চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

নাম নিয়ে নজরুল

ছোটবেলায় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ছড়া শুনেছিলাম- “নজরুল/ তুমি করেছ ভুল/ দাড়ি না রেখে রেখেছ বাবরি চুল।” শুধু মুসলমান হিসেবেই নয়, ‘নজরুল’ শব্দের শেষ অক্ষরের (syllable) সাথে ‘চুল’ ও ‘ভুল’ দিয়ে ধ্বনি মিল ঘটে বলেই হয়তো প্রচলিত ছড়াতে এরকমটি বলা হয়েছিল।

তবে এই বাবরি চুল একবার বেশ কাজেই লেগেছিল। বন্ধুদের সাথে কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছিলেন ঢাকায়। কিন্তু থাকবেন কোথায়? সঙ্গী সবাই হিন্দু, তাদের কোনো আত্মীয় তো আর মুসলমান নজরুলকে রাখবেন না। বন্ধুরা ঠিক করলেন, হিন্দু পরিচয়েই তাকে কোথাও গছাতে হবে। স্বাস্থ্যবান নজরুলের গায়ে ছিল গৈরিক বেশ, চুলও তেমনি সন্ন্যাসীর মতো বড়ো। বুদ্ধদেব বসু তার ভগ্নিপতির বাসায় নজরুলকে নিয়ে গেলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন বেলূড় মঠের সন্ন্যাসী বলে, নাম ‘রামানন্দ’।

সত্যিই নজরুলকে দেখতে লাগছিল বিবেকানন্দের শিষ্যের মতো। আর যেহেতু হিন্দুধর্মের অনেককিছুই জানতেন, তাই তার কথা-কাজে বাড়ির লোকের মনে সন্দেহ তো হয়ইনি বরং সবাই দ্রুতই এই সন্ন্যাসীর প্রতি ভক্তিপরবশ হয়ে উঠলেন। ‘রামানন্দ’ নামে নজরুলের এই আনন্দপূর্ণ সময়ের স্মৃতিচারণ করে রমেন দাস বলেছেন “রাজার হালে কাটতে লাগলো তার ‘বাবাজী-জীবন’।”

নাম নিয়ে মজা করা করি মনে হয় সব দেশেই কম-বেশি আছে। কখনো কখনো তা নামওয়ালার কাছে সাজা মনে হয়। অনেক সময় নির্মল হাসিরও কারণ হয়। যেমনটি নজরুল করতেন। সম্পাদক পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন নজরুলের প্রিয়বন্ধু ও খাঁটি ভালমানুষ; ভালবেসে ‘পবিত্র’র পরিবর্তে তাকে ডাকতেন প্রিয় ও পবিত্রের ব্যঞ্জনা টেনে ‘পিওর’ (pure) বলে। আরেক প্রিয়বন্ধু সাহিত্যিক, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনকে বলতেন ‘মোতিহার’।

চরিত্র ও সম্পর্কের কারণে এদুটো নামকরণ হয়তো সার্থকই ছিল। আরেক সম্পাদক-বন্ধু আফজল-উল হককে আফজলের পরিবর্তে ‘ডাবজল’ ডাকাটাও সেই অর্থেই গ্রহণ করা যায়- বন্ধুতো ডাবের পানির মতোই মিষ্ট ও সুফলদায়ক। তবে দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফকে যে ‘জিরাফ’ বলতেন, তা শুনে আজরফ সাহেবের শরীর-স্বাস্থ্য বিষয়ে ধারণা করা ঠিক হবে না, কারণ মানুষটি ছিলেন ছোটোখাটো- এটি নিছকই নামের সঙ্গে মিলিয়ে রসিকতা।

