সিনেমা-নাটকে বিয়ের দৃশ্যায়নে ‘কবুল’ উচ্চারণে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে একটি লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন একজন আইনজীবী। তথ্য সচিব, আইন সচিব, ধর্ম মন্ত্রণালয় সচিব এবং বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ড (বিএফসিবি) বরাবর এই নোটিশ পাঠানো হয় বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর)।
এমন নোটিশের খবর প্রকাশ্যে আসার পর বিষয়টি নিয়ে নাটক, সিনেমার মানুষের মধ্যে দেখা গেছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। এমন নোটিশের নিন্দা জানিয়েছেন অনেকে। ‘কবুল’ নিষিদ্ধের এ নোটিশকে পুরোপুরিভাবে ‘অযৌক্তিক’ মনে করছেন সিনেমা নাটকের অভিজ্ঞজনরা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিত্বদের কথা শুনেছেন মিতুল আহমেদ ও নাহিয়ান ইমন:
‘কবুল’ নিয়ে আইনজীবীর পাঠানো নোটিশের ঘটনায় অর্ধশতাধিক সিনেমার নির্মাতা কাজী হায়াৎ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, যিনি নোটিশ দিয়েছেন, তাকে আগে বুঝতে হবে-‘সিনেমা ইজ নট রিয়েলিটি। সিনেমা ইজ সিনেমা!’।
প্রবীণ এই নির্মাতা নিজের ব্যক্তিগত মত ব্যক্ত করে আরো বলেন, আইন বিষয়ক কথা বলতে একটু ভয় ও লাগে। তবে আমার ব্যক্তিগত মন্তব্য, সিনেমা ইজ অলওয়েজ সিনেমা। আমার পরিচিত একজন জজ একদিন বলেছিলেন, ‘তোমাদের যেসব ছবিতে আদালত দেখানো হয়, সেসব ছবিতে আদালতের সঠিক দৃশ্য চিত্রায়ণ হয় না। নাটকীয়তা আনো, কতো সিনেমাটিক বিষয় আশয় দেখাও। কিন্তু বাস্তবে এগুলো কখনোই হয় না। এখন কোনো জজ চাইলে আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে সেইসব ছবির প্রদর্শন অযোগ্য করে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। তারপরও কোনো জজ এমনটা করেন না, কারণ তারা জানেন ‘সিনেমা ইজ সিনেমা। ইটস নট রিয়েল।’
তিনি বলেন, সারা পৃথিবীতেই সিনেমার আলাদা একটি কালচার আছে। সিনেমার আদালত, সিনেমার পুলিশ- সব আলাদা। সিনেমা জিনিষটা বিনোদনের জন্য। এটার সাথে বাস্তবকে মেশালে হবে না।
সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের প্রথম চলচ্চিত্র ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’। এই ছবিতেও কেন্দ্রীয় দুই চরিত্র অয়ন ও নীরাকে ‘কবুল’ বলেই বিয়ে করতে দেখা যায়। ‘কবুল’ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টির বিষয়টি নিয়ে এই ছবির নির্মাতাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, যিনি নোটিশটি পাঠিয়েছেন, তিনি শরীয়তের কী ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, আমি জানি না। তবে সাধারণ দৃষ্টিতে এটুকু বলি, সিনেমা-নাটক মানেই কাল্পনিক নাম, কাল্পনিক চরিত্র। এখন এই কাল্পনিক নাম, চরিত্রের মানুষগুলো কবুল বললেই বিয়ে হয়ে যাবে? সাধারণ জ্ঞানে এটাকে আমার ধর্মের অপব্যাখ্যা বলে মনে হয়। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলমান একটা কালচারাল অ্যাক্টিভিটিকে থামিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা ছাড়া আমার আর কিছুই মনে হয় না।
তিনি বলেন, আমরা যেখানে কালচারালি অনেক সংগ্রাম করছি সামনে এগিয়ে যাওয়ার, সেখানে এমন নোটিশ আমাদের পিছিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না এমন সিদ্ধান্তকে।
কবুল নিয়ে এমন নোটিশকে ‘হাস্যকর’ বলে মন্তব্য করেছেন পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ লেখক ও প্রযোজক ছটকু আহমেদ। চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘সিনেমা নাটকে তো শুধু বিয়ে হয় না, এখানে অভিনেতা খুন হন, মদ খান। তারমানে তাকে বাস্তবেও খুন হতে হবে, মদ খেতে হবে? সিনেমা নাটকে কবুল বললে বিয়ে হয়ে যাবে, এগুলো খুবই হাস্যকর যুক্তি। অভিনয়ের সাথে বাস্তবের কী সম্পর্ক?
