পাকিস্তান কখনোই অতীত থেকে শিক্ষা নেয়নি এবং অবস্থাদৃষ্টিতে যা মনে হচ্ছে সেক্ষেত্রে পরিষ্কার ও নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে ভবিষ্যতেও বোধকরি তারা সে শিক্ষায় শিক্ষিত হবে না কিংবা সে সম্ভাবনাও একেবারে নেই।গতকালই পাকিস্তানী বিভিন্ন সংবাদ পত্রের মাধ্যমে জানা গেলো যে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের মাধ্যমে দণ্ডপ্রাপ্ত শীর্ষ একাত্তরের ঘাতক মতিউর রহমান নিজামীকে পাকিস্তান তাদের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত করবার জন্য আয়োজন শুরু করেছে।
এই পুরো ঘটনাতে আমার বিষ্ময় ও আনন্দ দুটি প্রতিক্রিয়া-ই সমানতালে রয়েছে। বিষ্ময় রয়ে গেছে এই কথা ভেবে যে শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই নয় বরং সারা পৃথিবীতেই সন্ত্রাসী ও জঙ্গীদের দেশ বলে কুখ্যাতি পাওয়া পাকিস্তান শোধরায়নি এবং সেটি শোধরাবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা কিংবা লক্ষণ এই দেশটির মধ্যে নেই। আর আনন্দের ব্যাপারটি আমাদের এই বিচার ব্যবস্থা ও চলমান এই বিচার নিয়ে প্রোপাগান্ডার ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে।
কেননা, এই বিচারের বিরুদ্ধে যে মিথ্যে প্রচারণা অভিযুক্তদের রাজনৈতিক দল বার বার করে আসছিলো “ডিউ-প্রসেস” কিংবা বিচারের “স্বচ্ছতা” কিংবা অভিযুক্তদের অপরাধের “সত্যতা” নিয়ে, সেগুলোর উপর একটা তীব্র চপেটাঘাত হচ্ছে পাকিস্তানের এই ঘোষণা। এতে করে শুধু বাংলাদেশের সকলেই নন বরং সারা বিশ্বে এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে, “এই উল্লেখিত আদালতে যারা বিচারের কাঠগড়ায় অভিযুক্ত হয়েছিলো তারা সকলেই মূলত পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাহীনির-ই অংশ”। যদিও এই ব্যাপারটি-ই তারা বার বার মিথ্যে বলে সকলের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিলো।
আপনারা জেনে থাকবেন যে বাংলাদেশের এই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের শুরু থেকেই পাকিস্তান পুরো বিচার প্রক্রিয়া বা বিচারের আয়োজনকে বিরূপ চোখে দেখেছে। সেটি অবশ্য পাকিস্তানের দেখবারই কথা। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের যে বর্বরতম অত্যাচার ও নিপীড়নের ইতিহাস রয়েছে সেটিতে বোধকরি এটি বলবার অপেক্ষা রাখে না যে, পাকিস্তান এই বিচার প্রক্রিয়াকে বানচাল করবার চেষ্টা করবেই। এই বিচারকে পাকিস্তান দেখছে তাদের সেনাবাহিনীর একটি অংশের বিচার হচ্ছে, এই রকম একটি বোধকে নিজেদের ভেতর স্থান দিয়ে।
বিচারিক ক্ষেত্রের যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সেটির কথা বিবেচনায় আনলে এটা পাকিস্তানের জন্য শুধু বিব্রতকরই নয় বরং এটাও চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া যে, যে বিচার পাকিস্তানের শুরু করবার কথা ছিলো আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার দশক আগে সেটি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পর করে এটিই বুঝিয়ে দিয়েছে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতির সাথে বাংলাদেশ আপোষ করতে জানে না। বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের বিচার হবেই।
আরেক শীর্ষ একাত্তরের ঘাতক কাদের মোল্লার দণ্ড কার্যকরের পর থেকেই মূলত পাকিস্তান একেবারে প্রকাশ্যে এসে এই বিচারের বিরোধীতা করেছে যদিও বিচারের বিরোধিতা মিশনে পাকিস্তান এই বিচারের প্রাক কথনের কাল থেকেই যুক্ত ছিলো বিভিন্ন ভাবে। কাদের মোল্লার ফাঁসির পর পর একটা গুজব রটিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয় যে “এই কাদের মোল্লা মূলত সেই কাদের মোল্লা না” কিংবা “কসাই কাদের আলাদা ব্যক্তি আর কাদের মোল্লা আলাদা ব্যাক্তি”।
