নাম পিটার কাস্টার্স। বাংলাদেশের বাম ও জাসদ রাজনীতিতে একটি পরিচিত নাম। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে জাসদ রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার কারণে আওয়ামী লীগের বিরাগভাজন হন। অনেকে বলে থাকেন জাসদকে সেই সময়কার মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রুরা অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিল। আসলে জাসদের বড় বন্ধু ছিলেন এই পিটার কাস্টার্স। তিনি ইউরোপের বামপন্থী সংগঠনগুলোর সঙ্গে জাসদের যোগাযোগ সেতু ছিলেন (তার ভাষায়)। বামপন্থী বিপ্লবীদের নানাভাবে তিনি সহযোগিতা করতেন। তিনি মৌলানা ভাসানির একজন অন্ধ ভক্ত ছিলেন, ভাসানির উপর লেখা তার একটি বইও মনে হয় প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও ৭ নভেম্বরের উপর তার গবেষণাধর্মী লেখা আছে। লন্ডনে প্রকাশিত হওয়ার কথা।
১৯৯২ সালে আমি বিপ্লবী ছাত্র সংঘের আহবায়ক থাকা অবস্থায় প্রয়াত শ্রদ্ধেয় কৃষক নেতা আব্দুস সাত্তার খানের (দাদু ) মাধ্যমে পরিচয় হয়। এরপর বিপ্লবী ছাত্র সংঘ ও ছাত্র ঐক্য ফোরাম (মিশু) ও ছাত্র ঐক্য ফোরাম (জায়েদ) এই তিন ছাত্র সংগঠন ঐক্য কাউন্সিল করে নতুন ছাত্র ঐক্য ফোরাম নামে আত্নপ্রকাশ করলে বর্তমান গারমেন্টস শ্রমিক নেত্রী মোশরেফা মিশু সেই ছাত্র ঐক্য ফোরামের সভাপতি ও আমি সাধারণ সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হই। সেই ঐক্য কাউন্সিলে পিটার কাস্টার্স উপস্থিত ছিলেন। পিটার কাস্টার্সের সেই উপস্থিতি নিয়ে তখন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হয়। এমনকি তৎকালীন সংসদেও আলোচনা হয়। তখন বিএনপি সরকার ক্ষমতায়। দৈনিক পত্রিকাগুলো পিটার কাস্টার্সকে রাজনীতির রহস্যপুরুষ হিসেবে প্রচার করলে তৎকালীন সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ তৎপর হয়ে উঠে। ফলে পিটার কাস্টার্স এই দেশে আর থাকতে পারেননি। তখন থেকেই পিটার কাস্টার্সের সাথে পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা হয়। পরে অবশ্য তিনি বাংলাদেশে এসেছেন।
১৯৭৪ সালে তিনি একবার গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং পরে ডাচ দূতাবাসের কূটনৈতিক তৎপরতায় ছাড়া পান। এরপর ১৯৯২ সালের আগে আর বাংলাদেশে আসেননি। যতোদূর জানি প্রায় সকল বামপন্থি সংগঠন ও শ্রমজীবী সকল ধরনের রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের সাথে এই পিটার কাস্টার্সের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। একবার নেদারল্যান্ডস থেকে আমাকে চিঠি দিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশের নদী নিয়ে যত গান আছে তার একটি ক্যাসেট করে পাঠাতে। সেই সাথে ভাওয়াইয়া ও পল্লীগীতি।
এই ডাচ মানুষটি চমৎকার বাংলা বলতে ও লিখতে পারতেন। বিয়ে করেছিলেন একজন কলকাতার বাঙ্গালী মেয়েকে। যে কারণে তার সাথে এদেশের সকল নেতৃবৃন্দ বাংলায় আলোচনা করতে পারতেন ও সহজেই ভাব প্রকাশ করতে পারতেন। এরশাদ সরকারের সময় ফ্লাড একশন প্ল্যান নামে ২০ হাজার কোটি টাকার ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের একটি প্রজেক্ট হাতে নেয়া হয়েছিল। সেই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের সকল নদী এতদিনে মরে যেত। এই পিটার কাস্টার্সের সহযোগিতায় জার্মানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উপস্থিতিতে একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সেই সেমিনারে মোশরেফা মিশু ও প্রয়াত সাত্তার খানসহ অনেক নেতা বাংলাদেশের ক্ষতিকর এই কর্মসূচীর বিরোধিতা করে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকও তাদের বক্তব্য হাজির করে। কিন্তু ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বাংলাদেশের বক্তব্য সমর্থন করেছিলো। এইভাবে বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে পিটার কাসটারের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা ছিল।
ছাত্র রাজনীতি ছাড়ার পর এই মানুষটির সাথে আমার আর যোগাযোগ হয়ে উঠেনি। আজ হঠৎ লন্ডনে বসবাসরত ৯০’র আন্দোলনের ছাত্রনেতা আখতার সোবহান মাসরুর ও ছাত্র ঐক্য ফোরামের সাবেক সহ সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন লাভলুর ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে পিটার কাস্টার্সের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে অনেক স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে। সেই সাথে মনে পড়ে যাচ্ছে তার মুখ থেকে শোনা বাংলাদেশের রাজনীতির অনেক না লেখা ঐতিহাসিক ঘটনা ও ইতিহাস।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)