ব্রিটেনে বোরখা নিষিদ্ধ করার দাবি অনেক দিন ধরেই চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে সেটি আরো তীব্রতর হয়েছে। তবে এটাকে ‘অত্যাচার’ ও ‘উগ্র পুরুষ জাতীয়তাবাদ’ বলে মন্তব্য করেছেন একজন ব্রিটিশ নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদ।
আর ব্রিটিশ দৈনিক ‘ডেইলি এক্সপ্রেসে’ এক লেখায় লেবার পার্টির একজন এমপি বোরখা নিষিদ্ধ করতে আইন জারির দাবি করেছেন। বোরখা নিষিদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব নারী দিবসে ব্রিটেনে শুরু হয়েছে তীব্র বোরখা বিতর্ক।
ব্রিটেন জুড়ে চালানো এক জনমত জরিপে দেখা যায়, জরিপে অংশ নেওয়াদের দুই-তৃতীয়াংশ বোরখা নিষিদ্ধে পক্ষে। তবে অনেকে এই দাবিকে নারীদের পদানত করার জন্য পুরুষদের পক্ষ থেকে আরোপিত একটি অত্যাচারী উপায় হিসেবে দেখছেন।
নিরাপত্তার কথা বলে পুরো মুখ ঢেকে বোরখা পড়া এরই মধ্যে নিষিদ্ধ করেছে ইউরোপিয়ান দেশ ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইটালি এবং নেদারল্যান্ডস। তবে প্রবল জন দাবি থাকা সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার তা এখনো আমলে নিতে অস্বীকার করেছে।
নারী দিবস উপলক্ষে লেখা কলামে সাংসদ নাটল বলেন, লিঙ্গ সমতা আরো বিস্তারের জন্য সময় হয়েছে বোরখা নিষিদ্ধের।
তিনি বলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই যে মুখে ঘোমটা পড়া নিষিদ্ধ করা উচিত। কারণ আপনি যেকোনো জায়গায়, যেমন শপিং সেন্টার, পৌর ভবন এবং পেট্রোল স্টেশনে পরিচয় অস্পষ্ট রাখে এমন ঘোমটা, হেলমেট বা এ জাতীয় কিছু পড়ে যেতে পারেন না।’
তিনি আরো বলেন, স্বাভাবিকভাবেই এটা বোঝা যায় যে, যেখানে ফটো আইডি প্রয়োজন হয়, সেখানে পর্দা করলেও তো নারীকে মুখ দেখাতে হবে।
নারীদের কর্মজীবনের বিভিন্ন দিকের কথা উল্লেখ করে পল নাটল বলেন, আমি উদ্বিগ্ন যে কর্মজীবন পছন্দ এবং কাজের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অযথা একটি ঘোমটা পড়ে কেন সীমাবদ্ধ থাকতে হবে।
তবে বোরখা নিষিদ্ধ বিরোধীরা বলেছেন, মুখ ঢেকে বোরখা পড়া নিষিদ্ধ করা হলে নারীদের অধিকার বঞ্চিত করার পাশাপাশি তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা দমন করা হবে।
ইউকিপ নেতা লুইসি বোরিসসহ অন্যদের দাবি, অনেক নারীই স্বেচ্ছায় বোরখা বা এ জাতীয় পোশাক পড়ে। পুরুষদের জোরাজুরির কারণে পড়ে এমনটা নয়। সুতরাং এটা নিষিদ্ধ করা হলে তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হবে।
গত কয়েক বছরে বোরখা নিষিদ্ধ করতে ব্রিটিশ সরকারের কাছে বেশ কয়েকটি আবেদন জমা পড়েছে। সর্বশেষটি জমা দেওয়া হয় গত জানুয়ারিতে। যাতে ২০ হাজারের বেশি মানুষের স্বাক্ষর রয়েছে।
ব্রিটিশ আইনানুযায়ী কোনো বিষয়ে জন আবেদন জমা পরলে লিখিতভাবে তার জবাব দেওয়া বাধ্যতামূলক। সেই জবাবের অংশ হিসেবে সরকার বলেছে, জনবহুল এলাকায় মানুষ কি পোশাক পড়বে সেটা দেখার ব্যাপারে সরকার কোনো প্রয়োজন মনে করছে না।
এতে আরো বলা হয়, ব্রিটেনের ঐতিহ্য অনুযায়ী আমরা মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সুবিচার নিশ্চিতে অঙ্গীকারবদ্ধ।
২০১০ সালে ফ্রান্সে যখন প্রথম ‘মুখ ঢাকা পোষাক’ নিষিদ্ধ করে তখন তা ইউরোপে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি করে। ইউরোপে ফ্রান্সই ছিলো প্রথম দেশ যারা এ ধরণের পদক্ষেপ নেয়।
ফ্রান্সে কেবল বোরকা নয়, মুখ ঢাকা যে কোনো পোশাক, মুখোশ, বালাক্লাভা, হেলমেট বা হুড–যা পরিচয় গোপন রাখতে সহায়তা করে, তা নিষিদ্ধ।
ফ্রান্সের আইনে বোরখা পড়লে ৩২ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে। এর বিরুদ্ধে ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত পর্যন্ত গিয়েছিল ফ্রান্সের মুসলিমরা। কিন্তু তাদের চেষ্টা সফল হয়নি। মুসলিমদের আবেদন নাকচ করে দেন আদালত।
ফ্রান্সের পথ ধরে ২০১২ সালে বেলিজিয়ামে একই ভাবে নিষিদ্ধ করা হয় বোরখা। নেদারল্যান্ডসের স্কুলগুলোতে ২০০৭ সালে বোরখা বা মুখ ঢাকা নেকাব নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা পরে অন্যান্য প্রকাশ্য স্থানেও কার্যকর করা হয়েছে। স্পেনের বার্সেলোনাতেও মার্কেট বা পাবলিক বিল্ডিংগুলোতে বোরখা নিষিদ্ধ।
ইউরোপের পথ ধরে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ সেনেগালে বোরখা নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করার পর অনেকেই বিস্মিত হয়। বিষয়টি বড় বিতর্ক সৃষ্টি করে সেদেশে।
সেনেগাল ছাড়া মধ্য আফ্রিকার তিন দেশ শাদ, গ্যাবন ও কঙ্গোতে বোরখা নিষিদ্ধ। আফ্রিকিার আরেক দেশ ক্যামেরুনের কেবল দেশটির উত্তরাঞ্চলে বোরখা নিষিদ্ধ করেছে।
তবে ইউরোপ-আফ্রিকার বিপরীত অবস্থানও রয়েছে। কামাল আতাতুর্কের সময় থেকে তুরস্কে বহু দশক ধরে বোরখা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ২০১৩ সালে রিচেপ তায়েব এরদোগানের ক্ষমতাসীন এ কে পার্টি সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।
সিরিয়াতেও বোরখা পড়ার বিরুদ্ধে নানা রকম নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবে ২০১১ সালে সেখানে শিক্ষকদের নেকাবে মুখ ঢাকার অনুমতি দেওয়া হয়। তিউনিসিয়াও ২০১১ সালে মাথা এবং মুখ ঢাকার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।