চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

পদ্মাসেতু নির্মাণ এবং প্রধানমন্ত্রীকে যিনি অভয় দিয়েছিলেন

পদ্মাসেতু নিয়ে আবারও বাংলাদেশসহ বিশ্ব মিডিয়ায় নতুন করে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। এই তোলপাড়ের মুল কারণ ছিল-পদ্মাসেতু প্রকল্পে কোনো ধরনের দুর্নীতি হয়নি তা খোদ কানাডিয়ান এক আদালতে প্রমাণিত হওয়া। বলতে দ্বিধা নেই সরকার পক্ষের জন্যে এটি সীমাহীন আনন্দ আর উচ্ছ্বাস বয়ে আনে নতুন বছরে। মহাজোট সরকারের শুভাকাঙ্খিরাও ভাবেননি বসন্তের আগমন আর কোকিলের কুহুতানের সাথে এত সুন্দর একটি সংবাদ আসবে। স্বভাবতই এত আনন্দিত বোধ হয় সরকার পক্ষ এর আগে কখনই হয়নি। শুধু আনন্দিত বললেও ভুল হবে, সমান্তরাল উজ্জীবিতও হয়েছে। এর অনেকগুলো বৈশ্বিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক কারণ রয়েছে বলেই প্রতীয়মান। প্রথমত-এই কথিত দুর্নীতি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন ফোরামে সরকারকে নানান ধরনের কথা শুনতে হচ্ছিল। নানান ধরনের গুঞ্জনে নিমজ্জিত হতে হচ্ছিল। তার একটি চমৎকার জবাব এবং প্রমাণ এবার হাতেকলমে পেয়েছে সরকার।

একইভাবে বিএনপিসহ যারা এটিকে নানা ছদ্মাবরণে রাজনৈতিক গুটি বা ট্রামকার্ড হিসেবে ব্যবহার করে বিশ্ববাজার থেকে রাজনৈতিক সহানুভূতি আদায়ে কসরত করছিল-তারাও এমন সংবাদে মুচড়ে পড়েছেন। আর তৃতীয় কারণটা হলো এই কথিত দুর্নীতির অভিযোগে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক মর্যাদা ঘিরে আপামর জনগণের মাঝে যে প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল তারও অবসান ঘটেছে। বরং তাঁর দূরদর্শী সাহসী নেতৃত্বের জয়গানে সারাদেশ আজ মুখরিত।

গত কয়েক বছর ধরেইতো পদ্মাসেতুর কথিত দুর্নীতি নিয়ে দেশে-বিদেশে বর্তমান সরকারকে পুরোদস্তুর বিবিধ ঝামেলার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল। বিশেষ করে বিদেশীদের সহানুভূতি পেতে এটিকে বড় এক কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছিল বিএনপিসহ তার রাজনৈতিক মিত্ররা। একইসাথে সমাজের কথিত সুশীলরাও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা আর সমালোচনায় মোটেও পিছিয়ে ছিলেন না। তারাও কারণে অকারণে সরকারের প্রতি এ বিষয়টি নিয়ে আঙুল তুলেছেন। কখনও কখনও বিষয়টি নিয়ে সন্দেহের তীর ছুঁড়ে দিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের প্রতিও। এমনকি শক্তিশালী বিদেশী নীতিনির্ধারকদেরও ‘মিসলিড’ করতে দ্বিধা করেননি তারা। বিদেশীরা এ কারণে প্রধানমন্ত্রীর উপর অযথা চাপ সৃষ্টির সুযোগ পেয়ে যান। আর সবমিলিয়ে জনমানসেও তৈরি হয়েছিল নানা বিভ্রান্তি। তবে দৃঢ়চেতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুবই সক্ষমতার সাতে দেশি বিদেশী এসব চাপ মোকাবিলা করেছেন। স্বদেশের সম্মানকে তিনি একটু মলিন হতে দেননি।

