বিনিয়োগকারীরা গেলো বছরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মাথায় রেখে নতুন বছরের পরিকল্পনা করেন। শুধু অনুমানের ওপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে ২০১৬ সালের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি আরো কিছুটা বেশি দু’টো কারণে: ১. চীনসহ অন্যান্য দেশগুলোর প্রবৃদ্ধিতে ধীরগতি এবং ২. মার্কিন ও ব্রিটিশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি কঠোর করা।
সুতরাং ২০১৬ সালটি বিশ্ব অর্থনীতি ও বাণিজ্যের জন্য কেমন যাবে তা নির্ভর করে মূলত দু’টি প্রশ্নের ওপর – ‘চীন আর অন্য দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি কি এমন ধীরগতিতেই চলবে?’ এবং ‘যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ও যুক্তরাজ্যের ব্যাংক অব ইংল্যান্ড মুদ্রানীতি কতোটা কঠোর করবে?’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিনিয়োগকারীরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্পোরেট মুনাফার প্রতি আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই নতুন বছরের বিনিয়োগ শুরু করেছেন, এবং গ্রীষ্ম আসতে আসতে তার সুফলও পেয়েছেন কমবেশি। কিন্তু এবারের পরিস্থিতিটা ভিন্ন।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অর্থনীতি বিষয়ক রেটিং প্রদানকারী সংস্থা মুডি’জ ২০১৬ সালে জি২০ ভুক্ত দেশগুলোর সম্ভাব্য জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২.৮ শতাংশে এনেছে। চলতি বছরের প্রথমার্ধেই সূচকের ব্যাপক ধস নেমেছে, যা ২০০৯ সালের পর এই প্রথম। বিশ্ব বাণিজ্যের অবস্থা হতাশাজনক ছিলো বলা যায়। তার ওপর ভিত্তি করেই মুডি’জ-এর এই অনুমান।
ওই অর্থনৈতিক সঙ্কটের ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের মুদ্রানীতি শিথিল করার সুযোগ পেয়েছে। আগামী বছর অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের কাছ থেকে এতোটা শৈথিল্য পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে সুদের হার খুব একটা না বাড়ালে তাতেই খুশি বিনিয়োগকারীরা।
অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় ইউরোপিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং ব্যাংক অব জাপান ২০১৫ সালে তাদের মুদ্রা ব্যবস্থার সম্প্রসারণ করেছিলো। সামনের বছরও তারা এমনটাই চালিয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। তবে আশার কথা হলো চীন তার প্রবৃদ্ধির গতি বাড়াতে নতুন কিছু নীতি প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। যার মাধ্যমে পণ্য উৎপাদকসহ অন্যান্য উদীয়মান বাজারগুলো বড় একটা সুযোগ পাবে।
বিশ্বজুড়ে বন্ড বিনিয়োগকারীদের আগের মতোই স্থবির অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হতে পারে নতুন বছরেও। প্রতি বছরই আশা করা হয় প্রবৃদ্ধি বা মুদ্রাস্ফীতি বাড়ার কারণে অথবা মুদ্রানীতিতে নতুন কোনো পরিবর্তন আসলে বন্ড বিনিয়োগে আয় বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে কোনো বছরই অবস্থার তেমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায় না। বিশেষ করে ২০১৫-তে তো বেশ কিছু ইউরোপিয়ান সরকারি বন্ড বাজারে ঋণাত্মক আয় দেখা গেছে।
ফলে মুদ্রাস্ফীতিতে নতুন জোয়ার আসার আগে বন্ডের ব্যবসায় খুব একটা লাভের সম্ভাবনা আছে বলে মনে করছেন না বিশেষজ্ঞরা। কমতে থাকা পণ্যমূল্য ও দুর্বল প্রবৃদ্ধি থেকে যা বোঝা যাচ্ছে, রাশিয়া আর ভেনিজুয়েলার মতো দুয়েকটি দেশ বাদে আপাতত মুদ্রাস্ফীতি বাড়ার সম্ভাবনা নেই।
তেলের মতো অতিপ্রয়োজনীয় এবং মূল্যবান পণ্যগুলোর দাম এ বছর দফায় দফায় কমেছে। সৌদি আরব মার্কিন তেল উত্তোলনকারীদের ব্যবসা বন্ধ করার চেষ্টা করেও সফল হয়নি। উল্টো ইরানের নতুন চুক্তিতে রপ্তানি করা তেল আগামী বছর বাজারে আসতে যাচ্ছে। সুতরাং আগামী বছরও তেলের দাম খুব একটা বাড়বে বলে মনে হয় না।
অর্থনীতি ও মুনাফা ছাড়াও রাজনীতিও ২০১৬-তে বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে বড় ভূমিকা রাখতে পারে; যেমন গ্রিক সঙ্কট এ বছর টানা কয়েক মাস বাজার ওলটপালট করে রেখেছে।
২০১৬’র সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, যার ফলাফলের ওপর আমেরিকানসহ বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের অনেক সিদ্ধান্ত এবং লাভ-ক্ষতি নির্ভর করবে। এছাড়াও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ব্রিটেনের সদস্যপদ বিষয়ে গণভোটকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকবেন ব্রিটিশ বিনিয়োগকারীরা।
২০১৬-তে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার অন্যতম কারণ হতে পারে বাজারের অস্থিতিশীলতা। ব্যাংকগুলো এখন আর আগের মতো বাজার তৈরিতে ভূমিকা রাখে না। ২০১৫ সালে টানা এক মাসেরও বেশি সময় বিশ্বজুড়ে শেয়ারবাজার ধসের মুখ দেখেছে। এছাড়াও এ বছর বেশ কয়েকবার বাজার ওঠানামা করেছে। কদাচিৎ এমনটা হলে মেনে নেয়া যায়। কিন্তু প্রতি মাসেই এমন হতে থাকলে বিনিয়োগকারীদের হয়তো শূন্যহাতে ঘরে ফিরতে হবে।