এবার ‘সওগাত’ পত্রিকার এক আড্ডার কথা। নজরুল-বন্ধু নলিনীকান্ত সরকারকে গান গাওয়ার জন্য সবাই ধরে বসেন। নলিনীকান্ত শোনান শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের ‘মরি হায় হায় রে/ কলকাতা কেবল ভুলে ভরা’ গানটি। কলুটোলায় কলু নেই- আছে আমদানি করা তেল, মুরগিহাটায় শুধু স্টেশনারি দোকান, হাতি বাগান বা বাদুড় বাগানের নাম সংশ্লিষ্ট প্রাণির দেখা মেলে না; ইত্যাকার অসঙ্গতির কথাই বলা হয়েছিল গানে। গানটি শেষ হতেই নজরুল ‘সওগাত’ সম্পাদক নাসিরউদ্দীনকে লক্ষ্য করে প্যারোডি রচনা করে গেয়ে ওঠেন:

শির নাই যার ঘাড়ের ওপর তাকেই বলে না-শির
দেখি নাসিরউদ্দীনের ঘাড়ের ওপর মস্তবড় শির।
মরি হায় রে কলকাতা কেবল ভুলে ভরা ॥

অন্নদাশঙ্কর রায়ের সাথে নজরুলের প্রথম পরিচয় অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের বিয়ের অনুষ্ঠানে। অন্নদাশঙ্কর ছড়া-কবিতা-গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ সবই লিখতেন। তাই একজন জিজ্ঞেস করেন, “অন্নদাশঙ্কর রায়, আপনি আজকাল কী লিখছেন?” রসিকতা করে নজরুল জবাব দেন, ‘অন্নদাশঙ্কর রায় রায় লিখছেন।” উল্লেখ্য, সরকারি চাকুরে অন্নদাশঙ্কর ছিলেন শাসক-বিচারক।

নাম-পদবি নিয়ে এরকম বুদ্ধিদীপ্ত সরল রসিকতা ছাড়াও প্রয়োজনে তিক্তক্ষিপ্ত নজরুল তীর্যক ব্যঙ্গও করতেন। যেমন বিদ্রোহীমূলক কবিতা লেখার দায়ে তাকে জেলে যেতে হয়েছিল। হুগলি জেলের জেল-সুপারের নাম ছিল থার্সটোন। আচার-ব্যবহারের কারণে নজরুল তার নাম দিয়েছিলেন ‘হার্সটোন’ (harsh-tone)- মানে কর্কশ কণ্ঠ। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের গানের প্যারোডি করেছিলেন এই সুপারকে উদ্দেশ্য করে ‘সুইপার-বন্দনা’ শিরোনামে।

পত্রিকা সম্পাদনা করতে গিয়ে সরকারের সমালোচনা করে অনেক নামশব্দ ব্যঙ্গাত্মকভাবে ব্যবহার করেছেন নজরুল। যেমন শাসকগোষ্ঠী স্বাধীনতার দাবিকে পাশ কাটিয়ে ভারতবর্ষকে ‘ডোমিনিয়ন স্টেটাস’ (Dominion Status) অর্থাৎ রাজ্যের মর্যাদা দেয়ার প্রস্তাব করেছিল। স্বাধীনতার জন্য আপোসহীন নজরুল ঘৃণাভরে সে প্রস্তাবের বিরোধিতা করে পত্রিকায় ‘ডোমিনিয়ন স্টেটাস’কে লিখলেন ‘ডোম্নি স্টেটাস’, আরো বললেন- ‘মা নাকি ডোমনি হবেন’। এমনিভাবে ‘গভর্নর’ বদলে লিখেছেন ‘গোবর-নর’, ‘মার্শাল’ (সেনাপতি) স্থলে ‘মার শিয়াল’। ‘আড়ষ্টকাক’ বলেছেন অ্যারিস্টোক্র্যাট বা অভিজাতকে-যারা অহমিকায় নাক উঁচু করে গাঁ বাঁচিয়ে চলেন।

