চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

নিউ ইয়র্কে কোরবানি (ভিডিও)

ক্যাপ্টিভ বোল্ট পিস্তল। এই ধরণের পিস্তলের নাম আগে কখনো শুনিনি। নিউ ইয়র্কের কোরবানি দেখতে যেয়ে এই পিস্তলের বিষয়ে অনলাইনে খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করার পর ক্যাপ্টিভ বোল্ট পিস্তল সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়। এটি জবাইয়ের আগে পশুকে কিছুক্ষণের জন্য অজ্ঞান করার কাজে ব্যবহৃত হয়।

এটা আমার কাছে নতুন কিছু বলে মনে হয়েছে। যদিও ইন্টারনেটে দেখলাম ড. হুগো হেইস এটি উদ্ভাবন করেন ১৯০৩ সালে। এখন এর বেশ কয়েকটি উন্নত সংস্করণ বেরিয়েছে। নিউইয়র্কের মুসলমানেরা সাধারণত দুইভাবে কোরবানি করে থাকে। এক. মাংসের দোকানে অর্ডার দেওয়া হয় এবং দোকানি মাংস কেটেকুটে রেডি করে দেয়। দুই. নিজে ফার্ম হাউজে যেয়ে কোরবানি দেওয়া এবং মাংস নিজে অথবা কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী কেটে নিয়ে আসা।

গত বছর মানে ২০১৪ সালে কোরবানি দেখার জন্য পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে উডহ্যাভেন এর জামাইকা এভিন্যু থেকে রওনা হলাম। সময় তখন ভোর রাত ৪টার মত। গন্তব্য অনেক দূর কানেক্টিকেট, নিউ ইয়র্কের পার্শ্ববর্তী স্টেট।

গাড়িতে জিপিএস অনুযায়ী যেতে সময় লাগবে দুইঘর মত। কানেক্টিকেট পৌঁছানোর পর খুব শীত অনুভূত হলো। মোবাইলে আবহাওয়া আপডেট-এ দেখলাম ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। কিন্তু নিউ ইয়র্ক থেকে রওনা হবার সময় তাপমাত্রা ছিল ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস, শীতবস্ত্রের প্রস্তুতিও ছিল সেই অনুযায়ী।

গাড়ি থেকে নেমে কিছুক্ষণের মধ্যেই শীতের প্রকোপে আবার গাড়িতে ফিরে বসে থাকলাম। অথচ অনেকেই এই শীতে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। বুঝলাম আমার ব্রেনের হাইপোথ্যালামাস এখনো এই ঠান্ডায় ধাতস্থ হয় নি। সূর্য ওঠার পর বোঝা গেল কানেক্টিকেট এর এই ফার্ম হাউজটি জংগলের মধ্যে, হাইওয়ে থেকে কয়েক মাইল ভিতরে। জংগলের মধ্যে খুব সুন্দর রাস্তা, এখানকার রাস্তাঘাট সবই সুন্দর। গাছে তখন হলুদ পাতা।

কানেক্টিকেট আমেরিকার সবচেয়ে দক্ষিণের তৃতীয় ক্ষুদ্রতম স্টেট, আয়তন ১৪৩৫৭ বর্গকিলোমিটার। অর্থনৈতিকভাবেও সমৃদ্ধ, ২০১৩ সালের আমেরিকার এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী মিলিয়নিয়ারের সংখ্যায় স্টেটের মধ্যে কানেক্টিকেট রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে। এই কানেক্টিকেট এ জন্মগ্রহণকারীদের মধ্যে রয়েছেন আমেরিকার ৪১তম এবং ৪৩তম প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ এবং জর্জ ডব্লিউ বুশ, তিনবার একাডেমী এওয়ার্ড বিজয়ীখ্যাত অভিনেত্রী মেরিল স্ট্রিপ। বিশ্বখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েনও এক সময়ে বসবাস করতেন কানেক্টিকেট-এ।

যাই হোক, এসব ভাবতে ভাবতেই সূর্যের উষ্ণ অভিবাদনে সাড়া দিতে গিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে হেঁটে চলে গেলাম ফার্ম হাউজের মূল জায়গাটিতে, যেখানে কয়েকশত মুসলমান কোরবানি দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। এদের মধ্যে বাংলাদেশীদের সংখ্যাও কম নয়। ফার্ম হাউজের একটি ঘের দেওয়া জায়গায় অনেকগুলো গরু রাখা আছে। গরুগুলোর গায়ে নাম্বারও দেওয়া, যাতে বোঝা যায় কার বা কাদের গরু কোনটা।

