা এ ব্যাগটি কাগজের তৈরি বলে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু আসলে তা আসলে কাগজ নয়, পলিথিনের। দেখতে কাগজের মতো কিন্ত আগুনে দিলে গলে যায়। ব্যবসায়ীদের এমন কৌশলে বোকা হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, অতি সূক্ষ্ম ইথিনিল পলিমার পলিথিন তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয় যা অপচনশীল। ফলে জমির উর্বর শক্তি নষ্ট হয়। এছাড়াও এতে বহন করা যে কোনো ধরনের খাবার দীর্ঘক্ষণ থাকলে বিষক্রিয়ায় তা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এক সমীক্ষায় জানা গেছে, ঢাকা শহরের একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে চারটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। ওই হিসাবে প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার শেষে ফেলে দেওয়া হয়। এতে ড্রেন-নালা, খাল-ডোবা ইত্যাদি ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পলিথিন থেকে সৃষ্ট ব্যাকটেরিয়া ত্বকের বিভিন্ন রোগের জন্ম দেয়।
সরেজমিন দেখা গেছে, শপিংমল থেকে শুরু করে মাংসের বাজার, মুদি দোকান, কাঁচাবাজার, মাছের বাজার সর্বত্রই নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগের ছড়াছড়ি। মাছ ও মাংসের বাজারে পলিথিনের চাহিদা বেশি।
নিষিদ্ধ পলিথিন বিক্রিতে পিছিয়ে নেই ব্যবসায়ীরাও, ক্রেতারাও এটির ব্যবহারে আগ্রহী। মহোৎসবে পথ-ঘাট, বাজার-স্কুল, মাঠ-ক্যাম্পাস-সবখানে। পলিথিন খেয়ে নিচ্ছে মাটির উর্বরতা, বাতাসে ছড়াচ্ছে বিষ। পলিথিনের মূল উপাদান ইথিলিন রেফ্রিজারেটরে রাখা মাছ-মাংস-ফল দূষিত করে।
পরিবেশ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এস. কে. আকতার বলেন, ‘পলিথিন-পোড়া গ্যাস ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। এ পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে মানুষকে সচেতন হতে হবে।’
এর পাশাপাশি পরিবেশ অধিদপ্তরকে আরো কঠোর ভূমিকা রাখার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
কীভাবে পলিথিনের যত্রতত্র উৎপাদন থামানো যাবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ন সম্পাদক ইকবাল হাবিব চ্যানেল আই অলাইনকে বলেন, যেখান থেকে উৎপাদন করা হয় সে জায়গাটা খুঁজে বের করতে হবে। এরপর যারা দোষী তাদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
২০১০ সালে পলিথিনের পরিবর্তে পাটজাত ব্যাগ ব্যবহারের আইন পাস করে সরকার। প্রতিটি পণ্যের মোড়কে পাটজাত পণ্য ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে। কিন্তু তা শুধু কাগজে-কলমেই থেকে গেছে। বাস্তবে কোনো পণ্যই পাটজাত মোড়ক বা ব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে না। ফলে বিক্রেতারা বাধ্য হয়ে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করছেন।
জানা গেছে, গার্মেন্ট, লবণ ও চিনিসহ ২৩ ধরনের প্যাকেজিং পলিথিন উৎপাদনের অনুমোদন নিয়ে গোপনে কারখানা মালিকরা অবৈধভাবে পলিথিন উৎপাদন করছেন। ঢাকার পলিথিন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে একাধিক প্রভাবশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। এ ছাড়া যাত্রাবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে শতাধিক কারখানা।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) সভাপতি আবু নাসের খান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, বাজারে হানা না দিয়ে যেখানে উৎপন্ন হয় সেখানে হানা দিয়ে পলিথিন তৈরির কারখানা সমূলে ধ্বংস করতে হবে।
তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, এক সময় পলিথিনের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে ব্যাপক প্রচারণা থাকলে এখন তা ঝিমিয়ে পড়েছে। তবে সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে। তারা যেন মানুষের জন্য ক্ষতিকর এ বস্তুটি ব্যবহার না করে।
অনেকের অভিযোগ, পলিথিনের ব্যবহাররোধে সরকারের মনিটরিং ব্যবস্থা দূর্বল হয়ে পড়েছে। যার ফলে যত্রতত্র পরিথিনের কারখানা গড়ে উঠছে। আর এ সুযোগে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়ে উঠছে।
ইকবাল হবিব আরো বলেন, বিভিন্ন জায়গায় সরকারের অভিযান পরিচালনা তো লোক দেখানো। তারা সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতো তবে বাজারে এই নিষিদ্ধ পলিথিনের মেলা বসতো না।
পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ‘সব পণ্যে পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০’ ব্যবসায়ীদের অনুরোধে বাড়ানো এ সময় শেষ হবে নভেম্বরে। এরপর সারা দেশে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহার বন্ধে অভিযান শুরু হবে।
এ বিষয়ে আবু নাসের খান বলেন, ‘সব পণ্যে পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০’ যতো দ্রুত সম্ভব কার্যকর করা উচিত।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (সংশোধিত) ২০০২ অনুযায়ী, এই আইন অমান্য করলে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে। আর বাজারজাত করলে ৬ মাসের জেল এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।
কিন্তু বর্তমানে প্রকাশ্যে পলিথিন ব্যবহার করা হলেও এই আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। ওই আইনে ১০০ মাইক্রোনের কম পুরুত্বের পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য, ওষুধ, সিমেন্ট, সারশিল্পসহ মোট ১৪টি পণ্যে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া হয়। তবে ওই আইনের তোয়াক্কা না করেই পলিথিনের ব্যবহার চলছে দেদারসেই।