চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

নতুন করে বুঝলাম ’পাপ বাপকেও ছাড়ে না’

খবরটা পড়ার পর থেকে বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল শিরোনামটি ‘ফাঁঁসি ঘোষণা হওয়ার পরও আসামিরা নির্বিকার ও পরিপাটি।’ খবরের বর্ণনায় বলা হয়েছে, ২৬জন আসামির মধ্যে মাত্র দু’জন রায় শুনে কেঁদেছেন। বাকিদের চেহারা ছিল ভাবলেশহীন।

আদালতকক্ষে আসার সময় তাদের কারো কারো মুখে চাপা হাসিও ছিল। কীভাবে সম্ভব মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়ার পরও মুখে হাসি টেনে রাখা!! হয়তো তখনও তারা বুঝে উঠতে পারেননি, কি ঘটতে যাচ্ছে? তখনও হয়তো ভেবে চলেছেন প্রবল পরাক্রমে অপরাধ করতে করতে এই যাত্রায়ও হয়তো পার পেয়ে যাবেন। কিন্তু না, প্রমাণিত হয়ে গেছে কেউ অপরাধ করলে, তাকে শাস্তি পেতেই হবে।

আসামিদের এই ভাবলেশহীনতাই প্রমাণ করে, এরাই অপরাধী, ভয়াবহ অপরাধী। নারায়ণগঞ্জ হত্যাকাণ্ড যারা ঘটিয়েছিল তাদের মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত ২৫ জনই ৫ বাহিনীর সাবেক সদস্য। রায় হওয়ার পর আবার নতুন করে যখন এদের নৃশংস আচরণ ও ঠাণ্ডা মাথায় হত্যাকাণ্ড ও গুমের যে কাহিনীর কথা আলোচিত হলো, তাতে ভয়ে কুঁকড়ে উঠেছে দেশের মানুষ। হতবাক হই এটা দেখে যে এই নৃশংস হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত দেশের আইন রক্ষাকারী বাহিনীর একটি ইউনিটের সব সদস্য।

এদের সংশ্লিষ্টতার খবর যতই প্রকাশ পাচ্ছিল, ততই মনে হচ্ছিল এরাতো কেউ দাগী অপরাধী, খুনি বা ডাকাত নয়। অপরাধী ধরাই এদের কাজ, অপরাধ করা নয়। কারণ এদের মধ্যে ১৭ জনই অপরাধ ঘটানোর সময় ’এলিট ফোর্স ’ বলে খ্যাত র‌্যাবের সদস্য ছিলেন। তাহলে কীভাবে এতটা পৈশাচিক উপায়ে এই কাজ তারা করলো? এরপর আমাদের মতো সাধারণ মানুষ এইসব ফোর্সের সদস্যদের বিচার বিবেচনার উপর যদি আস্থা হারাই, তাহলে কি আমাদের দায়ী করা উচিৎ হবে? একই বলে ‘রক্ষক যখন ভক্ষক’।

কোন মানুষ হঠাৎ করে এই ধরণের অপরাধ ঘটাতে পারেনা। যার বা যাদের মধ্যে নূন্যতম মনুষ্যত্ব রয়েছে, এদের কারো পক্ষে কি এত ভয়াবহ কায়দায় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে নির্বিকারভাবে বসে থাকা সম্ভব? এরা জীবনের শুরু থেকেই হয়তো কোন না কোন ছোটখাট অপরাধ ঘটিয়েছে কিন্তু কখনও তাদের কোন বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। আর তাই তারা দিনে দিনে ভয়ংকর অপরাধীতে রূপ নিয়েছে।

ভাবতে অবাক লাগে এরকম মানসিকতার লোক কীভাবে দেশের মানুষের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পায়? যখন কাউকে এত গুরুত্বপূর্ণ কোন দায়িত্বে নিয়োগ দেয়া হয়, তখন কি তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করা হয়না? এরাতো পুরো বাহিনীর ভাবমূর্তিকে প্রশ্নের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। এই ঘটনা আইনশৃংখলা বাহিনীর নিজেদের নিয়ম-শৃংখলাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সাধারণ মানুষকে দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা করার বদলে নিজেরাই দুর্বৃত্তরূপে আবির্ভূত হয়েছে।

সমাজে যদি এইভাবে কিছু উদাহরণ তৈরি হয় যে যারা দুষ্কর্ম করবে, তারা যেই হোক, যত শক্তিশালীই হোক, তাদের শাস্তি পেতেই হবে- তাহলে কিন্তু সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। আমাদের সবচেয়ে বড় দু:খ বা ক্ষোভ হচ্ছে অপরাধীরা যদি প্রভাবশালী বা ক্ষমতাশালী বা রাজনৈতিক দুবৃর্ত্ত বা অর্থশালী কেউ হয়, তবে তাদের অপরাধের কোন বিচার হয়না। আর বিচার হয়না বলে শাস্তিও হয়না। অতীতে আমরা বহুবার দেখেছি এর নজির। আর তাই এইবার যখন নারায়ণগঞ্জের আলেচিত সাত খুন মামলায় স্থানীয় এক ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতা ও একটি আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্যদের সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় প্রথম থেকেই এই মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে জনমনে ছিল সন্দেহ ও সংশয়।

যাক অবশেষে এই অশুভ শক্তি জয়ী হতে পারেনি। এই রায় এটাই প্রমাণ করেছে যে যত শক্তিশালী দুর্বৃত্তই হোক না কেন, তাকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব। শুধু তাই নয়, সবাইকে একটা তদারকির আওতায় থাকতে হয়।

এই মামলার রায়ে আমাদের মনে অনেক আশার সঞ্চার হয়েছে। মনে হচ্ছে সত্যি ‘ইচ্ছা থাকিলে উপায় হয়’। রাষ্ট্র যদি কোন ক্লুবিহীন মামলার ক্লু খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে সহায়তা করে, বা ইতিবাচক সম্মতি দেয়, বা সদয় আচরণ করে বা সহনশীল হয়, বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে দ্রুত সমাধানের জন্য চাপ প্রয়োগ করে তাহলে হয়তো অনেক স্থবির মামলার জট খুলেও যেতে পারে।

রাষ্ট্র বা সরকার কেন অপরাধীর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেবে? আইনকে আইনের গতিতে চলতে দিলে হয়তো সাগর-রুনি, তনু, ত্বকি, মিতু’র মতো এরকম আরো অনেক হত্যা রহস্য, হারিয়ে যাওয়া রহস্যের সমাধান হতে পারে। আমরা বিশ্বাস করতে ভালবাসি ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)