অভিজিৎ ব্যানার্জি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর অনেকেই রসিকতা করে বলেছেন, একালের কোনো বাঙালিকে নোবেল পুরস্কারর পেতে হলে একাধিক বউ থাকতে হবে। এর একটি অবশ্যই পশ্চিমা কোনো দেশের নারী হতে হবে। কারণটা স্পষ্ট। অভিজিৎ ব্যনার্জি-অমর্ত্য সেন উভয়ের ‘বউ-ভাগ্য’ ও ‘নোবেল ভাগ্য’ প্রায় একই ধরনের।
এই দুই বাঙালি নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের মধ্যে একটা বিরাট ‘কাকতালীয় ব্যাপার’ আছে। অমর্ত্য সেনের প্রথম স্ত্রী বাঙালি এবং সাহিত্যের নামকরা অধ্যাপক নবনীতা দেব সেন। সাহিত্যিক হিসাবেও যিনি অগ্রগণ্য। কিন্তু নবনীতার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত অমর্ত্যের সম্পর্কটা টেকেনি। অমর্ত্য সেন পরে বিয়ে করেন ব্রিটিশ বনেদি পরিবারের সদস্য অর্থনীতি ও ইতিহাসের বিখ্যাত অধ্যাপক এমা জর্জিনা রথচাইল্ডকে। ১৯৯১ সালে তাদের বিয়ে হয়, আর ১৯৯৯ সালে অমর্ত্য সেন পান নোবেল পুরস্কার। এমা জর্জিনা রথচাইল্ডকে বিয়ের আগে বেশ কয়েক বছর অমর্ত্য সেন নোবেলের জন্য মনোনীত হলেও নোবেল পাননি!
অভিজিতের ক্ষেত্রেও প্রায় এমন ঘটনাই ঘটেছে। তার প্রথম স্ত্রী অরুন্ধতী তুলি এমআইটির সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। তাদের সম্পর্কটাও টেকেনি। দুজনের সম্পর্কচ্ছেদের পর অভিজিৎ এক ছাত্রীর সঙ্গে নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। পরে তাকে বিয়েও করেন। এই ছাত্রীটিই হচ্ছেন ফরাসী অর্থনীতিবিদ ও ইতিহাসবিদ এস্থার ডাফলো।
এদিকে গত কয়েক বছর ধরেই অর্থনীতিতে সম্ভাব্য নোবেল বিজয়ী হিসেবে অভিজিতের নাম আলোচিত হচ্ছিল। কিন্তু ডাফলোকে বিয়ের চার বছরের মাথায় নোবেল জিতলেন অভিজিৎ!
আমরা এই ‘কাকতালীয় ঘটনা’টি নিয়ে অনেকেই রসিকতা করেছি। যদিও এই রসিকতার আড়ালে একটা গভীর বেদনার দিক চাপা পড়ে যাচ্ছে। অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের পর নবনীতা দেব সেনের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা অনুমান করতে পারি। হ্যাঁ, ব্যক্তিত্ববান নবনীতা অনেক অপ্রিয় প্রশ্ন ও পরিস্থিতি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে সামলেছেন। কখনও অমর্ত্য সেনকে কোনো কিছুর জন্য দায়ী করেননি। নোবেল জয়ের পর অভিনন্দন জানিয়েছেন। এমনকি নামের শেষাংশ ‘সেন’ও বাদ দেননি।
এদিকে অভিজিৎ ব্যানার্জি প্রথমে এমআইটির সাহিত্য বিভাগের প্রভাষক ড. অরুন্ধতী তুলি ব্যানার্জিকে বিয়ে করেন। তারা সহপাঠী ছিলেন এবং একসঙ্গে কলকাতাতেই বেড়ে ওঠেন। তারা এক-অপরকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলেন। পরে এমআইটিতে গিয়ে একসঙ্গে শিক্ষকতা করেন। ১৯৯১ সালে তাদের এক পুত্রসন্তান হয়, যার নাম কবীর ব্যানার্জি। সুখেই চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু ক্রমেই তাদের সুখের ঘরে দুঃখের আগুন এসে ভর করে। এস্থার ডাফলো নামে এক ফরাসি ছাত্রী পিএইচডি করতে অভিজিৎ ব্যানার্জির সহায়তা নেন। পিএইচডি শেষ করার পর শিক্ষক ও ছাত্রী একসঙ্গে অন্য একটি গবেষণায় অংশগ্রহণ করেন এবং নিজেরা ‘আব্দুল লতিফ জামিল পভার্টি অ্যাকশন ল্যাব’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এমআইটির প্রভাবশালী অধ্যাপক অভিজিৎ ব্যানার্জির সহায়তায় এস্থার ডাফলো সবচেয়ে কম বয়সে এমআইটির সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।
দিন যায়, দুই গবেষক নতুন নতুন সব আইডিয়া ও কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দেখতে দেখতে তুলির অগোচরেই শিক্ষক ও ছাত্রীর ‘মহান সম্পর্ক’ ভিন্ন পরিণতির দিকে এগোতে থাকে। স্ত্রী-পুত্র গৌণ হয়ে যায় এই নামজাদা অধ্যাপকের কাছে। অরুন্ধতী তুলি ‘স্কলার স্বামী’র এই অবহেলা ও দায়িত্বহীনতা মেনেও সংসার সামলে নিচ্ছিলেন। কাউকে কিছু জানতে দেননি। কারও কাছে নালিশ করেননি। শুধু ভেতরে ভেতরে একাকি দগ্ধ হয়েছেন!