এই রকম একটা অবস্থাতে যখন বিচারের দাবিকারী এক্টিভিস্ট ও বিচারবিরোধী ব্যাক্তিদের একটি উত্তেজনা চলছিলো ঠিক তখনি পাকিস্তানের পার্লামেন্টে কাদের মোল্লার জন্য শোক প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং কাদের মোল্লার পক্ষে পাকিস্তানে চলতে থাকে তীব্র প্রচারণা। এতে করে বাংলাদেশে যারা এই কাদের সেই কাদের না বলে মিথ ছড়াতে চেষ্টা করেছিলো তাদের সেইসব উৎসাহে ব্যাপক ভাটা পড়ে যায়। কেননা পাকিস্তান এই কাদের শোক প্রস্তাব আনয়নের মধ্য দিয়ে স্পস্ট করে দিয়েছিলো যে কাদের মোল্লা মূলত পুরো দস্তুর একজন পাকিস্তানের চর ছিলো ও একাত্তরে পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে মিলে নারকীয় হত্যাকাণ্ডের অংশীদার ছিলো।
কাদের মোল্লা তার মামলা চলাকালীন সময়ে বার বার দাবী করেছিলো যে মুক্তিযুদ্ধের সময় সে ফরিদপুরে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছিলো এবং তারো কিছু আগে সে কাপড়ের ব্যবসা ও লজিং শিক্ষক হিসেবে নিজেকে সে সময় নিয়োজিত করেছিলো। কাদের মোল্লার এই দাবিকেই তার রাজনৈতিক দল জামায়াত ইসলামী সামনে এনে সে ব্যাপারে এই প্রজন্মের কাছে প্রচারণা চালিয়েছিলো।
মজার ব্যাপারটি হয়েছিলো তখন, যখন কাদের মোল্লার ব্যাপারে পাকিস্তান বলতে শুরু করলো যে পাকিস্তানের পক্ষে থাকার জন্যই কাদের মোল্লার ফাঁসি দেয়া হয়েছে, কাদের মোল্লা পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে গিয়েই সে সময় মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলো। পাকিস্তানের এই দাবির সাথে সাথেই কিন্তু আদতে কাদের মোল্লা আদালতে যে বক্তব্য দিয়েছিলো নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা সাজিয়ে সেই বক্তব্যকে স্বংক্রিয়ভাবে খারিজ করে দেয়।
আরো লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে কাদের মোল্লা নিজেকে এতবড় মুক্তিযোদ্ধা বল্লেও পাকিস্তানের এই দাবির ক্ষেত্রে তার দলের কিংবা পরিবারের কেউ কখনো প্রতিবাদ করেনি। এতে করে খুব সহজেই একটি সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে যে কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে পাকিস্তান যা বলেছে সেটিই সঠিক এবং আদালতে দেয়া তার মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নেয়ার নানাবিধ জবানবন্দী মিথ্যে। একজন ব্যাক্তি যে দাবি করেছে যে একাত্তর সালে সে ছিলো তার নিজ অঞ্চল ফরিদপুরে এবং মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছে তাকে যখন পাকিস্তানের বন্ধু বানিয়ে পাকিস্তান বিবৃতি দেয়, তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না আসল ঘটনা।
এজন্যই আমি উপরে বলেছি যে এই ট্রাইবুনালের এক একটি রায়ের পর, পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া আমাদের আসলে অনেক উপকারই করে দিচ্ছে। এখানে আরেকটি বিশেষ ব্যাপার আমাদের লক্ষ্য করতে হবে যেটি পাকিস্তানের দাবির পর আমাদের জন্য আরো বেশী সহজ হয়েছে বুঝবার জন্য। সে টি হচ্ছে জামায়াত সব সময় দাবি করত যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন-১৯৭৩ শুধু মাত্র করা হয়েছে ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য, এই আইন তাদের নেতাদের বিচার করবার জন্য করা হয়নি কিংবা এটি বাংলাদেশী কারো জন্য প্রযোজ্য নয়।এই কথাটি তারা অসংখ্যবার বলেছে, তাদের নেতারা বিভিন্ন টিভি টকশো, বিবৃতি এমনকি আদালতে গিয়েও বলেছে।
আবার অন্যদিকে পাকিস্তানের দাবি কিন্তু এই দাবি থেকে আলাদা। তারা জামায়াতের ওই দাবিকে কখনোই রেকোগনাইজ-ই করছে না। তারা দাবি করছে যে, জামাত নেতাদের বিচার বাংলাদেশ করতে পারেনা, কেননা ১৯৭৪ সালের ত্রি-দেশীয় চুক্তি অনুযায়ী এই মুক্তিযুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক নানাবিধ অপরাধেরর বিচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে এবং বিচার করবে না বলে বলেছে।
