সারাদিন সাইকেল চালিয়ে, ঢাকার হ-য-ব-র-ল গাড়ির জটের ফাঁকফোকর দিয়ে সন্ধ্যা নামার কিছুক্ষণ আগে হোটেলে ফিরলেন অজিত বরাল ও তার তিন সঙ্গী।
লিফটের পাশে কালো-কমলা সাইকেল চারটি তালা দিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনকে সময় দিলেন অজিত। পথের ক্লান্তিকে পাশ কাটিয়ে আন্তরিক আলাপনের শুরুতেই বাংলাদেশের মানুষের আতিথেয়তার মুগ্ধতা প্রকাশ পায় তার কথায়।
সাইক্লিস্টের পোশাকেই হোটেলের অভ্যর্থনা কক্ষে বসা অজিত বলেন: বেনাপোল থেকে দীর্ঘ পথ সাইকেল চালিয়ে আমরা তখন ঢাকা শহরে ঢুকছি। প্রচণ্ড ক্ষুধায় আমাদের পেটে তখন ছুচোও দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ক্লান্ত। এর মাঝেই গাবতলীতে আমাদের একটি সাইকেলের চাকায় ঢুকে গেলো বিশাল একটি কাচের টুকরা। আমরা জানিও না কোথায় সাইকেলের লিক সারানো যায়। আশেপাশে কৌতুহলি মানুষ জড়ো হলো। বাংলা বলতে পারি না, ইশারায় হয়ে গেলো কথা বলা। তাদের মধ্যে কয়েকজন আমাদের সাইকেল ঠিক করার দোকান চিনিয়ে দিলো। এবার ক্ষুধার সমাধানও করে দিলো তারাই। আমরা যেহেতু গরুর মাংস খাই না তাই মুরগি রান্না হয় এমন হোটেল দেখিয়ে দিলো তারা।
ঢাকার প্রবেশদ্বারে মানুষের এমন ব্যবহারের সঙ্গে নেপালের মানুষের আতিথেয়তার দারুণ মিল খুঁজে পেয়েছেন অজিত। তবে ২৯ জুন বাংলাদেশে প্রথম আসা এই নেপালী তরুণের চোখে দেশের বহুল আলোচিত কিছু চিরাচরিত সমস্যাও ধরা পড়েছে দারুণভাবে। রাজধানীর কিছু কিছু নাগরিক সংকট তার কাছে অদ্ভুত লেগেছে। কিছু কিছু অসচেতনতা তার মনে জাগিয়েছে এই শহরে মানুষের বসবাস নিয়ে আশঙ্কা।
কারণ অন্যসব পর্যটকের মতো কয়েকটি নির্দিষ্ট জায়গায় ঘুরতে আসেননি অজিত, সুরেন্দ্র শর্মা, সরোজ গুরুং ও ইয়াম গুরুং। ‘দীর্ঘায়ু নেপাল’ নামের একটি সংগঠনে হয়ে এই চার তরুণ প্যাডেল চেপে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে গিয়ে বলছেন পরিবেশ সুরক্ষার কথা। তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছেন মাদকের অভিশাপ থেকে মুক্ত থাকার বার্তা।
বাংলাদেশের দীর্ঘায়ুর জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ এবং দূষণ রোধে অবহেলা করা যাবে না, সাফ জানিয়ে দেন অজিত।
এই কয়েকদিন ঢাকায় ঘোরা এই নেপালী তরুণ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘শহরটির রাস্তায় সবচেয়ে অবাক করলো যানবাহনের বিশৃঙ্খল অবস্থা। বাস-প্রাইভেট কারসহ কোন যানবাহনই ট্রাফিক নিয়ম মানে বলে মনে হলো না। উল্টো দিক থেকে আসা, ইচ্ছামত লেন পরিবর্তন এখানে সব জায়গায় দেখেছি। সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে কারণ ছাড়াই বিকট শব্দের হর্ন বাজানো। এই শব্দে আপনি অভ্যস্ত হতে পারেন কিন্তু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আপনি, শহরের শিশুরা পরিণতি এড়াতে পারবেন না।’