ছটকু আহমেদের কথার সূত্র ধরেই এমন নোটিশকে ‘অযৌক্তিক’ দাবী করলেন হাজারও চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার আবদুল্লাহ জহির বাবু। তার গল্প ও সংলাপে শত শত চলচ্চিত্রে নায়ক-নায়িকাদের বিয়ের দৃশ্য সম্পন্ন হয়েছে। চ্যানেল আই অনলাইনকে আবদুল্লাহ জহির বাবু বলেন, পর্দায় যে চরিত্র দেখা যায় সেটি পুরোপুরি বানানো চরিত্র। যে চরিত্রটা লিখে তৈরি করি সেই চরিত্রটা কবুল বলে। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই। এই কাল্পনিক চরিত্র কবুল বলল নাকি ভালোবাসলো তাতে কি আসে যায়? এটা পুরোপুরি অযৌক্তিক।
তিনি বলেন, ৩০ বছর আগে পাকিস্তান কোর্টে স্বামী-স্ত্রী থাকাকালীন মোহাম্মদ আলী এবং জেবা বখতিয়ারকে নিয়েও এমন ঘটনা ঘটেছিল। একটি ছবিতে তারা তিনবার তালাক বলায় একজন আইনজীবী পিটিশন করেছিলেন, তারা আর স্বামী স্ত্রী নেই! পরে পাকিস্তান কোর্ট সেই পিটিশন আমলেই নেয়নি। কোর্ট বলেছিল, সিনেমা নাটকে কী থাকে তার সঙ্গে বাস্তবে কোনো মিল থাকতেই পারে না! পর্দার চরিত্রে বলেছে তালাক। এরসঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। নার্গিস-সুনীল দত্ত স্বামী স্ত্রী থাকাকালীন মা ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তারা কি বাস্তবে মা ছেলে? নামই তো রুপালী পর্দা। বাস্তবের সঙ্গে কোনো মিল নেই। সেখানে কে কবুল বলল নাকি খুন করলো সেটা নিয়ে মাথা ব্যথার কোনো কারণ দেখিনা। এটা নিয়ে হয়তো কেউ ইস্যু তৈরি করে লাইমলাইটে আসার চেষ্টা করছে।
ডিরেক্টর গিল্ডের সভাপতি ও জনপ্রিয় নির্মাতা-অভিনেতা সালাউদ্দিন লাভলু বলেন, নাটক সিনেমায় ‘কবুল’ নিষিদ্ধের দাবিতে নোটিশে যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে এগুলো ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে ফানি লেগেছে। এগুলো ধোপে টিকবে না। তবে যিনি নোটিশটা দিয়েছেন, তিনি এটা কেন করলেন, এটা ভেবেই আমি আশ্চর্য হচ্ছি।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চিত্রনাট্যকার, নাট্য নির্দেশক মাসুম রেজা বলেন, শুরু থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যতবার কবুল বলেছেন তাহলে ততোবারই তারা বিয়ে করেছেন? তাহলে তো ততোবারই তাদের তালাক করাতে হবে! মাসুম রেজা বলেন, সুস্থ স্বাভাবিক কোনো ব্যক্তি এসব ভিত্তিহীন বিষয়ে নোটিশ পাঠিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। অন্যভাবে বলা যায়, যিনি পাঠিয়েছেন তিনি হয়তো অ্যাটেনশন পেতে চাইছেন। তাদের উদ্দেশ্য থাকে আলোচনায় আসা। এসব আমরা কখনই পাত্তা দিতে চাইনা।
নির্মাতা শিহাব শাহীন মনে করেন, এ ধরনের আইনী নোটিশ পুরোপুরি অবান্তর। তিনি মনে করেন, এসব বিষয় মাননীয় আদালতের আমলে নেয়ার সময় আছে বলে আমার মনে হয় না। শিহাব শাহীন বলেন, যিনি এই নোটিশ দিয়েছেন তিনি নাটক সিনেমার অভিনয়ের আদৌ কিছু বোঝে কিনা সন্দেহ! কেউ একজন লাইমলাইটে আসার জন্য এটা করেছে। এসব পাত্তা দেয়ার কিছু নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আদালতে এই নোটিশ ধোপে টিকবে না। উদ্ভট চিন্তাভাবনা বুদ্ধিমানদের কাছে কখনই টিকবে না।
