পাবনাবাসী তাঁকে মর্যাদার সাথে স্মরণ করেছিল। এমনতর স্মরণ সমাবেশ পাবনার আর কোন ডি.সি এ যাবতকাল পাননি। কারণ এ নয় যে তিনি ১৯৭১ সালে পাবনার সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন- ছিলেন সি এস পি অফিসার এবং বাঙালী। না-এসব কারণের জন্যেও না।
নুরুল কাদের ১৯৩৫ সালের ২ ডিসেম্বর ঢাকার বিক্রমপুরের টঙ্গী বাড়িতে জন্ম নেন। মাত্র ৬৩ বছর বয়সে বিদেশের মাটিতে ইংল্যাণ্ডে তিনি তাঁর সহধর্মিনী স্ত্রী রোকেয়া কাদের এবং এক ছেলে ও এক মেয়েসহ অসংখ্য সহকর্মী-সহযোদ্ধা ও শুভাকাংখীকে রেখে মৃত্যু বরণ করেন ১৯৯৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। খবরটি রেডিও টিভিতে প্রচারিত হলে পাবনাতে শোকের ছায়া নেমে আসে। দু’এক দিনের মধ্যেই সিদ্ধান্ত হলো যত শীঘ্র সম্ভব, নূরুল কাদেরের নাগরিক স্মরণ সভা বিশাল আকারে পাবনার সকল স্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করে অনুষ্ঠিত করা হবে।
কেন এমন একটি স্মরণ সমাবেশ? কদাপি তো এমন আয়োজন পাবনাতে হয়নি। কারণ একটাই। নূরুল কাদের এমন একজন মুক্তিযোদ্ধা তিনি পাবনার জনগণ, পাবনার সকল রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, সরকারি কর্মচারী কর্মকর্তা, পুলিশ প্রধান ও পুলিশ বাহিনী, আনসার বাহিনী ও জনগণের সাথে একাত্ম হয়ে দুঃসাহসী ভূমিকা নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধকে সফল করতে নিষ্ঠার সাথে কাজ করেন। পাবনাবাসী বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা অবলম্বন করায় মাত্র তিনদিনের লড়াইয়ে ২৫ মার্চের রাতে আসা ২০০ পাকসেনাকে খতম করে ২৯ মার্চে পাবনাকে শত্রুমুক্ত করেছিল। সে এক অবিস্মরণীয় ঘটনাই ঘটে।
নূরুল কাদের ২৫ মার্চ বা ৭ মার্চের অনেক আগে থেকেই তাঁর প্রগতিশীল বামধারার চিন্তা-চেতনার ধারক ও চিন্তাশীলতা থেকে উপলব্ধি করছিলেন একটি ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকট আসন্ন। তাই তিনি যোগাযোগ রাখছিলেন সমমনা তাঁর সিনিয়র ও জুনিয়ার সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে যাঁরা উত্তরবঙ্গের নানা জেলায় ছড়িয়ে ছিলেন। উল্লেখ্য, ১৯৭০ এর শেষ দিকে তিনি পাবনা আসেন জেলা প্রশাসক হিসেবে। তাই ডি.সি. গিরির চাইতে চিন্তায় ও মননে তিনি যেন একজন দায়িত্বশীল রাজনৈতিক কর্মীই হয়ে উঠছিলেন।
তাই তিনি যোগাযোগ করতেন পাবনার প্রখ্যাত আওয়ামী লীগ নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর সাথে, রাজশাহীতে বিভাগীয় বাঙালি কর্মকর্তাদের সাথে এবং পাবনা কালেক্টরেটের নিজস্ব সহকর্মীদের সাথেও।
এক পর্যায়ে পরিস্থিতির জটিলতা উপলব্ধি করে গভীর শংকা নিয়ে তিনি ঢাকায় ছুটলেন। ঢাকায় পৌঁছেই সোজা চলে গেলেন ড. কামাল হোসেনের বাসায় সেখানে তাঁকে ছাড়াও ব্যারিষ্টার আমীর-উল-ইসলাম, রেহমান সোবহান, ড. নূরুল ইসলাম প্রমুখকে পেয়ে দীর্ঘ আলোচনা করলেন তাঁর মনের উপলব্ধি নিয়ে খোলামেলাভাবে। যেহেতু নূরুল কাদেরের পক্ষে সম্ভব ছিল না বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত পৌঁছানো বা তাঁর সাথে বসে দীর্ঘ আলোচনার তাই তিনি ঐ নেতৃবৃন্দকে অনুরোধ করলেন, আলোচিত তথ্যাদি তাঁরা যেন বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন।
দেখতে দেখতে ২৫ মার্চ এসে গেল। সারা দেশের পরিস্থিতি থমথমে। পাবনায় আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ সবাই মার্চের শুরু থেকেই ১৯৭০ এর নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী অতিসত্বর বঙ্গবন্ধুর কাছে সমগ্র পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবীতে আন্দোলন মুখর। রাজপথ সকাল-সন্ধ্যায় নিত্য দিন প্রকম্পিত। চলছিল অসহযোগ আন্দোলন।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে বলা এই অসহযোগ আন্দোলনে জেলা প্রশাসকের চেয়ারে বসেই নূরুল কাদের, তাঁর সকল সহকর্মী, কালেক্টরেটের সকল কর্মীসহ অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন আর যোগাযোগ রাখেন রাজনৈতিক নেতাদের সাথে।
