নারী নির্যাতন একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি, এ ব্যাধি থেকে কোন নারীরই রেহাই নেই। হোক সেটা প্রাপ্ত বয়সে কিংবা অপ্রাপ্ত বয়সে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের সেলিব্রেটি নারীরা বিভিন্ন সময়ে পুরুষ কর্তৃক তাদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছেন সংবাদমাধ্যমে। অর্থাৎ সকল শ্রেণি, পেশা, ধর্ম, বর্ণ এবং গোত্রের নারীরা জীবনের কোন একটা সময়ে যে কোন উপায়ে নির্যাতনের শিকার হতে পারে এবং হচ্ছেও। শারীরিক, মানসিক, আর্থিকসহ অন্যান্য নানা উপায়ে নারীদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের মহড়া দেখা যায় আমাদেরই তথাকথিত সভ্য সমাজে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, পারিবারিক সহিংসতার জের ধরে জানুয়ারি-মার্চ ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ৪৪ জন নারী তাদের স্বামীদের দ্বারা নিহত হয়েছেন। যৌতুকের কারণেও স্বামীদের দ্বারা নির্যাতনের কারণে নিহত হচ্ছে নারীরা এবং অনেকেই জঘন্যভাবে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, পারিবারিক মর্যাদা ও সামাজিক অবস্থানের কারণে নারী নির্যাতনের ঘটনা হরহামেশাই খবরের শিরোনামে আসে না। তবে মাঝে মধ্যে নারী নির্যাতনের দু-একটি ঘটনা আমাদের সমাজের বাস্তব চিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে সহায়তা করে থাকে। আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, প্রত্যেক ঘরেই নারীদেরকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। বেশ কয়েকজন নারীর সাথে কথা বলে জানা যায়, বিয়ের পর প্রথম ২-৩ বছর নির্যাতনের শিকার হতে হয় না এমন মেয়ের সংখ্যা খুবই কম। নতুন একটি জায়গায়, ভিন্ন পরিবেশে নতুন মানুষজনের সাথে খাপ খাওয়ানোর পূর্বেই নানাভাবে সদ্য বিবাহিতা মেয়েকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
শুরুর রেশ ধরে সংসারিক জীবনের উপর সদ্য বিবাহিতাদের বিরক্তি চলে আসে, পরিবারের সিনিয়র সদস্যদের ব্যাপারে খারাপ ধারণা ও ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। ফলশ্রুতিতে সাংসারিক জীবনে পারিবারিক অশান্তি নিত্যনৈমিত্তিক উপাদানে পরিণত হয়। প্রকৃতঅর্থে, আমাদের মেয়ে কিংবা বোনও অন্যদের ঘরে বউ হয়ে যাওয়ার পরে নির্যাতনের শিকার হতে পারে এ কথাটি আমরা ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করার অবকাশ পাই না। তাইতো নিজেদের ঘরে বউ হয়ে আসা অন্য পরিবারের একটি মেয়েকে শুরুতেই নানাবিধ উপায়ে যন্ত্রণা দেওয়ার ফর্মুলার বন্দোবস্ত নিজেরাই করে থাকি। কাজেই নারী নির্যাতনের প্রক্রিয়া সাংসারিক জীবনের শুরুতেই হয়ে থাকে এবং দীর্ঘসময় সে প্রক্রিয়া চলমান থাকে। পাশাপাশি মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মাঝে যৌতুকের অবসান এখনো হয়নি, কিন্তু কাগজে কলমে আমাদের দেশে যৌতুকের হার শূন্যের কোঠায়। পূর্বে ঘোষণা দিয়ে যৌতুক আদায় করা হতো, বর্তমানে অঘোষিতভাবে তথা ন্যাক্কারজনক উপায়ে যৌতুক আদায় করা হয়ে থাকে। তবে এর বিশেষত্ব হচ্ছে বিষয়টা অপ্রকাশিত থাকে, গোপনে, আড়ালে-আবডালে যৌতুক লেনদেন করা হয়ে থাকে। বিষয়টা এমন, বিয়ের পর হতে নানারকম গিফট সামগ্রী দিয়ে মেয়েপক্ষদের দ্বারা ছেলেপক্ষকে খুশি রাখার বিশেষ প্রচলন দেখা যায় বর্তমান সভ্য সমাজে।