উল্লেখ্য,২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক কথিত দুর্নীতির অভিযোগ এনে পদ্মাসেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করার আচমকা সিদ্ধান্ত জানায়। সে সময় বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতা করেনি। পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলার ঋণ দিতে প্রতিশ্রুত ছিল। বিশ্বব্যাংক সেসময় আরও বলে সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তা, কানাডার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি ব্যক্তিদের যোগসাজশে বিভিন্ন সূত্র থেকে দুর্নীতির নানা তথ্য তাদের হাতে আছে। তবে বাংলাদেশ বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এমন কী দুর্নীতি দমন কমিশনকেও এ বিষয়ে তদন্ত করার অনুমিত দেয়। বিশ্বব্যাংক দুদককে নানাভাবে চাপ দিতে থাকে। ওকাম্পোর নেতৃত্বে বিশ্বব্যাকের এক বিশেষ তদন্ত দল অন্যায় সব চাপ সৃষ্টি করেছিল এই সময়টায়। আমাদের অদূরদর্শী অর্থমন্ত্রী স্বদেশের মর্যাদার কথা না ভেবে তাদের এসব চাপ একের পর এক মেনে নিচ্ছিলেন। এমন কী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের এসব চাপ মেনে নিতে পরামর্শ দিচ্ছিলেন। তাঁর সাথে একজন উপদেষ্টাও এই কর্মে যুক্ত ছিলেন। এসব কথা সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীই এক মন্ত্রীসভার অধিবেশনে জানিয়েছেন। পরিস্থিতি যখন এভাবে বাংলাদেশের মানমর্যাদা ক্ষুন্ন করার দিকে যাচ্ছিল তখন আমাদের সাহসী প্রধানমন্ত্রী পদ্মাসেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের আবেদন প্রত্যাহার করে নেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দেশবাসীকে জানান যে নিজস্ব অর্থায়নে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। পুরো জাতি তাঁর এই দৃঢ়চেতা সিদ্ধান্তে হাঁফ ছেঢ়ে বাঁচলো এবং তাঁকে বিপুলভাবে সমর্থন জানায়।

ইতিমধ্যে জানা গেছে যে, পদ্মাসেতু প্রকল্পে কোনো ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ পায়নি টরেন্টোর আদালত। ফলে কানাডার মন্ট্রিলভিত্তিক প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভানিনের সাবেক তিন কর্মকর্তাকেও অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয়েছে। বিচারক তার রায়ে বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের যে তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছেল তা জল্পনা,গুজব আর জনশ্রুতি ছাড়া কিছুই নয়। একটু মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন রয়েল কানাডিয়ান মাউন্টেন্ড পুলিশ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের যে কথোপকথন সাক্ষ্য হিসেবে উদ্ধার করে আদালতে হাজির করেছিল সেগুলাও ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। তাই আদালত সবকিছুই নাকচ করে দেয়। এমন রায় শোনার পর আওয়ামী লীগের সভাপতিসহ সবাই যার পর নেই খুশি হয়েছেন। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রীসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ এবং অভিনন্দন জানায় মন্ত্রীসভা। কেননা কথিত দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শুরু থেকেই জোর কণ্ঠে বলে আসছিলেন পদ্মাসেতু প্রকল্পে কোনো ধরনের দুর্নীতি হয়নি। বরাবরই এ বিষয়ে তিনি ছিলেন দৃঢ় এবং অবিচল। এদিন প্রধানমন্ত্রী ফের আত্মপ্রত্যয় ব্যক্ত করেন এবং এই চ্যালেঞ্জিং সময়ে যারা তার পাশে ছিলেন তাদের প্রশংসা করেন। আর তীর্যক মন্তব্য করেন তাদের সম্পর্কে যারা তাঁকে ভুল পরামর্শ দিয়েছিলেন।

২০১২ সালে পদ্মাসেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংক নিজেদেরকে গুটিয়ে নেওয়ার হুমকি দেওয়ার পর যে প্রশ্নটি সামনে আসে সেটি হলো- পদ্মাসেতু আর হবে কিনা? দুমুখোরা নানান ধরনের কথাবার্তা উড়াতে থাকেন। টেলিভিশনের টকশোতে কথার খই ফুটতে থাকে। একইসাথে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের অতিকথন, বিবেচনাহীন মন্তব্য সরকারকে খানিকটা বেকায়দাতেও ফেলে দেয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবিশ্বাস্য দৃঢ়তা স্থাপন করে গোটা জাতিকে এই মর্মে আশস্ত করেন যে ‘নিজেদের অর্থায়নেই পদ্মাসেতু হবে। পদ্মাসেতুর কাজ একদিনের জন্যও বন্ধ হবে না।’ এ সময় প্রধানমন্ত্রীকে নিজের সক্ষমতা দেখিয়ে সাহস যুগিয়ে যিনি সবার আগে পাশে দাঁড়ান তিনি তৎকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান। তিনিই সর্বপ্রথম মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অবগত করেছিলেন এই বলে যে, পদ্মাসেতু নির্মাণে যত ডলার লাগবে তার পুরোটাই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেওয়া সম্ভব। ড. আতিউর রহমান সে সময় বিষয়টি নিয়ে পদ্মাসেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলামের সঙ্গেও বৈঠক করেছিলেন। তিনি সে সময় এও বলেছিলেন, ‘পদ্মাসেতুর জন্যে কোন মাসে কত ডলার লাগবে, সে তথ্য ইতিমধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের কাছে চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অগ্রণী ব্যাংক যখন যে পরিমাণ চাহিদা জানাবে, তখনই ওই পরিমাণ ডলার যোগান দেওয়ার নিশ্চয়তা দেবে বাংলাদেশ। রিজার্ভ থেকে সেতুর অর্থায়ন হবে খুবই কম। তবে বিপুল পরিমাণ রিজার্ভ বৈদেশিক মুদ্রার যোগান দিতে সমর্থন দেবে। আজ যদি বলে যে ১০০ মিলিয়ন ডলার লাগবে, সেটাও দিতে পারবে’ (সূত্র: কালের কণ্ঠ ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)। এ বিষয়টি নিয়ে সে সময় প্রখ্যাত কলামিস্ট আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সাহসিকতার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। তিনি তাই যথার্থই বলেছিলেন, বিশ্বব্যাংকের অনিভিপ্রেত আচারণের পর একজন গভর্নর যেভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সাহস যুগিয়েছেন, নিজস্ব অর্থায়নে দেশের মঙ্গলাকাঙ্খায় সংকল্প ব্যক্ত করেছেন তা বিরল। বড় কথা হলো তৎকালীন গভর্নরের দেশপ্রেমিক ভাবনাটাকেই তিনি বড্ড প্রশংসায় সিক্ত করেছিলেন (সূত্র; সমকাল ১৯ মার্চে ২০১৬)।

