ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত নেপালের পুনর্গঠনের মতো বিশাল কর্মযজ্ঞ নিয়ে নেপাল সরকার একটি বিরক্তিকর উভয়সঙ্কটের সম্মুখীন। খুব দ্রুত সব ধরনের পুনর্নির্মাণ ও পুনর্গঠনের কাজ করার পাশাপাশি এক মাসের মধ্যে সরকারের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনতে ও নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে তাই গভীর আলোচনা চলছে।
ভূমিকম্পে যে ক্ষতিসাধন হয়েছে তা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে সরকারের শরিক বিভিন্ন দল, বিভিন্ন বিরোধী দল, বিভিন্ন মতাদর্শের গণমাধ্যমগুলোকে একত্রে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে নেপালের ৮১ বছরের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ভয়াবহতম ভূমিকম্প। দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো একত্রে কাজ করে সরকারের নেতৃত্বেও পরিবর্তন আনছে।
জাতিটির যখন সরকারি ও বেসরকারি সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেছে ও হাজারো মানুষ গৃহহীন,ঠিক তখন জোটবদ্ধ সরকার বা সব রাজনৈতিক দল খুব দক্ষ ও যুক্তিসঙ্গতভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছে। রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো সরকারের দক্ষতার সঙ্গে পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের কাজে সন্তোষ প্রকাশ করছে।
![](https://i0.wp.com/www.channelionline.com/wp-content/uploads/2024/02/Channeliadds-Reneta-16-04-2024.gif?fit=300%2C250&ssl=1)
অনেকের ধারণা বর্তমান জাতীয় ঐক্যবদ্ধ সরকার নেপালের ভয়াবহ সমস্যাটিকে খুব সহজেই চিহ্নিত করতে পারবে। কেননা জাতির পুনর্গঠনে ও সাংবিধানিক কাজে তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে কাজ করছে।
যাই হোক, বর্তমান নেতৃত্বধীন সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে কয়েকজন রাজনীতিক অবশ্য কিছু খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে তোষামোদ করছেন। নেপালের ভূমিকম্প পরবর্তী পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে কয়েকজন মানুষ নিজেদের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর পদে পরিবর্তন আনার চেষ্টাও চালাচ্ছেন। ইউএমএল’র চেয়ারম্যান কে পি ওলিকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসানোর জন্য বেশ কয়েকটি শক্তি প্রলোভন দেখিয়েছে।
প্রথমত ইউসিপিএন’র ভেতরে চেয়ারম্যান প্রচন্দ ও তার উপ চেয়ারম্যান বাবুরাম ভট্টরাইসহ তাদের কয়েকজন সমর্থক ওলিকে নতুন সরকার গঠনে উৎসাহ যোগাচ্ছেন। আর ইউএমএল’র ভেতর ওলির কয়েকজন সমর্থকসহ বেইরের কয়েকজন ভক্ত সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তনের এই আলোচনাকে আরো বাড়াচ্ছেন।
কে পি ওলির মতো একজন বিশিষ্ট রাজনীতিক কীভাবে এসবের মধ্যে জড়িয়ে পড়ছেন তাতে সবাই অবাক হচ্ছেন। গতকাল পর্যন্ত ইউসিপিকে নীচু দেখাতে ওলি সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন এবং তার আক্রমণাত্মক শব্দ অনেক মাওয়াবাদীদের মধ্যে ক্ষোভও ছড়িয়ে দিয়েছে।
অনেকেই মনে করেন, কোনো নেতারই ইউসিপিএন’র ফাঁদে পা দেয়া উচিৎ হবে না। ওলি নিজেও প্রচন্দর প্রতারণামূলক আচরণ সম্পর্কে অবগত যে প্রায়ই তার ওয়াদা ভঙ্গ করেন। ওলির মধ্যে ক্ষমতা লাভের প্রচন্ড লোভ কাজ করছে। আর তার এই লোভ তাকে ভুলিয়ে দিয়েছে নেপালের কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে তার কী চুক্তি হয়েছিল।
এমনকি বর্তমান নেতৃত্বধীন জোট সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার প্রস্তাবের বিপক্ষে থাকা ওলির নিজ দলের কয়েকজন সদস্যর সঙ্গেও তিনি তর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। সম্প্রতি ওলি উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বামদেব গৌতমের সঙ্গে বাক বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েছেন যিনি একসময় ওলিকে দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।