এবার দুটো উদাহরণ দিই, যেখানে নজরুল তার প্রিয় মানুষদের নাম নিয়ে পদ্যরস সৃষ্টি করেছেন। যথা: গ্রিকদের পরাজিত করার ঘটনায় তুর্কি বীর মোস্তফা কামাল পাশাকে শিরোনাম করেছিলেন: “সাবাস কামাল মোস্তফা/ তোরই দেখছি মোচ তোফা/ খুব কসে ভাই গোস্ত খা/ বাঁধ জালিমের হস্ত পা”। মতিলাল নেহেরুর রাজনৈতিক কর্মের খবর দিতে গিয়ে লিখেছিলেন : “নেহারি নেহরু মতিলাল/ রাসভ আঁখি অতিলাল”।

নামের এরূপ ব্যঙ্গাত্মক ব্যবহার রসোত্তীর্ণ হতো নজরুলের প্রভূত জ্ঞান ও কল্পনাশক্তির কারণে। যেমন, যারা শুধুই বক্তৃতাবাজি করে তাদের ‘বখতিয়ার খিলজি’র সঙ্গে যে তুলনা করেছেন, তা শুধুই ধ্বনি সাম্যের কারণে নয়, ইখতিয়ার উদ্দিন বিন বখতিয়ার খিলজির সেই নবদ্বীপ দখলের ঘটনার সমান্তরালে বলেছেন: “বক্তৃতায় যাঁহারা দিগ্বিজয়ী, বখতিয়ার খিলজি, তাঁহাদের বাক্যের সৈন্য-সামন্ত অত দ্রুত বেগে কোথা হইতে কেমন করিয়া আসে বলিতে পারি না। তাহা দেখিয়া লক্ষ্মণ সেন অপেক্ষাও আমরা বেশি অভিভূত হইয়া পড়ি (“যৌবনের গান”)।

তবে আমরা বাস্তবিকই বিস্মিত হই তাৎক্ষণিকভাবে নাম নিয়ে নজরুলের শিল্প-সরসতা দেখে। যেমন, একবার এক ভক্ত তার কাছে এলেন অটোগ্রাফ নিতে। কবি তার নাম জানতে চাইলেন। অটোগ্রাফ-আকাঙ্ক্ষী জানালেন- বিজলি ধর। নজরুল লিখলেন আশীর্বাণী: Be Jolly-প্রফুল্ল থাকো।

নাম নিয়ে নজরুলের এসব রঙ্গ-রসিকতা ও শৈল্পিক কথকতা নজরুলের স্বভাবদত্ত কবি প্রতিভার কথাই মনে করিয়ে দেয়। ছোটবেলায় লেটোর দলের মতো শিল্পী সংগঠনের সাথে জড়িত হওয়ার সুবাদে এই দিকটির বিকাশ আরো সহজতর হয়েছিল বলা চলে। দৈনন্দিন জীবনে দুখঃদৈন্য যাই আসুক না কেন, তার মনে যে একটা রসের ফল্গুধারা সর্বদা বহমান ছিল, সেটাই মাঝে মধ্যে নির্ঝরের মতো শৈল্পিক অভিব্যক্তি পেয়েছে এসব ঘটনা ও কথনে।

নাম নিয়ে অবশ্য নজরুলকেও বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকা নজরুলকে নানাভাবে আক্রমণ করতো। সম্পাদক সজনীকান্ত দাসসহ কয়েকজন নজরুলের কবিতার অশ্লীল প্যারোডি লিখতেন এবং রচয়িতা হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম নামটিকেও বিকৃত করে লেখা হতো- ‘গাজী আব্বাস বিটকেল’। ‘কাজী’কে ‘গাজী’ করা নির্দোষ ধ্বনিমিল বলে মানা যায়, কিন্তু শেষ শব্দটি শুধুই কুরুচিপূর্ণ। নজরুল কিন্তু নির্মল হাস্যরসেরই সৃষ্টি করেছিলেন সজনীকান্ত দাসকে ‘সজনে ঘণ্ট খাস’ বলে।

