দেশব্যাপী পরিবহন শ্রমিকদের আহূত ধর্মঘটে বিবেকবান মানুষদের বিবেককে বিভিন্নভাবে নাড়া দিয়েছে এবং এরই প্রেক্ষিতে ভবিষ্যৎ পরিবহন ব্যবস্থার সংকট ও নৈরাজ্য ব্যবস্থার ভাবনার চিত্র চোখের সামনে ভেসে আসে নিমিষেই। পরিবহন শ্রমিকদের যে বর্বরতা দুইদিন যাবত বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে তা এক কথায় অবর্ণনীয়, কল্পনার সীমাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে সরকারের প্রণীত আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ পরিবহন শ্রমিকদের পরিবহন ধর্মঘট।
পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘট বলতে সাধারণ অর্থে বোঝা যায়, পরিবহন শ্রমিকেরা তাদের নির্দিষ্ট কাজ থেকে বিরত থাকবে। তার মানে এই নয় যে, তারা অন্য যে কোনো পরিবহন রাস্তাঘাটে চলাচলে বাধা বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। তার কোনো অধিকার তাদের নেই, কারোর অধিকার হরণ করার নৈতিক ও আইনগত বৈধতা লঙ্ঘন করার কারণে সুনির্দিষ্ট পরিবহন শ্রমিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ এবং তড়িৎগতিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। তা ছাড়া পরিস্থিতি আরো ভয়ংকর ও আশঙ্কাজনক হয়ে উঠবে। এর ফলে তৃতীয় পক্ষ যে কোনো ফায়দা লুটার সুযোগ খুঁজতে থাকবে। কারণ, বাংলাদেশে একটি শ্রেণিই রয়েছে যারা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে কখন এবং কিভাবে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যায়। তাছাড়া কিছুদিন পরেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, নির্বাচনকে সামনে রেখে অন্ধকারে থাকা গ্রুপগুলো নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়ার প্রয়োজনীতার সাপেক্ষে সারা দেশে অরাজকতা পরিবেশ সৃষ্টির পায়তারা করে থাকে। কাজেই, সকল পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ঘটনার ঘাত প্রতিঘাতের সমন্বয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা অতীব প্রয়োজন।
চ্যানেল আই অনলাইন ও বিভিন্ন পত্রিকার খবরের মাধ্যমে জানা যায়, পরিবহন শ্রমিকেরা স্কুলগামী ছাত্রীর ইউনিফর্মে পোড়া মবিল মাখিয়ে দিয়েছে, মুখে পোড়া মবিল লাগিয়ে দিয়েছে ব্যক্তিগত পরিবহনের ড্রাইভারের মুখে, মোটরসাইকেলের আরোহীর মুখে। তাদের বর্বরতা থেকে রক্ষা পায়নি অ্যাম্বুলেন্সে বহনকারী অসুস্থ শিশুটি, পরবর্তী সময় শিশুটি রাস্তায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসে হরতাল, অবরোধ আমরা দেখেছি। কিন্তু আমরা জানি, হরতাল অবরোধেও অ্যাম্বুলেন্সকে কখনো বাধা দেওয়া হয় না। মানবিক দিক বিবেচনায় নিয়ে আন্দোলনকারীরা অ্যাম্বুলেন্স এবং জরুরী পরিবহনকে রাস্তায় চলাচলে সহযোগিতা করে থাকে। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকেরা অসুস্থ রোগীকেও বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়নি। এই শিশু হত্যার দায়ভার অবশ্যই পরিবহন শ্রমিকদের। দোষীদের যে কোন ভাবেই হোক বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
পরিবহন ধর্মঘটের ফলে নানা শ্রেণির এবং পেশার মানুষ নানামুখী বিড়ম্বনার স্বীকার হচ্ছে এবং অনেকের মারত্নক ক্ষতিসাধনও হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৮-১৯ সেশনে ভর্তি পরীক্ষা চলছে। ভর্তি পরীক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকমাত্রই অনুধাবন করতে পারছেন কতটা বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীটিকে। বিড়ম্বনার শিকার হয়েও ভর্তি পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে, কিন্তু যারা যানবাহন সংকটের কারণে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছে না, তাদের জীবনের জন্য চিরস্থায়ী ক্ষতি হয়ে গেল। এ সব শিক্ষার্থীর ক্ষয়ক্ষতির দায়ভার কে নিবে? এ রকম ভাবে বিভিন্ন সেক্টরে সাধারণ মানুষ ক্ষণস্থায়ী ও চিরস্থায়ীভাবে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। বিষয়টা কোনোভাবেই মানা যায় না। যারা ক্ষয়-ক্ষতির জন্য দায়ি তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
মাঝে মধ্যে মনে প্রশ্ন জাগে, পরিবহন শ্রমিকদের অরাজকতার পেছনে সাহস যুগিয়েছে কে? কোনো সংঘবদ্ধ চক্র কি পরিবহন শ্রমিকদের পিছনে সরাসরি ইন্ধন যুগিয়েছে সে বিষয়টি খতিয়ে দেখার প্রয়োজন এসে পড়েছে। না হলে, কিছুদিন পর পর অহেতুক আন্দোলন করে সাধারণ জনগণের স্বাভাবিক জীবন অতিষ্ঠ ও বিনষ্ট করার যে আয়োজন দেখা যায় তার বিনাশ হবে না কখনোই। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের আহূত ধর্মঘট নিয়ে। বিবেক বর্জিত, ন্যাক্কারজনক, আইনের পরিপন্থী এবং জঘন্য উপায়ে সংঘটিত তাদের কৃতকর্ম আমাদের সড়ক ব্যবস্থার ভবিষ্যতের জন্য মারত্নক অশনিসংকেত। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করার ইন্ধনদাতা যত বড়ই শক্তিশালী ও প্রভাবশালী হোক না কেন যে কোন মূল্যে তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
আমার মনে হয়, যে বিষয়টা হতে পারতো তা হলো; বাংলাদেশে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা হুট করে ধর্মঘট না ডেকে মানববন্ধন কিংবা গোলটেবিল আলোচনার মাধ্যমে যৌক্তিকতার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিকদের দাবি দাওয়ার যথার্থতা প্রমান করার সুযোগ পেত। পরবর্তীকালে সরকারের প্রতিনিধির সাথে বৈঠক ও আলোচনার মাধ্যমে আইনের পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন ও বিয়োজনের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসা যেত। উল্টো তারা সুযোগটি অবলীলায় নষ্ট করে জনগণের শান্তি শৃঙ্খলা বিনষ্টের কারণ হিসেবে অযাথিত ধর্মঘটের ডাক দিয়ে তারা তাদের পাশবিক ও শ্রী-হীন চরিত্রের বহি:প্রকাশ ঘটিয়েছে। যা অত্যন্ত ঘৃণিত ও বিবেকবর্জিত কাজ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)