আমি যদি পাকিস্তানীদের বক্তব্য আমলে নেই, তাহলে তাদের কথার বক্তব্য যেটি দাঁড়ায় তা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধে নানাবিধ আন্তর্জাতিক অপরাধ এই জামাতীরা ঠিকই করেছে, কিন্তু ১৯৭৪ এর চুক্তির ফলে এটা নিয়ে আর বিচার বাংলাদেশ করতে পারেনা। তারমানে এখানে স্বীকারোক্তি দুটো:
প্রথমটি হচ্ছে- ১৯৫ জন আর্মি অফিসার যাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে তারা যুদ্ধাপরাধী এবং একই সাথে জামাতের অভিযুক্তরাও একই অপরাধে দোষী। (ক্ষমার প্রশ্ন যেহেতু আসছে সেহেতু অপরাধ স্বীকার না করলে ক্ষমার প্রসঙ্গটিও আসে না)
দ্বিতীয়টি হচ্ছে, জামাতের নেতারা একাত্তরে অপরাধ করেছে ঠিকি, কিন্তু ১৯৭৪ সালের ত্রি দেশীয় চুক্তির ফলে এই জামাত নেতাদের বিচারও করা যাবে না। পাকিস্তান কিন্তু কখনোই বলেনি যে এই আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন-১৯৭৩ এর আওতায় জামাত পড়ছে না। তারা এইসব অভিযুক্তদের অপরাধী স্বীকার করে নিয়েই কিন্তু ৭৪ সালের চুক্তিটির প্রসঙ্গ আনছে। সুতরাং পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এইসব দাবিতে অপরাধের স্বীকারোক্তিটা পরিষ্কার হয়েছে।
নিজামীর ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক দেবার পুরো ব্যাপারটি পাকিস্তান ভাবছে এক ধরনের প্রতিশোধ নেবার মত করে। তারা ভাবছে যে লোকটি পাকিস্তানের জন্য নিজের জান কোরবান করে দিলো সেই লোকের বিচার করছে বাংলাদেশ আর এটি বাংলাদেশ তার অতীত ভুলতে পারছেনা, এমন অবস্থা থেকেই হয়েছে। এইসব চিন্তা থেকেই বোধকরি পাকিস্তান এই ধরনের অনৈতিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
পাকিস্তান সব সময় চায় তাদের সেই বর্বর আক্রমণের কথা আমরা ভুলে যাই। এই জন্যই কথায় কথায় তারা বলে অতীত ভুলে সামনে তাকাতে হবে। ৩০ লক্ষ কিংবা তারও বেশী শহীদ কিংবা ৪ লক্ষ কিংবা তারো বেশী নির্যাতিত নারী ও শিশু কিংবা এক কোটি শরণার্থী আর দূর্ভোগের কথা ভুলে গিয়ে পাকিস্তানের হাত ধরে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবলে পাকিস্তান খানিকটা স্বস্তি পায়।
রক্ত মাখা হাত ধরে ব্যবসা বাণিজ্যের কথা, শান্তির আলোচনা হলে আসলে খুনীদের জন্য অস্বস্তিটা কম হয়। কেই বা চায় তার কৃত নৃশংস অপরাধকে সামনে নিয়ে আসতে? পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও সেটি হয়েছে। আর হয়েছে বলেই পাকিস্তান আজও সারা পৃথিবীতে একটা সন্ত্রাসীদের রাষ্ট্র, জঙ্গীদের রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেছে।
১৯৭৪ সালে যখন ত্রি-দেশীয় চুক্তিটি হয় সেটির ১৫ নাম্বার অনুচ্ছেদে খুব পরিষ্কারভাবে লেখা রয়েছে যে বাংলাদেশ পাকিস্তানী অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারটি চালাবে না। যেখানে বলা রয়েছে- the Foreign Minister of Bangladesh stated that the Government of Bangladesh has decided not to proceed with the trials as an act of clemency
এবং ১৩ নাম্বার অনুচ্ছেদে বলা রয়েছে যে-
The Foreign Minister of Bangladesh stated that the excesses and manifold crimes committed by these prisoners of war constituted according to the relevant provisions of the U.N General Assembly Resolutions and International Law, war crimes, crimes against humanity and genocide, and that there was universal consensus that persons charged with such crimes as the 195 Pakistani prisoners of war should be held to account and subjected to the dues process of Law. The Minister of State for Defense and Foreign Affairs of the Government of Pakistan said that his Government condemned and deeply regretted any crimes that may have been committed.