গত বছরের ১৫ মার্চ রিজার্ভ হ্যাকড হওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর নিজের দায়বদ্ধতা এবং জবাবদিহিতাকে মর্যাদাময় করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে স্বেচ্ছায় বিদায় নেন। সেদিন যে যাই বলুক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুশি হতে পারেননি। হয়তো কোনো ব্যক্তি বিশেষের চাপ বা আবদারের কারণেই তিনি সেদিন তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু মন যে তাঁর সাঁয় দেয়নি তা বলাই বাহুল্য। তাই পদত্যাগী গভর্নরকে সামনে রেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিবৃতি দিয়ে তাঁর সাহস ও মার্যাদাবোধের প্রশংসা করেছিলেন। একই সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা ও অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্য অর্জনে তাঁর অবদানের কথা সেদিন তিনি বলেছিলেন। এর দুদিন পরেই কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় বলেছিলেন, ‘আমি পদ্মা ব্রীজের সময় অর্থমন্ত্রীর কাছে টাকা চেয়েছিলাম। উনি বলেছিলেন আমি কোথা থেকে টাকা দেবো? সেই টাকার ব্যবস্থা আতিউরই করে দিয়েছিল।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। যারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক গভর্নরের পেশাভিত্তিক সম্পর্কের গভীরতা জানেন তারা এই পদ্মসেতু অর্থায়নের প্রেক্ষাপট ঠিকই ধরতে পারবেন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে প্রযুক্তিগত একটি দুর্ঘটনার সুযোগ নিয়ে একটি স্বার্থান্বেষীমহল এই দুই দেশপ্রেমিকের দেশ গড়ার গভীর বোঝাপড়া সাময়িকভাবে হলেও আটকে দিতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশর উন্নয়ন অভিযাত্রায় এই অনাহুত পর্বটি গভীর বেদনার ও আত্মঘাতি এক ট্রাজিক অনুষঙ্গ হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে বলে মনে করি। এ সত্ত্বেও দেশ এগিয়ে যাবে।

একথা সত্য যে ২০১২ সালে মানুষের প্রতি ভালোবাসার জায়গায় দাঁড়িয়েই মরমী গভর্নর ড. আতিউর রহমানই সবার আগে দেশের অর্থের সক্ষমতার বিষয়টি প্রকাশ করেছিলেন। খেয়াল করুন, প্রায় একবছর হতে যাচ্ছে সাবেক গভর্নর এ বিষয়ে কোনো কথাই বলেননি। কেননা তিনি তাঁর সকল কৃতিত্বের জন্যে বরাবরই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে দায়বদ্ধ থেকেছেন। বিশ্বমানের প্রতিটি পুরস্কার তিনি তাঁকেই উৎসর্গ করেছেন। পদ্মাসেতু অর্থায়নের প্রশ্নে এমন সাহসী সিদ্ধান্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিতে পেরেছিলেন বিপুল অঙ্কের যে রিজার্ভ সাবেক গভর্নরের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংক গড়ে তুলেছিলেন তার জোরে। স্বপ্নের পদ্মাসেতুর উপর দিয়ে অচিরেই গাড়ি ও ট্রেন চলবে। তখন নিশ্চয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই দুঃসাহস এবং তাঁর পাশে থাকা সাবেক গভর্নরের অভয় দেওয়ার কথা দেশের আপামর জনতা এবং সেতু পারাপারাকারীদের মনে পড়বে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)