দূরপাল্লার বাসের মতো বসন্ত তার পথচলা শুরু করেছে। তাই শীতকে পাততাড়ি গুটিয়ে দ্রুত বিদায় নিতে হচ্ছে। গত দুইদিনে শীত যেন পড়িমরি করে কেটে পড়ছে। সকালেই রোদ উঠছে রীতিমত সৌর চিৎকার হয়ে। বিকেলে সূর্য ডুবছে তার ভীষণ উত্তাপ জানান দিয়ে। সন্ধ্যার পর বিদায়ী শীতের বেসুরো গান। গায়ে ভারী পোশাক থাকলে ভেতরটা ঘেমে ওঠে। গরম পোশাক না থাকলে শীত কিছুটা সরব হতে চায়। এর ভেতরেই বইমেলা। নতুন বই মানে গরম খই। নতুন বইয়ের উষ্ণতা ও উত্তাপ থাকে। নতুন বইয়ের শিহরণ থাকে।
অনেক লাভ লোকসানের ভেতর টিকে থাকে প্রকাশনা শিল্প। গতবার বইমেলায় ছিল করোনার অভিঘাত। বহু প্রকাশকের স্বপ্ন ধুলিস্যাত হয়েছে। পুরোনো ও ভিত গড়ে ফেলা প্রকাশকরা করোনার লাভ লোকসানের সঙ্গে নিয়ে নতুন দিনের পথ নির্মাণে এগিয়েছে। এবার প্রকাশকেরা তাদের বইপত্র বেশিরভাগ আগেভাগেই প্রকাশ করে বসে আছে। কারণ বইমেলা নিয়ে তাদের অনিশ্চয়তা ছিল।
নতুন যুগের বাজার ধরতে অনেকেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এখনকার সুবিধা হলো, বই শুধু বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশ করতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতার মধ্যে না থাকলেও চলছে। বই বছরের যেকোনো সময়ে বের করে সঙ্গে সঙ্গে বাজারে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে। এবার বইমেলায় যে বইগুলোর কাটতি দেখা যাচ্ছে, এর মধ্যে কোনো কোনো বই আগেই বাজার ধরেছে। স্বকৃত নোমানের ‘উপন্যাসের পথে’, মোজাফফর হোসেন এর ‘সাহিত্যের ন্যারেটিভ লেখকের হ্যাণ্ডবুক’ এর মতো অনেকগুলি বই বইমেলার আগেই পাঠক পেয়ে গেছে।
সুবিধা হলো, বইয়ের আসলে নতুন পুরোনো বলে কিছু নেই। ধরা যাক, গতবার বা গত দুবছর আগে প্রকাশিত বই, অনলাইন বাজারে দেখে আপনি অর্ডার করলেন। আপনার হাতে পৌঁছতেই সেটি নতুন বইয়ের আবেদন সৃ্ষ্টি করতে পারছে। এখন প্রকাশকের জন্য বড় এক সহায়ক ক্ষেত্র অনলাইন। বই প্রকাশ করে শুধু সুনির্দিষ্ট খাতগুলোতে বিক্রির জন্য ধরনা না ধরলেও চলছে। টেক্সট ভালো হলে অনলাইনে কাটতি নিশ্চিত।
বইমেলায় মানুষ বই কেনে, বই দেখে, বই পড়ে, বইয়ের নাম মনে রেখে স্মার্ট হয়ে ওঠে। অনলাইনে বই কিনলেও বইমেলা তার কাছে বইয়ের উপযোগিতা মেলে ধরে। বই সংগ্রহের সিদ্ধান্ত মজবুত করে দেয়। এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
পৃথিবীতে যেখানে বইমেলা নেই, সেখানকার মানুষদের বইয়ের ব্যাপারে উন্নাসিকতা কাটানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। আমাদের এখানে বইমেলা মানুষকে অপরাধী করে। নিজের সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট করে দেয়। পৃথিবীতে বই না পড়েও অনেক কিছু শেখা যায়। কিন্তু বই পড়ে যা শেখা যায় তার সঙ্গে সেই শেখার তুলনা নেই।
সব মানুষই চোখ নিয়ে জন্মায়। সে চোখ সবকিছু দেখে। একদিন ভেতরের চোখ এসে চর্মচক্ষুকে শাণিত করে। বই যেন ভেতরের চোখ ও বাইরের চোখের এক সেতুবন্ধন। বই আমাদের চোখে চোখে আলো পৌঁছে দেয়। আজকাল মানুষ এক ধরণের দৃশ্য ও শ্রুতি শিক্ষায় অভ্যস্থ হতে চাইছে। সে ইউটিউবে মগ্ন হচ্ছে। মনোনিবেশ করছে। ভাবছে জানাশোনায় এ ব্যবস্থাটি বইয়ের চেয়ে শক্তিশালী। আমি বলবো, এটি ভুল কথা। নিজেকে নিজে নির্মাণের এক অনন্য মাধ্যম বই। যেখানে নিজেই সবচেয়ে আগে নিজের শিক্ষক হওয়া যায়।
(চলবে)