নারী নির্যাতন বলতে শুধু নারীর ওপর শারীরিক নির্যাতনকে বোঝায় না। শারীরিক নির্যাতন যে নেই সে কথা বলা যাবে না, তবে মানসিক নির্যাতনের ভয়াবহ পরিণতি দেখা যায় প্রত্যেক পরিবারে। পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অধিকাংশ পরিবারেই নারীদেরকে তেমন একটা পাত্তা দেওয়া হয় না। বিষয়টা এমন, উত্তরাধিকার সূত্র ধরেই পরিবারের ছেলেরা অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করে থাকে। বর্তমানে বেশিরভাগ শিক্ষিত পরিবারের নারীরা চাকরিতে নিযুক্ত রয়েছেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অধিকাংশই তেমন কোন গুরুত্ব পাচ্ছেন না। এমনও দেখা যায়, নারীরা যদিও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে তথাপি নারী হওয়ার কারণে পরিবারে তাদের কোন সিদ্ধান্তকে তেমন আমলে নেওয়া হয় না। তবে সব পরিবারে যে এমন দেখা যায় তা আমি বলছি না, তবে অধিকাংশ পরিবারের চিত্রই এমন। অস্বীকার করার সুযোগ নেই, এখনো বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা অত্যন্ত প্রকট।
সম্প্রতি কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলায় চার সন্তানের জননীকে সামাজিক বিচারের নামে প্রকাশ্য জনসম্মুখে মধ্যযুগীয় বর্বর কায়দায় নির্যাতন করা হয়। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সরগরম ও আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে অবাক করার মতো বিষয় হলো, বৈঠকে উপস্থিত কোন মানুষই এ রকম ভয়াবহ নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেনি। স্থানীয় চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে পৈশাচিক উপায়ে পিটিয়ে আসমা আক্তারের পুরো শরীর থেতলে দেওয়া হয়েছে। আসমা আক্তারের বিরুদ্ধে তার দেবর ভাসুররা পরকীয়ার অভিযোগ তুলে দ্রুতগতিতে স্থানীয় বিচারের মুখোমুখি করে এবং আদিম যুগের নির্মমতায় আসমা আক্তারকে নির্যাতন করা হয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আসমা আক্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণের পূর্বেই যেভাবে নির্যাতনের মুখোমুখি করা হলো বিষয়টি কোনভাবে মেনে নেওয়া যায় না। যদি অভিযোগ প্রমাণিত হতো তাহলে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার মুখোমুখি করে শাস্তি দেওয়া সমীচিন ছিল। তা না করে আধুনিক ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকা স্বত্ত্বেও থানা পুলিশের দ্বারস্থ না হয়ে প্রশ্নবিদ্ধ সালিশের মাধ্যমে বিচার করাটাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
যেভাবে সংঘবদ্ধ উপায়ে ঘটনার সারসংক্ষেপ দেখা যায়, ঘটনাটি যে পূর্বপরিকল্পিত সে বিষয়ে কারোর সন্দেহ থাকতে পারে না। পারিবারিক কলহ ও হিসাব নিকাশের বিচ্যুতি এবং ব্যক্তিক আক্রোশের জের থেকেই এ ঘটনার সূত্রপাত। নির্যাতিতার স্বামী বিদেশে থাকেন, ৪ ছেলেমেয়ে নিয়ে তাদের সুখের সংসার। দেবর ভাসুররা একজোট হয়ে সংগ্রামী মহিলাটিকে সমাজের মধ্যে ঘৃণ্যভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য যে হীনপন্থা অবলম্বন করেছে তা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে। তবে প্রকৃত সত্য উদঘাটিত হবে পুলিশের তদন্তে। তবে নির্যাতিতা যদি প্রকৃত অর্থেই দোষী সাব্যস্ত হতো তাহলে প্রথমেই পারিবারিকভাবে তার স্বামীকে অবগত করার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করা হতো, বিষয়টা সামাজিকভাবে উত্থাপিত হতো না। তাছাড়া নির্যাতনের সময় উপস্থিত থাকা চেয়ারম্যানও পরবর্তীতে স্বীকার করেছেন পারিবারিক কলহের রেশ ধরেই মহিলাটিকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।