নির্মাতা মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ বলেন, নাটক সিনেমায় প্রথমেই বলা থাকে কাল্পনিক গল্প। বাস্তবের সঙ্গে কোনো মিল নেই। কাজী যখন বিয়ে পড়ায় সেটা এক সময় শুট করা হয় আবার বর কনের শুট করা হয় অন্যসময়, তাও আবার ফেক নাম ব্যবহার করা হয়। সঠিকভাবে যেভাবে বিয়ে হয় সেভাবে করা হয় না। তাই সিনেমা নাটকে কবুল বললেই সঠিকভাবে বিয়ে হতে পারে না। যদি কবুল বললে বিয়ে হয়, তাহলে মেরে ফেলার অভিনয় তো আরও খারাপ! তাহলে সেও কি মরে যাবে? নোটিশের যৌক্তিকতা তো দূরের কথা বিষয়টি খুবই হাস্যকর লেগেছে। নোটিশের খবরটি জেনে আমি শুধুই হেসেছি।
নাটকের শিল্পীদের সংগঠন অভিনয় শিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবীব নাসিম মনে করেন, এ নোটিশটি অবশ্যই অযৌক্তিক। তিনি বলেন, তবে যে কোনো বিষয় নিয়ে যে কেউ নোটিশ দিতেই পারেন। তথ্য মন্ত্রণালয় কি উত্তর দেবে সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি। তবে অবশ্যই চাইবো নাটক সিনেমায় ‘কবুল’ নিষিদ্ধ, এটা যেন আইন হিসেবে পাশ না হয়। নাটক সিনেমায় মুক্তভাবে কথা বলার সুযোগ থাকতে হবে। নেতৃত্বের জায়গা থেকে আমি মনে করি তথ্য মন্ত্রণালয়কে আইনীভাবে লড়াই করা। আমরা সাথে আছি।
এদিকে নাটক-সিনেমায় ‘কবুল’ বলা নিষিদ্ধের দাবীতে অটল সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মাহমুদুল হাসান। শুক্রবার রাতে চ্যানেল আই অনলাইনকে আশাবাদ জানিয়ে এই আইনজীবী বলেন, নাটক সিনেমায় ‘কবুল’ বলা নিয়ে আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট। আগে থেকেই বলছি যে, আমরা নতুন কোনো আইনের প্রয়োগ চাইছি না, বরং বহু বছর ধরে একটি আইন তৈরী হয়ে আছে, সেটার প্রয়োগ চাইছি। হয়তো আইনটি অনেকে জানেন না বলে কারো কারো কাছে যৌক্তিক নাও মনে হতে পারে।
এই আইনজীবী বলেন, মুসলিম অ্যাক্ট ১৯৩৭ অনুযায়ি কোনো মুসলিম নর-নারী; সেটা অভিনেতা-অভিনেত্রী হোক তাদের মধ্যে যদি ‘কবুল’ বা বিয়ে পূর্ব কন্ডিশনগুলো পূরণ হয়, তাহলে তাদের মধ্যে বিয়ে হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন সিনেমা, নাটক, ভিডিওতে বিভিন্ন দৃশ্যে বিবাহের দৃশ্যায়নে মুসলিম অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা পূরণসহ ‘কবুল’ শব্দ উচ্চারণ করে থাকেন। যার মাধ্যমে উক্ত মুসলিম অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা মুসলিম আইন (শরীয়ত) অনুযায়ী স্বামী-স্ত্রী হিসেবে গণ্য হবেন। কারণ ‘দ্য মুসলিম পারসোনাল ল (শরীয়ত) অ্যাপ্লিকেশন অ্যাক্ট, ১৯৩৭’ এর ধারা ২ অনুযায়ি বিয়ের ক্ষেত্রে সরাসরি মুসলিম আইন (শরীয়ত) প্রয়োগ হবে। এখানে অভিনয়ের যুক্তিতে এই বিয়েকে অস্বীকার করা যাবে না।
বহু বছর ধরে নাটক-সিনেমায় অভিনেতা-অভিনেত্রীর বিয়ের দৃশ্যে ‘কবুল’ বলার প্রচলন। তাহলে কি সেইসব নাটক সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা স্বামী-স্ত্রী হয়ে গেছেন? এমন প্রশ্নে এই আইনজীবী কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি।
তিনি বলেন, ‘আইন ব্যক্তি আবেগ বুঝবে না।’ আশাবাদী এই আইনজীবী মনে করছেন, যাদের কাছে নোটিশটি পাঠানো হয়েছে, তারা আগামি ৩০ দিনের মধ্যে নাটক-সিনেমায় বিয়ের দৃশ্যায়নে ‘কবুল’ শব্দ উচ্চারণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন। এবং এও জানিয়ে রাখলেন, ৩০ দিনের মধ্যে কোনো সিদ্ধান্ত না পেলে উচ্চ আদালতে রিট করবেন।