একান্নবর্তী পরিবার। এক চিলতে উঠোন। খোলা বাড়ি আর ভালবাসায় ঘেরা এক বৃহৎ পরিবার। আছে ভালবাসা-অনুরাগ। ছোট ছোট মান অভিমান। সবকিছুকে জয় করে চলা এক সাজানো সংসার।
কিন্তু সবকিছুই কেমন যেন উলট-পালট হয়ে যায় যখন পরিবারটিকে ভালবাসায় বেঁধে রাখা মানুষটি মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন।
এটি পুরান ঢাকার এক ব্যবসায়ী পরিবারের কাহিনী। পরিবারের সবচেয়ে দায়িত্বশীল বড় বউ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ায় প্রায় তছনছ হয়ে যেতে বসেছিল পরিবারটি। ছোট থেকে শুরু করে পরিবারের বড় সদস্যটিকেও হতে হয়েছে ভুক্তভোগী। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সন্তানদের লেখাপড়া। মায়ের অকথ্য ভাষা, আর কারণে-অকারণে মারধোরের কারণে সন্তানরা এড়িয়ে চলতো মাকে। স্ত্রীকে নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে বন্ধ হয়ে যায় স্বামীর ব্যবসা।পরিবারের প্রাণ বউটির করুণ দুর্দশা দেখে শাশুড়ি নীরবে ফেলতেন চোখের জল।
তবে পরিবারের মানুষের ভালবাসা, স্বামীর ধৈর্য ও চিকিৎসকের চিকিৎসায় অন্ধকার মাদকের জগৎ থেকে এখন স্বাভাবিক জীবনে বউটি।
পরিবারের বড় বউ নীপা (ছদ্মনাম)। নিপুণ হাতে সামলে চলেছিলেন সংসার। স্বামী সংসার, শ্বশুর-শাশুড়ি, ভাশুর দেবর নিয়ে ভরভরন্তি সংসার তার। কিন্তু সেই সংসারেই নেমে আসে কালো ছায়া যখন নিপা মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। নিজের অজান্তেই এই ভুল পথে পা বাড়ান নিপা।
ঘটনার শুরু নিকটাত্মীয়ের হাত ধরে। পরিবারের সকল পুরুষ সদস্য যখন কাজে বেরিয়ে পড়েন তখন নিপার এক মামাতো দেবর প্রায়ই আসতে থাকেন নীপাদের বাসায়। এসে একটি ব্যাগ রেখে চলে যান। যাবার সময় নীপাকে বলে যান ব্যাগটি সামলে রাখতে।
এভাবে কেটে যায় কয়েক মাস। হঠাৎ নীপার কৌতুহল জাগে কী আছে ওই ব্যাগে? আর এ কৌতুহলই নীপার জীবনে ডেকে আনে সর্বনাশ। সেই সাথে পুরো পরিবারের। নীপা জানতে পারেন, সেই ব্যাগে ফেন্সিডিল আছে, দেবর তাকে উদ্বুদ্ধ করে সেটি খেতে। এভাবে দেবরের কথামত প্রথমে ফেন্সিডিল তারপর সিগারেট- ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়েন তিনি।
আমূল পরিবর্তন আসে নীপার আচরণে। মেজাজ হয়ে যায় খিটখিটে। কারণে-অকারণে শুরু করেন বাচ্চাদের মারধোর। পরিবারের গুরুজনদের সাথে করতে থাকেন দুর্ব্যবহার। সারাদিন ঘুমোতে থকেন। জেগে থাকতে শুরু করেন সারারাত। কখনোবা তির-চারদিন একটানা ঘুমিয়ে তারপর আবার জেগে থাকেন। শুরু হয় কারণে অকারণে হাসি-কান্না। স্বামীর সাথে বাড়তে থাকে দুরত্ব। উদাসীন হয়ে যান সংসারের প্রতি।
পরিবারের সদস্যরা ভাবতে থাকেন নীপার হয়তো মানসিক সমস্যা হয়েছে। ঘুর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারেন না কী ঘটে চলেছে তাদের অলক্ষ্যে। ইয়াবায় আসক্ত হবার পর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যায় নীপার।
দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তারা। জানতে পারেন, প্রায় ছয় মাস যাবৎ মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছেন নীপা।
নীপাকে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে নেয়া হলে তিনমাস সেখানে থাকার পর সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরেন তিনি। পরবর্তীতে দেড় বছর চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকার পর বর্তমানে তিনি স্বাভাবিক জীবন-যাপন করছেন।
নীপা যার তত্ত্বাবধানে ছিলেন সেই মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এ. এ. কোরেশী চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: নীপাকে যখন আমি প্রথম দেখি তখন সে খুবই এলোমেলো ছিল। কারণে-অকারণে হাসতো-কাঁদতো, চিৎকার করতো। বাচ্চারা কাছে এলে তাদের ধরে মারতো। স্বামীকে সহ্য করতে পারতো না।
‘তবে ধীরে ধীরে প্রায় ১৯ মাসের চিকিৎসায় সে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে। বর্তমানে সে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করছে।’
বিভিন্ন গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে মাদকাসক্তদের মধ্যে ১৬ শতাংশ নারী। এমনিতেই দেশে মাদক নিরাময় কেন্দ্র কম। নারীদের জন্য আলাদা তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই কোনো মেয়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়লে পরিবারের সদস্যরা নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ পাননা।
গবেষকরা বলছেন, পরিবারকে খেয়াল রাখতে হবে যাতে পরিবারের কেউ মাদকাসক্ত হয়ে না পড়ে। আর যদি একান্তই কারো মধ্যে অঅসক্তি গড়ে উঠে তাহলে নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে। না হলে একজনের কারণে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে পুরো পরিবার যেমনটি ঘটতে যাচ্ছিল নীপার পরিবারের ক্ষেত্রে।