এরই মুখে ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাক-বাহিনী যেমন ঢাকায় “অপারেশন সার্চ লাইট” নামে ভয়াবহ গণহত্যায় লিপ্ত হয়, তেমনই তারা একই সাথে পাবনাসহ অনেকগুলো জেলা শহরে সশস্ত্র সেনা বাহিনী পাঠায় একই ধরণের অপারেশন চালানোর উদ্দেশ্যে। পাবনাতেও ঐ রাতেই এসে পড়ে ২০০ সুজজ্জিত পাক-বাহিনী। তারা বাংলোতে এসে আত্মসমর্পণ করতে বললে অত্যন্ত সাহসের সাথে তা অস্বীকার করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি বঙ্গবন্ধু আহুত অসহযোগ আন্দোলনেরত।
পরিস্থিতির গভীরতা উপলব্ধি করেই তিনি সত্বর সরকারি বাংলো পরিত্যাগ করে পদ্মার চরের এক গ্রামে গিয়ে আস্তানা গড়েন। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, ছাত্র লীগ নেতারাও সেখানে বসে সবাই সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ যুদ্ধের খসড়া আঁকেন।
২৬ মার্চ ভোর থেকে কারফিউ জারি করা হয় পাবনা শহরে। রাস্তায় যাকেই পায়, পথচারী ও প্রাতঃভ্রমণকারী নির্বিশেষে, ধরে কোমরে দড়ি বেঁধে আর্মি প্রতিষ্ঠিত হেডকোয়ার্ড পানি উন্নয়ন বোর্ডে নিয়ে আটকে রাখা ও মারাত্মক নির্যাতন করা হয়।
২৬ মার্চ সকাল থেকে তরুণেরা গোপনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অস্ত্র সংগ্রহ করতে থাকেন। বন্দুক, রাইফেল, পিস্তল যার যা ছিল সবাই তা দিয়েও দেন লড়াই এ সহযোগিতার স্মরক হিসেবে।
ঐ দিন সন্ধ্যায় নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থারত আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট আমিন উদ্দিন, ন্যাপনেতা ডা. অমলেন্দু দাক্ষী, ব্যবসায়ী, শিক্ষকসহ নেতৃস্থানীয় কয়েকজনকে গ্রেফতার করে একই জায়গায় নিয়ে আটক করে নির্যাতন শুরু করা হয় এবং তা ২৯ মার্চ সকল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
চরের আশ্রয় গ্রহণকারী নেতারা ও ভিসি নূরুল কাদের গোপনসূত্রে জানতে পারেন পুলিশকে নিরস্ত্র করতে পাবনার পুলিশ অস্ত্রাগার দখল নিতে পাক সেনারা পুলিশ লাইন আক্রমণ করবে। নূরুল কাদের পরিকল্পনা নেন পথেই তাদেরকে আক্রমণের। সেই অনুযায়ী সন্ধ্যার যথেষ্ট আগেই, ২৭ মার্চ তারিখে পুলিশ, আনসার ও যুব ছাত্ররা বন্দুক তাক করে পুলিশ লাইনের নিকটবর্তী জেলখানা, হেড পোস্ট অফিস, বার লাইব্রেরি ও জজকোর্ট বিল্ডিং এর ছাদে অবস্থান নেন।
মাগরিবের নামাজ এরপর সারাটি শহর টা টা শব্দে কেঁপে উঠছিল। আওয়াজ দু’পক্ষে ব্যাপক গোলাগুলির। ট্রাকে করে পাক-সেনারা পুলিশ লাইন আক্রমণ করতে আসার পথে প্রবল প্রতিরোধে ফলে সকল পাক সেনা ট্রাকে করেই পালিয়ে যায়। হতাহতও হয় বেশ কিছু। পাবনাবাসীর প্রথম বিজয় এভাবেই সূচিত হলো। প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ও পাবনা বাসীর আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল।
পুনরায় পরিকল্পনা করা হলো, পুরাতন টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনে যে ২৮ জন আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত পাক-সেনা অবস্থান করছে তাদেরকে আক্রমণ করার। ২৮ মার্চ ভোরেই ঐ টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনের চতুর্দিককার দালান সমূহের ছাদে অবস্থান নিয়ে অসীম সহসী প্রতিরোধ যোদ্ধারা বেলা ১০ টার দিকে গুলি ছুঁড়তে শুরু করলে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ঐ জরাজীর্ণ ভবনের ফাঁক ফোঁকড় দিয়ে অবিশ্রান্ত গুলি ছুড়তে থাকে। ঘন্টাখানেক তুমুল যুদ্ধের পর হঠাৎ সেনাদের দিক থেকে আর কোন আওয়াজ না পাওয়াতে বুঝা গেল তাদের গুলির পুঁজি শেষ। বিলম্ব না করে প্রতিরোধ যোদ্ধারা দরজা ভেঙ্গে ঢুকেই কয়েকটি লাশ দেখতে পায়। বাদ বাকী সেনাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। ২৮টি পাক-সেনাই খতম হলো। শহরে ও পার্শ্ববর্তী গ্রাম সমূহে শুরু হয় বিজয়োল্লাশ ছড়িয়ে পড়ে জীবনাশংকা বাদ বাকী সৈন্যদের মনে।