কিন্তু সরকার পরিবর্তনের বিষয়ে তিনি এখন আর গৌতমকে গ্রাহ্য করছেন না। গৌতমের মতে বর্তমান সরকার একটি ঐক্যবদ্ধ সরকার। কারণ বহু রাজনৈতিক দল এই সরকার ব্যবস্থায় অংশ নিয়েছে। সরকারের স্থিতিশীলতাকে কোনোরকম ব্যাহত না করে যে কোনো নতুন দল ইচ্ছে করলে এই ঐক্যবদ্ধ সরকার ব্যবস্থায় যোগ দিতে পারে।
এক অর্থে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গৌতম অধিকাংশ কংগ্রেস সদস্যর মনোভাবকে দৃঢ় কন্ঠে প্রচার করছেন। কিন্তু তার মনে হয়তো কিছুটা ভীতিও কাজ করছে। যদি সরকার ব্যবস্থায় কোনোরকম পরিবর্তন আসে তাহলে সবার আগে তিনি তার পদ হারাবেন।
যদি ওলি প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসতে পারেন তাহলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাগ অবশ্যই কংগ্রেস পার্টির নেতার কাছে যাবে। যদি সরকার ব্যবস্থায় আসন্ন রদবদল হয় এবং সরকারের নেতৃত্বে কোনোরকম পরিবর্তন আসে তাহলে অনেক মন্ত্রীই তাদের পদ হারাবেন। তাই এই মুহূর্তে মন্ত্রীদের মধ্যে অনেকেই বর্তমান সরকার ব্যবস্থায় কোনো রকম পরিবর্তন আনতে চান না।
একইভাবে দলগুলো ক্ষমতায় পরিবর্তন আনায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়লে, প্রত্যেক দলের নেতারা উচ্চ পদটি লাভ করতে উদগ্রীব হয়ে উঠবেন। আর এই ক্ষমতা লাভের লড়াই এর জন্য এই মুহূর্তে পুনর্গঠন, ত্রাণ, পুনর্বাসনসহ সংবিধান প্রণয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে দেরি হয়ে যাবে।
ইউএমএল এবং নেপালি কংগ্রেস এই দুই জোট অংশীদার দলের মধ্যকার চুক্তিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিলো শুধুমাত্র নতুন সংবিধান প্রণয়নের পরই সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হবে। এই চুক্তিটি এখন মনে করাই হয়তো মূল্যহীন।
যাই হোক, বিভিন্ন মহল, নেপালি কংগ্রেসের দায়িত্ববান নেতাদের মতামত নিয়ে ইউএমএল এবং মধ্যপন্থী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ সরকার ব্যবস্থায় এখন কোনো পরিবর্তন আনার প্রস্তাবনার বিরোধিতা করতে এগিয়ে এসেছে। তাদের বেশিরভাগেরই পরামর্শ: নতুন সংবিধান ঘোষণার পরই জাতীয় সরকার গঠন করা যেতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধানের অনেক অমিমাংসিত ইস্যুগুলো সমাধানে একটি বড় মাইলফলক অর্জন করেছে। এখন তাদের জন্য সবথেকে জরুরি বিষয় হলো সংবিধান ঘোষণা। একবার নতুন সংবিধান ঘোষণা করা হলেই পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের কাজ সহজ করার জন্য দলগুলো নতুন নেতৃত্বের অধীনে নতুন সরকার গঠন করবে।
এই সময় সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার কথা সম্পূর্ণ মূল্যহীন কেননা প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা নিজে ঘোষণাদিয়েছেন নতুন সংবিধান প্রণয়ন হলে তিনি এই ভগ্নাংশ ব্যবস্থায় দ্বিতীয় হিসেবে পদটি আঁকড়ে ধরে থাকবেন না। প্রথমে নতুন সংবিধান তৈরি হলে দলগুলাকে সংযোগকারি হিসেবে কাজ করতে হবে। তারপর দীর্ঘ ও দুরূহ কাজ হচ্ছে জাতির পুনর্গঠন।
ওলির মতো নেতাদের কখনোই সরকার পরিবর্তনে এতটা উদগ্রীব হওয়া উচিৎ নয়। কেননা নতুন সরকার পুনর্গঠন ও সংবিধান তৈরির কাজ যে নির্বিঘ্নে এগিয়ে নিয়ে যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সরকারের নতুন সদস্যদের মধ্যেও একই মাত্রায় রাজনৈতিক বিদ্বেষ থাকতে পারে।
তাই নতুন সরকার গঠনের আগে বহু অপেক্ষিত সংবিধান প্রণয়ন করতে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য প্রথমে একটি মাইলফলক অর্জন খুবই উপকারি হবে।
নারায়ণ উপাধ্যায়: উপ-নির্বাহী সম্পাদক, দি রাইজিং নেপাল
(অনুবাদ: নুসরাত শারমিন)
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)