‘রবীন্দ্রবলয় ভেঙে বেরিয়ে আসা ত্রিশোত্তর কবিদের একজন তিনি। কবিতায় তিনি সিদ্ধান্ত প্রবণ নন বরং আধুনিক কবিতার সিদ্ধান্তহীনতার অস্পষ্টতা ছিলো তার কবিতায়। তবে নন্দন চর্চার অস্পষ্টতার সঙ্গে তাঁর কবিতায় সমাজ ও রাজনীতি সচেতনতা স্পষ্ট। তিনি আধুনিক নন্দনবাদী কবি হলেও সমাজ ও সাধারণের বোধের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে তাঁর কাব্যচর্চায় ’।
কবি শামসুর রহমানের নবম মৃত্যুবার্ষিকীতে বাংলায় আধুনিক কাব্যচর্চার প্রাণপুরুষের স্মরণে এ কথাগুলোই বলেন কবি, ঔপন্যাসিক ও সাহিত্য সমালোচক নুরুল হুদা। চ্যানেল আই অনলাইনকে কবি শামসুর রাহমানের সাথে প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতি এবং তাঁর কবিতার নান্দনিকতা,সমাজসচেতনতা এবং স্বাধীনতার নানা দিক তুলে ধরেছেন সত্তর দশকের প্রথিতযশা এই কবি।
কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই কবিভক্ত হয়ে যান অনুজ নুরুল হুদা। সেদিনে স্মৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, ১৯৬৭ সালে কবির সঙ্গে তার প্রথম দেখা। তিনি এবং আহমদ সফা গিয়েছিলেন কবির ঢাকার বাসায়।
তিনি জানান, সেদিন টানা দুঘণ্টা কবি সাহচর্যে থাকার সুযোগ হয়েছিলো। কবি প্রতিটি কথা খুব ভেবে নিয়ে ধীরে অথচ আশ্চর্য প্রবাহমানতায় বলছিলেন আর তিনি তন্ময় হয়ে শুনছিলেন। খুব গুছিয়ে বলা কথাগুলোর সাবলীলতা তাকে মুগ্ধ করেছিলো বলে জানান নুরুল হুদা।
এই সাহিত্য সমালোচক মনে করেন শামসুর রাহমানের ব্যক্তিত্বের এই দিকটি তাঁর লেখাতেও স্পষ্ট। অক্ষর বৃত্ত ছন্দে প্রবাহমানতা এবং ধীর নম্র-প্রশান্তিময় কবিতার আড়ালে কবির মধ্যবিত্তমানসের প্রতিচ্ছবিই মূর্ত হয়েছে নান্দনিক বিমূর্ততায়। তাঁর ভেতর উদ্ধত অনুভূতি কিংবা সংকীর্ণতা নয় বরং মধ্যবিত্তের সাবধানী দোলাচল,ধীর ভাবনাপ্রসূত মনোভাবই উঠে এসেছে শামসুর রাহমানের কবিতায়। নন্দন চর্চা করলেও কবি ছিলেন সমাজ সচেতন। রাজনীতিতে না জড়ালেও ভাষার অবজ্ঞা সহ্য করতে না পেওে তিনি লিখেছিলেন মর্মস্পর্শী কবিতা‘ বর্ণমালা,আমার বর্ণমালা’। এছাড়া কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবি লিখেছিলেন টেলেমেকাস, ৬৯’ এ লিখেছেন ‘আসাদের শার্ট’। প্রখর স্বাধীনতাবোধের কবি মুক্তিযুদ্ধকালে ‘ স্বাধীনতা তুমি’ এবং ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ লিখেছিলেন। আসলে তিনি ছিলেন সার্বিক মুক্তির কবি। তাকে গণ্ডিতে আটকানো যাবে না, তিনি গণ্ডিতে আটকে থাকেননি। তিনি না সুকান্ত, না নজরুল বরং স্বকীয় তিনি আপন প্রতিভায়।
শামসুর রাহমান চর্চা করেছেন কাব্য- নন্দন তবে দেশ-জাতি সমাজ প্রশ্নে কবি সবসময় ছিলেন সচেতন। তাই বাংলা কবিতায় শামসুর রাহমান এক স্বতন্ত্র কবিকণ্ঠের নাম।
কবি শামসুর রাহমান ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর ঢাকার মাহুতটুলিতে নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরায় পাড়াতলী গ্রামে।
নিজের লেখাতে কবি ফিরে যেতে চেয়েছেন সেই গ্রামে যেখানে স্বাধীনতা বোধের জন্ম হয়েছিলো কবির, নাগরিক কবির মুক্তির বীজ হয়তো বপন হয়েছিলো সেখানেই।
কবির স্মৃতিবিজড়িত পাড়াতলী গ্রামের বাড়িটিতে এখনো ছড়িয়ে আছে কবির নানা স্মৃতি। তবে সবই যেনো বিষন্ন খুব। কবি যে চলে গেছেন আজ নয় বছর।
আধুনিক বাংলা কবিতায় বিষয় বৈচিত্র্য ও নৈপুণ্যের কারণে তিনি দুই বাংলায় জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। শামসুর রাহমানকে বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকে পাঁচ মহান কবির পর আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান কবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কবি ও সাংবাদিক শামসুর রাহমান:
১৯৪৯ সালে সোনার বাংলা পত্রিকায় তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। কবি শামসুর রাহমান বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছদ্মনামে সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয় লিখতেন।১৯৫৭ সালে দৈনিক মর্নিং নিউজ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। কিছুদিন কাজ করার পর ১৯৫৭ সালেই তিনি রেডিও পাকিস্তানের অনুষ্ঠান প্রযোজক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬০ সালে তিনি পুনরায় মর্নিং নিউজে সহযোগী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালের শেষের দিকে কবি শামসুর রাহমান দৈনিক পাকিস্তানের সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। সেখানে তিনি ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে এই পত্রিকা দৈনিক বাংলা নামে প্রকাশিত হয়। ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কবি দৈনিক বাংলা ও সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৮৭ সালে সামরিক সরকারের শাসনামলে তিনি দৈনিক বাংলা থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর তিনি সাহিত্য পত্রিকা অধুনা’র সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।প্রতিবাদী কবি শামসুর রাহমান পাকিস্তান শাসন আমলে সরকারি পত্রিকায় কাজ করা সত্ত্বেও আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের প্রতি বিদ্রুপ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারা ভোগের সময় তাকে উদ্দেশ্য করে তিনি কবিতা লেখেন। রবীন্দ্র সঙ্গীতের ওপর পাকিস্তান সরকারের নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদেও তিনি ছিলেন উচ্চকন্ঠ।