২৯ মার্চ সকাল অনুমান ১০ টা। পাবনার অকালে চক্কর দিতে দেখা যায়। নীচে থেকে তরুণেরা প্রচুর গুলি বর্ষণ করলেও সেগুলি বিমানকে আঘাত করতে ব্যর্থ হয়।
অপরদিকে নাটোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে কয়েকটি ট্রাক ভর্তি সাদা পোশাকে পাক-সেনা সাদা পতাকা উড়িয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা মুখে “জয় বাংলা” শ্লোগান দিতে দিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সামনে দাঁড়ানো মাত্রই সেখানে অবস্থানরত পাক-সেনারা দ্রæত পোটলা পুটলি নিয়ে ট্রাকে উঠে ছুটতে থাকে। বুঝা গেল বিমানটি এসেছিল ঐ বাহিনীকে ধরতে পড়াবৎ দিয়ে পালাতে। আর ট্রাকে করে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে পাক-সেনারা পাবনা থেকে তাদের পাহারা দিয়ে প্রত্যাহার করে নিয়ে যেতে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই প্রতিরোধ সংগ্রামী তরুণেরা বিষয়টি বুঝে ফেলে। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরী করে। ফলে গতি স্তিমিত করতে হয়-থামতেও হয়। এই সুযোগে পথে পথে পাক-সেনারা পলায়নপর অবস্থায় আক্রান্ত হতে থাকে-এবং মরতেও থাকে। ট্রাকগুলি কোন ক্রমে যখন গোপালপুর গিয়ে ততক্ষণে ড্রাইভারসহ সকল পাক-সেনা খতম। এভাবে ২৯ মার্চ সন্ধ্যার পর পরই পাবনা প্রথম বারের মত মুক্ত হয়।
দু’দিন পর হাইকম্যান্ড চর থেকে এসে পাবনা পুরাতন টেকনিক্যাল স্কুল ভবনের দোতলায় হাই কমান্ডের অফিস চালু করা হয়। তরুণদেরকে আইন শৃংখলা রক্ষা, গ্রামে গ্রামে যুবকদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পুলিশ ও আনসারদেরকে দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে শহরবাসী দলে দলে গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেন।
৩০ মার্চ হঠাৎ করে আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট আমজাদ হোসেনকে ও আমাকে ডেকে পাঠানো হয়। গ্রামে গিয়ে ছিলাম পরিবার পরিজনকে রাখতে। খবর পেয়ে উভয়েই নতুন কার্যালয়ে যেতেই জেলা প্রশাসক নূরুল কাদেরের সাথে দেখা।
তিনি দুজনকে আলাদা করে এবং পরে একত্রে বলেন, আমাদেরকে ভারতে যেতে হবে সেখানকার সেনা প্রশিক্ষক ২০/২৫ জন এবং কিছু ভারী অস্ত্র আনতে যাতে দ্বিতীয় দফার পাকিস্তানী আক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়। তবে কোথায় কেন যাচ্ছি তা যেন পরিবারসহ আর কেউ না জানতে পারে। দুজনের প্রত্যেকের হাতে ধরিয়ে দিলেন পাকিস্তানী ৫০ টাকার একটি করে নোট।
৩১ মার্চ রওনা হয়ে ১ এপ্রিল কোলকাতা পৌঁছলাম। আমার খুড়তাত দাদা পরিমল মৈত্রের কালি ঘাটের বাসায় পৌঁছে কমরেড ইলা মিত্র, কমরেড রমেন মিত্র ও কমরেড বিশ্বনাথ মুখার্জীর সাথে যোগাযোগ করলে বিশ্বনাথ মুখার্জীর নিজে ড্রাইভ করে মুখ্য মন্ত্রী অজয় মুখার্জীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে আমরা পাবনার পরিস্থিতি সবিস্তারে তাঁকে জানাই যে কারণে এসেছি তাও। সব শুনে মুখ্যমন্ত্রী এবং পাশে বসে থাকা ডেপুটি মুখ্য মন্ত্রী বিজয় সিং নাহার বললেন, বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের আওতাধীন তবে প্রাদেশিক সরকারের মত কেন্দ্রীয় সরকারও বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাঁরা দিন কয়েক সময় চাইলেন ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলাপ করতে ঘটনাগুলি জানাতে এবং তাঁদের মতামত জানতে।
ইতোমধ্যে ১০ এপ্রিল পাবনার দ্বিতীয় দফা পতন হলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সহ নূরুল কাদের পশ্চিম বঙ্গ চলে যান। সেখানে মুজিবনগর সরকারের অধীনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। এভাবে তিনি প্রশাসক থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধায় পরিণত হন সবার অকুণ্ঠ ভালবাসায় সিক্ত হন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)