ফার্ম হাউজের জায়গাটি অনেকটা পাহাড়ি ঢালের মত। ফার্ম হাউজের চারপাশে সুপরিসর রাস্তা, তারপাশেই কিছুটা সমতল ভূমি, যা ব্যবহার করা হয়েছে পার্কিং প্লেস হিসাবে। কোরবানি করা শুরু হয়েছে সেই ভোর রাত থেকেই। আমাদের দেশে কোরবানির পশু জবাই করে থাকেন বিশেষ কিছু ব্যক্তি, এদের বেশির ভাগই মসজিদের ইমাম কিংবা মাদ্রাসার শিক্ষক। কিন্তু এখানে সবাই নিজের পশুকে নিজে জবাই করতে হচ্ছে।

কিন্তু সবচেয়ে ব্যতিক্রমী ঘটনা দেখা গেল, পশুটিকে জবাই করার জন্য শোয়ানোর ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে গরুকে জবাইয়ের জন্য সে কী হুর-হাঙ্গামাই না পোহাতে হয়! গরুর পায়ে দড়ি পেঁচিয়ে গরুকে শোয়ানোর নানা কৌশল অনেকেই দেখে থাকবেন। এখানে তা নেই। গরুকে কিছুক্ষণের জন্য অজ্ঞান করতে ব্যবহার করা হয় ক্যাপ্টিভ বোল্ট গান। গরুর কপাল বরাবর এই রাইফেলের স্টিলের বুলেট তীব্রভাবে আঘাত করলে, সাথে সাথেই গরু মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আর তখনই গরুটিকে নিয়মানুযায়ী শুইয়ে জবাই করে ফেলা হয়। দলবদ্ধভাবে সবাই এই কাজটি করছেন।

গরুটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ার সাথে সাথে যারা কোরবানি করবেন, তারা দৌঁড়ে গরুর কাছে ছুটে যাচ্ছেন এবং তাদের মধ্যে একজন দ্রুত জবাইয়ের কাজটি করছেন। এভাবেই চলছে। জবাইয়ের পর গরুগুলোকে বুলডোজারে ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় কাটার জন্য। পুলির সাহায্যে ঝুলিয়ে চামড়া ছাড়িয়ে তারপর কাটা হয়। কাটার জন্য ব্যবহার করা হয় ইলেকট্রিক কড়াত।

এখানে গরুর দাম দেশের তুলনায় একটু বেশি। মাঝারি সাইজের গরুর দাম ২০০০-২২০০ ডলার। পুরো গরুর কাটিং চার্জ ২৫০-৩০০ ডলার। একটি গরুকে শুধু ৪ পিস করে নিলে কাটিং চার্জ ৫০ ডলার। একটা বিষয় উল্লেখ করার মতো, তা হল- এই ফার্মে কোরবানির জন্য যারা কাজ করছে তারা সবাই একই পরিবারের সদস্য। ভাই, ভাবী, বোন, ননদ, শ্বাশুড়ি, শ্বশুর সবাই মিলে কাজে নেমেছে কোরবানির চাপ সামলাতে।

কোরবানিতে অন্তত দুইদিনব্যাপী সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত কাজ চলে। দৈনিক অন্তত ৩০টির মত গরু প্রসেস করার কাজ চলে। গরুর জন্য আগেই অর্ডার নেওয়া হয়। গরু প্রসেসের পুরো বিষয়টির মধ্যে রয়েছে শতভাগ পেশাদারি মনোভাব।

সবচেয়ে অবাক হয়েছি, পশুর চামড়া নিয়ে এদের কর্মকাণ্ড দেখে। চামড়া নিয়ে আমাদের দেশে কত রকম কাণ্ড কারখানাই ঘটে! অথচ এখানে কোরবানির পশুর চামড়া মাটিচাপা দেওয়া হচ্ছে অন্যসব বর্জ্যের সাথে। চামড়ার মত এমন একটি অর্থকড়ি পণ্যের এহেন পরিণামের কারণ খুঁজতে যেয়ে কোন যৌক্তিক উত্তর পেলাম না।

আসলে সব কাজের পেছনে যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না, যুক্তিযুক্ত কারণ নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সেই কারণ খোঁজার সময় কোথায়? কে দেবে এত সময়? কোথায় পাব আমি এত সময়? সবাই এখানে ব্যস্ত, ছুটছে, যে যার মতো। আমাকেও আপাতত ছুটতে হবে তাদের কারো সাথে, তাদের কাউকে আকঁড়ে ধরে।