ডাকাডাকির পর সোহানের দলে একজন কম পড়লো। দূরে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলো মিলি। সোহানের সমবয়সী। হুট করে সোহান বলে উঠলো, ‘মিলি আমার দলে খেলবে।’
সবাই অবাক হয়ে তাকালো। মিলি আবার ক্রিকেট পারে নাকি? সোহান ইচ্ছে করে দুর্বল দল নিচ্ছে যাতে হারলে একটা অজুহাত দেখাতে পারে।
মিলি এমনিতেই একটু চুপচাপ। ও চুপ করে হেঁটে এসে সোহানের দলের সবার সাথে দাঁড়ালো।
এবার টসের পালা। হারলো সোহান। পাড়ার খেলায় টসে হারা মানেই তো ফিল্ডিং।
মিলিকে স্লিপে দাঁড় করালো সোহান। মজার ব্যাপার হলো, হাত দুটোকে ফুলের মতো করে ক্যাচ ধরার প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো মিলি। পুরো খেলায় বল যা দু একবার এলো, তা ওই ফুল বানানো হাতে ধরা পরলো না।
বড় টার্গেট। কে আগে ব্যাট করবে তা নিয়ে তুফান বয়ে গেল। সোহান আর শিশির ওপেন করছে। সালেহ বললো, আমি খেলব-ই না। রিটায়ার্ড হার্ট। বলেই ওর ব্যাটটা নিয়ে চলে গেল। একে একে সবাই আউট হতে হতে যখন খেলা প্রায় শেষ, তখন মনে পড়লো, মিলি তো আছে!
সোহান বললো, ‘মিলি, ব্যাটিংয়ে নাম’।
মিলি ব্যাটটাকে বৈঠার মতো করে ধরে উইকেটের সামনে দাঁড়ালো। কারও হাসি আর থামে না। এমনিতেই মেয়েটার গায়ের রং চাপা, কষ্টে আর রোদে যেন আরও কালো লাগছিলো ওকে।
খেলায় ১০ বলে দরকার ১৮ রান। জগতে অবাক করা অনেক কিছুই হয়। এ পাড়াতেও হলো আজ। মিলি আন্দাজে ব্যাট চালিয়ে ৮ রানের ইনিংস খেললো। তা ক্রিকেট হলো কি না জানা নেই, তবে রান তো রানই।
সোহানরা ম্যাচ জিতলো। এবার বাসার পথে সোহান আর মিলি। বাসায় পৌঁছেই সোহান উল্লাসে ফেটে পড়লো, ‘মা, ও মা, আমরা না আজকে ম্যাচ জিতেছি’।
মা আঁচল দিয়ে সোহানের ঘাম মোছাতে মোছাতে বললেন, ‘তুমি তো জিতবেই সোনা’। সোহান মুখটা সরিয়ে বললো, ‘আরে আমি তো শূণ্য করেছি। মিলি ৮ রান করে জিতিয়েছে’।
মায়ের মুখ থেকে মমতাটা উধাও হয়ে অদ্ভুত এক কাঠিন্য দেখা দিলো। সোহানও মায়ের এই রূপটা ভয় পায়। ‘তোকে খেলার জন্য পাঠিয়েছি মাঠে? পানির বোতলের পানি তো শেষ হয় নি। দিস নি সোহানকে? মিলি ভয়ে ভয়ে বলে,
‘দিসিলাম, ভাইয়া খায় নাই’। ‘খাবে কিভাবে? তুই তো রান করা নিয়ে ব্যস্ত ছিলি।তোকে পাঠানোই আমার ভুল হয়েছে। যা,পেঁয়াজ কাট্। আর বাবুসোনা, টেবিলে যা। পড়তে বস এক্ষনি।’
সোহানের বাবা অফিস থেকে ফিরেই ঘোষণা দিলেন। আজ নারী দিবস উপলক্ষে স্পেশাল ডিনার। নামী একটা রেস্টুরেন্টে।
সোহানের বাবা, মা আর সোহান সেজে-গুজে, ফিটফাট হয়ে রওনা দিলো। বাসায় রইলো মিলি একা। আজকের খাওয়াটা সোহান কোনদিন ভুলবে না। এত আইটেম! খুশিতে খুশিতে মা কে বললো, ‘মা, মিলি এগুলো খাবে না’?
মা বললেন, ‘সে চিন্তা তোমার করা লাগবেনা। অ্যাই ওয়েটার, যা বেঁচে গেছে তা প্যাকেট করে দিন। আরে আরে, চিকেন ফ্রাইয়ের ওই পিসটা দিচ্ছেন না কেন? ওটাতো সোহান একটু ছিড়ে খেয়েছে’! প্যাকেট আসে। সোহানের মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। এই খাবার কি মিলির জন্য? বাবা বিল দিয়ে গাড়ি ডাকে।
ফেরার পথে সোহান জিজ্ঞেস করে, ‘বাবা, নারী দিবস কাদের জন্য? এটা কি শুধু মায়ের জন্য? জন্মদিন টাইপ?
বাবা হেসে বলে, ‘না রে বাবা, পৃথিবীর সব মেয়েদের সম্মান জানাতে আর কাজের স্বীকৃতি দিতে নারী দিবস। এই দেখো না, তোমার মা যে দিনরাত পরিশ্রম করে রান্না- বান্না করে, ঘর ঠিক রাখে, সংসার সামলায় এর স্বীকৃতি হিসেবেই তো আজকে এই আয়োজন’।
সোহান অবাক হয়ে বলে,’বাবা, তুমি যেসব কাজের কথা বললে, ওগুলো তো সব মিলি করে। তাহলে ওরও কি আজ নারী দিবস’?
পুরোটা পথ চুপ থাকে বাবা- মা দুজনই। সোহানের হাতে ঝুলছে উচ্ছিষ্ট খাবারের প্যাকেটটা।
শুভ নারী দিবস।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)