এই দুটো অনুচ্ছেদের টেক্সটগুলো সামনে নিয়ে এসেছি একটি কারনেই যে বাংলাদেশ এই বিচার চালাবে না বললেও পাকিস্তানে এই অপরাধীদের বিচার করা যাবেনা কিংবা করবে না এই কথাটি এই চুক্তির কোথাও নেই বরং চুক্তিতে বার বার বাংলাদেশ যাতে ফাফ করে দেয় এই অপরাধীদের সে অনুকম্পাই বার বার চাওয়া হয়েছে। আপনারা লক্ষ্য করে দেখুন যে ১৩ নাম্বার অনুচ্ছেদে পাকিস্তান কিন্তু স্বীকার-ই করে নিচ্ছে তাদের অপরাধের কথা। আর খোদ পাকিস্তানের হামুদুর রহমান কমিশনও তাদের তদন্তে পাকিস্তানী এইসব আর্মি অফিসারদের অপরাধের কথা স্বীকার করেছে।
এতসব অপরাধের কথা স্বীকার করেও একটি রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যেই কিন্তু পড়ে যায় বিচারের ব্যাপারটি। এটি এই ক্ষেত্রে পরিষ্কার যে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে যে সকল আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘঠিত হয়েছিলো সেগুলোর বিচার করা আন্তর্জাতিক ভাবে বিভিন্ন চুক্তি কিংবা মানবাধিকার রক্ষাকল্পের সিগ্নেটোরী রাষ্ট্র হিসেবে শুধু বাংলাদেশের দায়-ই কেবল নয় বরং বাধ্যতামূলক ভাবে এই বিচার করাটা ছিল পাকিস্তানের দায়িত্ব। এটি আন্তর্জাতিক ভাবে এখন মোটামুটি ভাবে স্বীকৃত যে আন্তর্জাতিক যে সকল অপরাধ রয়েছে তথা যে অপরাধগুলোকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের অধীনস্থ করা হয়েছে সেসব অপরাধ “Jus Cogens” [জাস কোজেন্স শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বাধ্যকারী আইন] থিওরীতে বিবেচ্য হবে সুতরাং এই বিবেচনা অনুযায়ী এইসব অপরাধের বিচার করাটা একটি রাষ্ট্রের জন্য অনেক বড় দায়। এই অপরাধগুলো যে “জাস কোজেন্স” এর-ই অংশ সে সিদ্ধান্তে উপনীত হবার জন্য যথেষ্ঠ আইনি ভিত্তি বিদ্যমান রয়েছে ।
এই আইনী ভিত্তি চারটি কারণে প্রমাণিত হতে পারে-
১) International Opinio Juris (এই অপরাধগুলো সাধারণ প্রথাগত আইনের অংশ তার স্বীকৃতির ই প্রতিফলন )
২) এই অপরাধ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি
৩) যেসব কনভেনশন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দেশ দ্বারা সমর্থিত হয়েছে
৪) যে সমস্ত অপরাধের দায়ে দোষী ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে পরিচালিত তদন্ত ও মামলা গুলো ব্যাপক ভাবে সমর্থিত হয়েছে ।
এই জাস কোজেন্স থিওরীর সাথে আরেকটি থিওরী এখানে আলোচনার দাবি রাখে। যেটিকে বলা হয় “অবলেগেটিও এরগা ওমনেস” [Obligatio Erga Omnes] যার সরল মানে দাঁড়ায় অবশ্য পালনীয়। সুতরাং আন্তর্জাতিক অপরাধ গুলোর ক্ষেত্রে এই জাস কোজেন্স আর এরগা ওমনেস দু’টি প্রিন্সিপাল আসলে খুব সহজেই বলে দেয় এইসকল অপরাধের বিচার করবার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কতটুকু দায় রয়েছে সেটি। শুধু যে এইসব আলোচ্য থিওরীকে কেন্দ্র করে যে কেবল দায় বর্তায় তাও কিন্তু নয়। একটি সভ্য রাষ্ট্র অপরাধ হলে বিচার করবে এটাই স্বাভাবিক এবং সেটা হওয়াও বাঞ্ছনীয়। সুতরাং এই বিচার করবার জন্য রাষ্ট্র জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পর্যায়, সকল ক্ষেত্রেই বাধ্য।