তিনি বলেন: শুনেছি বাংলাদেশে সরকারিভাবে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ। অথচ শহরের রাস্তায়, ড্রেনে পলিথিন-প্লাস্টিকের বোতলের স্তুপ! এখানেই প্রথম চিকুনগুনিয়ার নাম শুনলাম। আমার মনে হয় এই রোগের জন্য ড্রেন এবং ছুঁড়ে ফেলা প্লাস্টিকের বোতলে জমা পানি একটি কারণ। অপরিচ্ছন্নতা এরকম নানা রোগ ডেকে আনবে। এজন্য শুধু সরকারের আশায় বসে না থেকে নিজেরাই পরিচ্ছন্নতা কাজে নামা উচিৎ।
পরিবেশ সংরক্ষণে নেপালের শহর পোখারার মতো একটি উদ্যোগ ঢাকাসহ বাংলাদেশেও ভালো কাজে দিতে পারে বলে মনে করেন এই তরুণ।
তিনি বলেন, ‘পোখারায় আমার বাড়ি। সেখানে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা কাজে প্রশাসন এবং এলাকার তরুণদের স্বেচ্ছাসেবী দল কাজ করছে। যেখানে-সেখানে যেন ময়লা ফেলা না হয় সেজন্য তারা টহলও দেয়। আসলে শুধু আইন করে বসে থাকলে হয় না। আইন বাস্তবায়িত করতে কড়া নজরদারি দরকার।’
সমাজ সচেতনতার বার্তা দিতে এতো কিছু রেখে সাইকেল কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে অজিত বলেন, ‘এরচেয়ে পরিবেশবান্ধব বাহন আর নেই। পেট্রোল, গ্যাসের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করে আমরা খনিজ সম্পদ শেষ করে ফেলছি। আগামী প্রজন্মের জন্য কিছু তো রেখে যাওয়া উচিৎ। এজন্য বলি সপ্তাহে সবদিন না হলেও একদিন অন্তত সাইকেল চালাক শহরবাসী। এতে নিজের শরীরের অতিরিক্ত ফ্যাট যেমন পুড়বে, তেমনি বাঁচবে ফুয়েল।’
হিমালয়কন্যা নেপালের সঙ্গে বঙ্গোপসাগর কোলের বাংলাদেশের সম্পর্কটা অজিত খুঁজে পান প্রকৃতির মধ্যে।
তিনি বলেন: রাজনৈতিক সীমান্ত দক্ষিণ এশিয়ায় কৃত্রিম ভিন্নতা তৈরি করলেও নেপাল, ভারত, বাংলাদেশ প্রাকৃতিক-সাংস্কৃতিকভাবে সুতোয় গাঁথা। বৈশ্বিক উষ্ণায়নে যদি হিমালয়ের বরফ গলতে থাকে তাহলে নদীগুলো ফুলে উঠবে বন্যায় তলাবে সমতল।
ঢাকার ট্রাফিক জ্যামে, অযথা হর্নে কিছুটা বিরক্ত হলেও বাংলাদেশের সামনে পরিবেশ অক্ষত রেখে ব্যাপক আয় করার উপায় দেখছেন অজিত।
এদেশের মানুষের আন্তরিকতা এবং স্বকীয় সাংস্কৃতিক রীতি-উৎসবকে কাজে লাগানো গেলে নেপালের মতো বাংলাদেশেও প্রচুর পর্যটক আসবে বলে মনে করেন তিনি।
এই সম্ভাবনার কথা বলতে বলতেই অজিত ব্যাগ থেকে বের করেন ‘ডিসকভার নেপাল’ নামের একটি ট্রাভেল ম্যাগাজিন। ম্যাগাজিনটির পোখারা সংস্করণের তিনটি সংখ্যা প্রতিবেদকের হাতে তুলে দেন তিনি।
বাংলাদেশ থেকে এই চার নেপালী তরুণের গন্তব্য এখন মিয়ানমার। তবে এ যাত্রায় তাদের পথের সাথী সাইকেলগুলো কিছুক্ষণ আরাম পাবে বিমানের কার্গোতে। সাইকেল চালিয়ে মিয়ানমার যাওয়ার আফসোসটা থাকলেও অজিতদের বিমানেই চড়তে হবে। কারণ বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মাঝে কোনো সড়ক যোগাযোগ আপাতত নেই। সাগরে তো আর সাইকেল চালানো যায় না।