এর মধ্যে অভিজিৎ-ডাফলোর সখ্য এবং যৌথ কাজের কলেবর দিনকে দিন বাড়তে থাকে। তারা দুজনে এক বছরেরও বেশি সময় ভারতে তাদের সংগঠন ও গবেষণার কাজে ব্যয় করেন। ভারত থেকে আমেরিকা ফিরে গিয়ে ২০১১ সালের শেষের দিকে এমআইটির ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে এস্থার ডাফলো বলেন যে, সে গর্ভবতী এবং অভিজিৎ তার সন্তানের পিতা। এটা শুনে অরুন্ধতী তুলির সব রকম ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়।
কিশোর ছেলে কবীরও বাবার এই সম্পর্কের বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি। অত্যন্ত মেধাবী কবীর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ধীরে বিভিন্ন রকম নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি এমনই বেগতিক হয়ে পড়ে যে, ২০১৪ সালে আমেরিকা থেকে উড়োজাহাজে চেপে লন্ডনে যাওয়ার সময় অত্যাধিক মদ্য পান করে কবীর সহযাত্রীদের মারধর করে। তাকে ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেফতার করে। ১৪-১৫ বছর বয়সী এই কিশোরের সাজাও হয়। যদিও কিশোর অপরাধী এবং ভালো ছাত্র হওয়ায় সুবাদে কম সাজাতে ছাড়া পায়। সেখানেও বাবা অভিজিৎ ব্যানার্জি ন্যূনতম দায়িত্ব পালন করেননি। তুলিই আমেরিকা থেকে ব্রিটেনে ছুটে গেছেন ছেলের পক্ষে আইনি লড়াইয়ের জন্য। আর বাবা তখন তার নতুন সন্তানের জন্মগ্রহণের প্রহর গুণতে ব্যস্ত!
২০১৫ সালে তুলির সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাড়াছাড়ি হয় অভিজিতের। তিনি প্রায় দুই বছর ‘বিবাহ-বহির্ভুত’ সম্পর্কের ইতি টেনে ১১ বছরের ছোট ছাত্রী ও সহযোগী এস্থার ডাফলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করেন।
এদিকে অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করতে গিয়ে ২০১৬ সালে কবীরের অকাল মৃত্যু হয়। এরপর থেকে স্বামী-সন্তানহারা তুলি আজও একা। ওদিকে তার ছোটবেলার বন্ধু ও প্রাক্তন স্বামী আরও একটি সন্তানের জন্ম দিয়ে ঘোরতর সংসারী। তুলি তার প্রাক্তন স্বামীর নোবেল প্রাপ্তিতে ফেসবুক ওয়ালে বন্ধু ও আত্মীয়দের শুভেচ্ছা বার্তার কমেন্টে সহজেই লিখে দেন: এই শুভেচ্ছা আমি ফরওয়ার্ড করে দেব!
আমাদের পক্ষে ডিভোর্স নিয়ে, একাধিক বিয়ে নিয়ে রসিকতা করাটা সহজ। আমরা করিও তাই। কিন্তু যদি ভেবে দেখি সেই মানুষটির কথা যার স্বামীর ‘অন্য নারীতে আসক্তি’র কারণে জীবনে নেমে এসেছিল অনাকাঙ্ক্ষিত বিবাহবিচ্ছেদ। যখন দেখি এই বিবাহবিচ্ছেদ বা ডিভোর্স শব্দটা একটি জীবনকে ছারখার করে দিয়েছে, তখনই মনটা কেমন যেন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে!
অভিজিত ব্যানার্জির পাশাপাশি এবার ডাফলোও অর্থনীতিশাস্ত্রে নোবেল জিতেছেন। নোবেল পাওয়ার পর প্রথম প্রতিক্রিয়ায় ডাফলো নারী শক্তির উত্থানের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘নারীদের সাফল্যের সম্ভাবনা এবং সাফল্যের স্বীকৃতির এটাই প্রমাণ। আমি আশা করছি, আমার সাফল্য বিশ্বের অসংখ্য নারীকে কাজ চালিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করবে ‘ তিনি একথাও বলেছেন যে, ‘নারীরাও সম্মানের হকদার, সেটা পুরুষদের বুঝতে হবে।’
ডাফলোর কথা অত্যন্ত অনুপ্রেরণামূলক। আমার শুধু একটাই খটকা, ‘নারীরাও সম্মানের হকদার, সেটা পুরুষদের বুঝতে হবে’ এই কথাটা কি ডাফলোর স্বামী অভিজিৎ ব্যানার্জি বুঝেছিলেন? তিনি কি অরুন্ধতী তুলির ক্ষেত্রে যথাযথ আচরণ করেছিলেন?
জানি না এই প্রশ্ন কতটা ‘ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো’, আর কতটা সামাজিক-রাজনৈতিক!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)