১৬ ডিসেম্বর। বাঙালির জাতীয় ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল দিন। বহু ত্যাগ, তিতীক্ষা আর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম পূর্ণতা লাভ করে ১৯৭১ সালের এই দিনে। ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জয় লাভের মাধ্যমে। একাত্তরের এই বিজয়ের মাধ্যমে আমরা পেয়েছিলাম নিজস্ব পতাকা, মানচিত্র যার নাম বাংলাদেশ। তবে এই অর্জন সহজে আসেনি। এর জন্য জাতিকে দিতে হয়েছে কঠিন থেকে কঠিনতর সংগ্রাম আর ত্যাগের পরীক্ষা। পাকিস্তানি বর্বর শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন, বাষট্টি’র শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টি’র ৬-দফা, ঊনসত্তরের ১১-দফা আর গণঅভ্যুত্থান ছিল সেই সংগ্রামের একেকটা ধাপ। সেইসব ধাপ পেরিয়েই আসে চূড়ান্ত স্বাধীনতা। যে স্বাধীনতার পেছনে রয়েছে জাতির অপরিসীম ত্যাগ। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামটি লিখতে রক্ত দিয়েছিলেন ত্রিশ লাখ শহীদ, সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন দুই লাখ মা-বোন। অসামান্য আত্মত্যাগ ছিল আরও বহু মানুষের। ইতিহাসে তাদের সেই বীরত্বগাথা চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
স্বাধীনতা অর্জনের ৪৯ বছর আমরা ইতোমধ্যে পার করেছি। নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এই সময়ে আমাদের প্রাপ্তির পরিমাণও কম নয়। গর্ব করা সেই প্রাপ্তি বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। একসময় বাংলাদেশকে যারা তাচ্ছ্বিল্যের দৃষ্টিতে দেখতো, তারাও এখন বাংলাদেশের অভাবনীয় সাফল্যে বিস্মিত। এমনকি একাত্তরে চরমভাবে পরাজিত পাকিস্তানেও এখন বাংলাদেশের মতো স্থানে আসার জন্য নিজেদের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করার দাবি উঠছে। এ সাফল্য একদিনে আসেনি। এখন তা ধরে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
আজ দেশের ৪৯তম বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ও জাতির উদ্দেশে এক গুরু্ত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন: দেশে প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার রাখেন। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকল ধর্মের-বর্ণের মানুষের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। এ বাংলাদেশ লালন শাহ, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দের বাংলাদেশ। এ বাংলাদেশ শাহজালাল, শাহ পরান, শাহ মখদুম, খানজাহান আলীর বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ শেখ মুজিবের বাংলাদেশ; সাড়ে ষোল কোটি বাঙালির বাংলাদেশ। এ দেশ সকলের। এ দেশে ধর্মের নামে আমরা কোনো ধরনের বিভেদ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে দিব না। ধর্মীয় মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে এ দেশের মানুষ প্রগতি, অগ্রগতি এবং উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবেন। তার এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে প্রচ্ছন্ন বার্তা দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি দেশব্যাপী এই ধর্মীয় গোষ্ঠী জাতির পিতার ভাস্কর্য নিয়ে অহেতুক বিতর্ক ও অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছিল। পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা এখনও যে এদেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেনি তা স্পষ্ট। তবে স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য প্রথম বাধাগ্রস্ত হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে। স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী চক্র তারপর থেকে মেতে উঠে হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রে। মূলত সেই ষড়যন্ত্র ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার লক্ষ্য ধ্বংস করে দেওয়া। যে কারণে বিজয়ের এতো বছর পরেও মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।
নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব জানানোর পাশাপাশি স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী রাজাকারদের অপকর্ম জানাতে হবে। প্রকৃত ইতিহাস জেনে গড়ে উঠুক দেশপ্রেমিক প্রজন্ম। তারা বাংলাদেশকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশের এই বিজয়কে নিয়ে যাবে জাতির পিতার চূড়ান্ত স্বপ্নের দিকে-উন্নততর একটি রাষ্ট্র হিসেবে তারা গড়ে তুলবে এই লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা।
বরাবরের মতো আমরা বলতে চাই, বিজয়ের এই গৌরবোজ্জ্বল অর্জন আমাদের এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা। আমাদের বিশ্বাস–যে দেশ অর্জিত হয়েছে লাখো বীর শহীদের রক্ত আর প্রাণের বিনিময়ে, যত বাধাই আসুক না কেন; সেই দেশ তার লক্ষ্যে পৌঁছাবেই। বিজয় দিবসের এই ক্ষণে একাত্তরের সকল শহীদ, বীর যোদ্ধাদের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।