পাকিস্তান তো তাদের রাষ্ট্রীয় দায়ত্ব পালন করেই নি বরং বাংলাদেশ যখন তাঁর দেশের ভেতরের একাত্তরের ঘাতকদের (যাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক নানাবিধ অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে) বিচার শুরু করেছে ঠিক তখনই তারা এইসব বাঁধা দেয়া শুরু করে দিয়েছে। একের পর এক তারা তাদের পার্লামেন্টে সকল কূটনৈতিক নিয়ম নীতির বাইরে গিয়ে এইসব অপরাধীদের পক্ষে শোক প্রস্তাব এনেছে, প্রতিবাদ মিছিল, মিটিং ও সমাবেশ করেছে। এমনকি তারা এই পুরো ব্যাপারটি জাতিসংঘে তুলবে বলেও ঘোষণা দিয়েছে। সারা পৃথিবীর সামনে পাকিস্তান নির্লজ্জের মত এইটুকুই বুঝিয়ে দিতে চাইছে যে তারা আসলে কিভাবে সন্ত্রাসীদের মদদ দেয় ও আশ্রয় দেয়।
সাম্প্রতিক সময়ের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলেই দেখতে পাব যে বিশ্বের বড় একজন সন্ত্রাসী ওসামা বিন লাদেন কিন্তু এই পাকিস্তানেই গোপনে লুকিয়ে ছিলো এবং তাও সেটি তাদের মিলিটারি ট্রেনিং বেস কাকুল এর একদম কাছেই। এইরকম অসংখ্য জঙ্গী, সন্ত্রাসীদের পাকিস্তান বরাবরই প্রোমোট করে আসছে, তাদের আশ্রয়দাতা হিসেবে নিজেদের সূচিত করেছে।
বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেঃ মতিউর রহমান যখন পাকিস্তান থেকে একটি বিমান নিয়ে তাঁর প্রিয় বাংলাদেশে উড়ে আসতে চাইলেন দেশ মাতৃকার টানে তখন ওই একই প্লেনে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরের সাথে থাকা শিক্ষানবীস রশীদ মিনহাজ মতিউরকে বাঁধা দেয় এবং একটা পর্যায়ে প্লেনটি ধ্বংস হয়। এই ঘটনার পর মুক্তিযুদ্ধের সময়ই রাজাকার নিজামী এক বিবৃতিতে ৩০ শে আগস্ট দৈনিক সংগ্রাম ‘আমরা গর্বিত’ নামে সম্পাদকীয় ছাপে। সেই সম্পাদকীয়তে লেখা হয়ঃ
“পাকিস্তান বিমান বাহিনীর পাইলট অফিসার রশীদ মিনহাজ জাতির জন্য নিজের জীবন কোরবানী দিয়ে দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধের এক অত্যুজ্জ্বল নিদর্শন আমাদের সামনে রেখে গেলেন। পাকিস্তান সরকার সাহসিকতার জন্য পাকিস্তানের সর্বোচ্চ খেতাবে নিশানে হায়দার দিয়ে মরহুম মিনহাজকে সম্মানিত করছে। মরহুম মিনহাজের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের কাহিনী যখন আমরা শুনেছি তখন আমাদের বুক গর্বে আনন্দে ভরে উঠেছে।”
এই আনন্দে ভ’রে ওঠা মনের অধিকারী নিজামী মুক্তিযুদ্ধের এত বড় পরাজয়ের পরেও নির্লজ্জের মত বাংলাদেশে থেকে গেছে। তার দল জামাতের হেডকোয়ার্টার পাকিস্তানে কিংবা “পাকিস্তান আল্লাহর” ঘর এই ঘোষনা দিলেও সে আল্লাহর ঘরে নিজামী চলে যায়নি বরং এই বাংলাদেশেই এই নির্লজ্জ লোকটি এতটা বছর কাটিয়ে দিয়ে গেছে।
মানসিকভাবে এক ভীনদেশীর মূল দেশ পাকিস্তান তাকে তার অপরাধের পুরষ্কার হিসেবে সে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক দিচ্ছে এতে করে ক্ষোভের যে কিছু নেই আমি আগেও বলেছি বরং ব্যাপারটি আমার জন্য অনেক স্বস্তির।
এই বিচার নিয়ে চলা এতো প্রোপাগান্ডায় যে সময়টা আমরা দিচ্ছিলাম এদের অপরাধের ব্যাপারগুলো সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে সেটি আমাদের জন্য আরো সহজ হয়ে গেলো। পাকিস্তান নিজের কাঁধে সে দায়িত্ব তুলে এই অপরাধের সাথে তাদের প্রমাণের সর্বোচ্চ পদক্ষেপটিই নিয়েছে, এই ঘটনা থেকে এটিই মূলত পরম পাওয়া বলে আমি মনে করি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)