এখন কথা হচ্ছে, একজন দায়িত্বশীল জনপ্রতিনিধি হয়ে কোনভাবেই তিনি এ ঘটনায় দায় এড়াতে পারেন না। কারণ, নির্যাতনকালীন সময়ে তিনিও উপস্থিত ছিলেন, তিনি কোনরূপ ইতিবাচক ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। ঘটনার কার্যকারণ অনুসন্ধান না করেই তৎক্ষণাৎ যেভাবে আসমা আক্তারকে নির্যাতন করা হয় তার জন্য চেয়ারম্যানকে বিচারের মুখোমুখি করা হলে সামাজিক বিচার ব্যবস্থার নামে সমাজে যা হচ্ছে তার ব্যাপারে খোলাসা ধারণা পাওয়া যাবে নিঃসন্দেহে।
নির্যাতিতার বোনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে (০৫ জন আসামী) পুলিশ দুইজনকে আটক করেছে, বাকিদের গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। প্রত্যাশা থাকবে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দ্রুত দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করা। পাশাপাশি বিচারের সময় উপস্থিত জনতা বিশেষ করে চেয়ারম্যানসহ দায়িত্বশীল সকলকে জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় এনে বিভিন্ন মেয়াদে তাদেরকে শাস্তি ও জরিমানা নিশ্চিত করা। তাহলে সামাজিক দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ পাবে না কোন সচেতন মানুষ। কারণ, দায়িত্বশীল মানুষদের অবহেলার কারণে সমাজে নানরূপ বিশৃঙ্খলা ও অপরাধকর্ম সংঘটিত হয়ে যাচ্ছে। বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করে দীর্ঘমেয়াদী নজির স্থাপনের জন্য বিচার করতে হবে, পরবর্তীতে যেন এরূপ অপকর্মের জন্য তদ্রুপ শাস্তির বিধান রাখা যেতে পারে।
আমাদের মেয়েরা পড়াশোনায় এগিয়ে যাচ্ছে, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সরকার পুরস্কারসহ মর্যাদাকর সম্মাননা অর্জন করছে। মেয়েদের কর্মসংস্থান হচ্ছে প্রতিনিয়ত, দেশের বাইরেও আমাদের মেয়েরা পেশাগত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে। এ সব কিছুই বুমেরাং হয়ে যাবে; যদি আমরা সম্মিলিতভাবে সমাজ থেকে নারী নির্যাতনের ভয়াবহতাকে কমিয়ে আনতে না পারি। তবে নারী নির্যাতন বন্ধে গৃহীত পদক্ষেপ শুরুতেই পরিবার থেকেই নিতে হবে। পরিবারে নারী ও মেয়েদেরকে যথাযথ সম্মান দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করতে হবে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীদের সিদ্ধান্তকে মূল্যায়ন করতে হবে। নারীদেরকে প্রতিপক্ষ মনে না করে সহযোগী হিসেবে প্রত্যেকটি কাজে সুযোগ করে দেওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সামাজিকভাবেও নারীদের জন্য ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সরকারকে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে, অপরাধীদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই নারী নির্যাতনের মতো ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি থেকে সমাজ থেকে রাষ্ট্রকে নিরাপদ রাখা সম্ভবপর হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)