নজরুলকে আরো আক্রমণ করতো ‘মোহাম্মদী’ ও ‘হানাফী’ পত্রিকা। অতিষ্ঠ নজরুল ‘মোহাম্মদী’ অফিসকে বলতেন ‘মহামুদী খানা’ আর তার সম্পাদক মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁকে বলতেন ‘আক্রমণ খাঁ’- কখনো ‘বাগরম খাঁ’ কিংবা ‘আক্রমিয়া এডিটর’। এমনিভাবে ‘হানাফী’ কাগজকে বলেছেন ‘হাঁফানী’। এরকম কোনো কোনো বাকযুদ্ধ সন্ধি-শান্তির মাধ্যমেও সমাপ্ত হয়েছিল। যেমন, গোলাম মোস্তফার ক্ষেত্রে। নজরুল নিয়ে তার এই ছোট্ট

ছড়াটি খুবই বিখ্যাত:

কাজী নজরুল ইসলাম
বাসায় একদিন গিছলাম।
ভায়া লাফ দেয় তিন হাত
হেসে গান গায় দিন-রাত,
মনে ফূর্তির ঢেউ বয়,
ধরায় পর তার কেউ নয়।

প্রত্যুত্তরে নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন :

কবি গোলাম মোস্তফা
দিলাম ইস্তফা।

নজরুলের নাম-বিভ্রাটের এক প্রসঙ্গে আসি। নাট্যকার মন্মথ রায়কে নিজেই চিঠিতে জানিয়েছিলেন: “নওরোজ বেরিয়েছে-ওতে আমার এক মিতে লেখককে দেখবেন- তবে তিনি ‘নাজিরুল’, নজরুল নন, -আকার-ইকারের দন্ত ধারণ করে নিজের বিশিষ্টতা রক্ষা করেছেন। তার ভাল লেখা পড়ে তার প্রাপ্য নজরুলকে দেবেন না যেন।” তবে পরবর্তীকালে বাংলা সাহিতের এক বিশিষ্ট ইতিহাসকার এই ভুলটিই করেছিলেন।

শেষ কথা বলি নজরুলেরই আরেকটি নাম নিয়ে। এ প্রসঙ্গে হাস্যরস, ধ্বনিমিল কোনোকিছুই নেই। আছে নির্মম সত্য। তার বাবার নাম ছিল কাজী ফকির আহমদ- কাজিগিরি কোনকালে হয়তো কোনো পূর্বপুরুষ করতেন, তবে ফকির নামটি কবির পিতার প্রসঙ্গে সার্থক প্রতিপন্ন হয়েছিল, যদি ‘ফকির’ অর্থ ‘দরিদ্র ব্যক্তি’ ধরি। এই দারিদ্র্যের কারণেই ছেলেবেলায় নজরুলের ডাকনাম হয়েছিল ‘দুখু মিয়া’- এটিই যেন চিরসার্থক নাম।

নজরুল ইসলাম একবার বন্ধুদের বলেছিলেন: দু-পেয়ালা চা আনো, খেয়ে চালাক হয়ে নিই। লাখ পেয়ালা চা খেলে মানুষ চালাক হয় আর সেটা পূর্ণ হতে আমার আর দু-পেয়ালা বাকি আছে। তারপর কতো পেয়ালা চা খেয়েছেন, তবু চালাক হতে পারেননি, ধনবান হতে পারেননি। আসন অবশ্য পেয়েছিলেন ‘গালির গালিচা’য়। দুঃখ সঙ্গী ছিল আজন্ম-আমৃত্যু। সে দুঃখ যেমন ব্যক্তিগত-পারিবারিক, তেমনি রাষ্ট্র্রীয়-সামাজিক কারণেও। জন্মেই দেখেছেন স্বদেশ পরাধীন, স্বজাতি নির্যাতিত। পরাধীনতার গ্লানি, দেশবাসীর কষ্ট তাকে করেছিল ‘চির তিক্তপ্রাণ’।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)