গরিবদের সম্পর্কে বিআইডিএস, সিপিডি, পিআরআই বা সানেম কী বলে তা এই গরিবদের জানা নেই। এই করোনাকালে কত শতাংশ মানুষ নতুন করে গরিব হচ্ছে বা সামনে কত শতাংশ মানুষ নতুন করে গরিব হবে-অর্থনীতিবিদদের এসব কথাবার্তা রাজধানীর নগর দরিদ্রদের বোঝা বা শোনার প্রয়োজনও নেই। তারা খুব সহজভাবে বোঝে শহর আর গ্রামের মধ্যেকার জীবনযাপনের পার্থক্যটা।
তারা বোঝে শহরে শুয়ে বসে থেকে খাওয়ার সুযোগ নেই। কাজ করে খেতে হয়। যে যেখানে যেভাবেই থাকুক মাস শেষে তার ঘর ভাড়া গুনতে হয়, কারেন্ট, পানির বিল দিতে হয়। চাল, ডালসহ সবকিছুই কিনে খেতে হয়। এ কারণে শহরে এই সব চাহিদা মেটাতে কর্ম করার কোনো বিকল্প নেই। শহরের ক্ষুদ্র পেশাজীবি মানুষের কাছে তাই ‘কর্মই ধর্ম’। কেননা কর্ম না করতে পারলে না খেয়ে থাকতে হয়। ক্রমাগত দায়-দেনাও বেড়েও যায়।
ঢাকা শহর বরাবরই শ্রমজীবী বা দরিদ্র মানুষের প্রিয় এক জায়গা। কেননা এই শহর বরাবরই দরিদ্র মানুষের বুকে টেনে নিয়েছে, ঠাঁই দিয়েছে। গ্রামের সবচেয়ে অসহায় দরিদ্র বিপদাপন্ন মানুষটিও দেখেছে ঢাকা শহরে এসে একটু পরিশ্রম করলে, রিকসা চালালে রাস্তাঘাটে ওটা-ওটার পসরা নিয়ে বসলে খেয়েপড়ে বেঁচে থাকার কোনো অসুবিধা হয় না। একটু কাজ করলে কড়কড়ে টাকা হাতে আসে, গ্রামে যা অনেকটাই কঠিন।
কিন্তু করোনা দুর্যোগের কারণে সেই ঢাকা শহর কেবলই নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। করোনা দুর্যোগ শহরের দরিদ্র মানুষের জীবনকে ভীষণরকম দুর্বিসহ করে তুলেছে। অনেকেই তাই চলে গেছেন শহর ছেড়ে নিজ গ্রামে। আর যারা আছেন তারা খুব ভালো নেই। ধারাবাহিক লকডাউনের কারণে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। রাজধানীর দরিদ্রদের মধ্যে একটি বড় অংশ যাদের জীবন-জীবিকা নির্ভর ঢাকার অলিগলি। মূল রাস্তা নয়, অলিগলিতেই তারা নিত্য ধরনের পণ্য যেমন বিক্রি করেন তেমনি নিত্য ধরনের সেবাও প্রদান করেন। একসময় তাদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ ছিল। কিন্তু এখন তাদের জীবনে নেমে এসেছে ভয়াবহ অর্থনৈতিক দুর্যোগ। গলির ভেতর চিৎকার দিতে দিতে মুখ দিয়ে রক্ত বের করে ফেললেও সেই আগের মতো বেচাবিক্রি নেই। তাদেরই ভাষ্যমতে, তাদের অনেকেই পেশা ছেড়ে দিয়ে এখন ভিক্ষাবৃত্তি করেন।
তাদের কষ্টের গল্পগুলো আপনার বা আমার খুব একটা অজানা তা নয়। আমরা এখন সবাই নিজ চোখেই দেখতে পাচ্ছি-অলিগলির সেই ক্ষুদ্র পেশাজীবীদের করুণ অবস্থা। কীভাবে বেঁচে আছে সেই মানুষগুলো?
প্রথমে বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার কৃষ্ণকাটি গ্রামের বশিরের কথা বলি। দুই সন্তানের জনক বশির গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ঢাকায় মোহাম্মদপুর এলাকার অলিগলিতে বিভিন্ন মৌসুমী ফল বিক্রি করেন।
রায়েরবাজার আড়ৎ থেকে যখন যে ধরনের ফল পান সেই ফল ভ্যানে নিয়ে ছুটে যেতেন পাড়া মহল্লায়। আগে এ ধরনের ব্যবসা করে প্রতিদিন গড়ে আটশত থেকে এক হাজার টাকা লাভ করতেন। দুপুরের খাওয়া আর রাস্তার খরচাপাতি বাদ দিয়ে তার ছয় সাতশত টাকা টিকতো। এই টাকা দিয়ে সংসার চালাতেন। কিন্তু লকডাউন আসার পর বশিরের এই ব্যবসা নেই বললেই চলে। করোনা পরবর্তীতে লকডাউন শুরু হলে কিছুদিন বেকার ছিলেন, কোনো কাজই করতে পারতেন না। এখন আবার মালামাল নিয়ে রাস্তায় বের হন। কিন্তু রাস্তাঘাটে জনগণের আনাগোণা না থাকার কারণে মালামাল তেমন বিক্রি হয় না। এখন প্রতিদিন ভ্যানে বিভিন্ন ধরনের আম নিয়ে বের হন। বশিরের ভাষ্য এখন চালান (পুঁজি) উঠানোই দায়। পাড়া মহল্লায় ঘুরেন কিন্তু ক্রেতা কম। আবার কেউ কিনতে চাইলেও দাম একদম কম বলে।
বশির মিয়া জানান, করোনার কারণে পরিবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন রায়েরবাজারে একটি মেসে থাকেন। তার জীবন-জীবিকা এখন বিরাট এক সংকটের মুখে। দুই হাজার টাকা মেস ভাড়া, প্রতিদিন ষাট টাকা ভ্যান ভাড়া এবং খাওয়া-দাওয়ার খরচ বাদ দিলে মাসে তেমন কিছুই থাকে না। কোনোরকমে চলছেন। বাড়িতে দায়দেনাও বেড়ে গেছে তার। করোনার কারণে খাওয়া-দাওয়াতেও পরিবর্তন এনেছেন। আগে একটু মাছ মাংস খেলেও এখন অভাবে আর খেতে পারেন না।
ঠিক একই অবস্থা ভোলার লালমোহনের বণি আমিনের। বণি আমিনের পেশা ভ্যানে করে শাকসবজি বিক্রি করা। প্রতিদিন বেড়িবাঁধ এলাকার আড়ৎ থেকে সবজি আনতেন এবং তা বিভিন্ন মহল্লার গলি বা মোড়ে দাঁড়িয়ে ব্রিক্রি করতেন। কিন্তু লকডাউনের কারণে তার ব্যবসায় ধস। পুলিশের চোখ রাঙাণি আর নানাবিধ বিধি নিষেধের কারণে আগের মতো ব্যবসা করতে পারেন না। আবার ক্রেতাও কম।
ছোট ছোট হোটেল এবং পাড়া মহল্লার মেস বন্ধ হওয়ার কারণে সবজির কদর আগের মতো নেই। বণি আমিন বলেন, প্রতিদিন এখন কিছু কিছু সবজি নিয়ে মহম্মদুপরের নবোদয় হাউজিং, মোহাম্মাদিয়া হাউজিং লিমিটেডসহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকার অলিগলিতে গিয়ে হাঁক দেন। কিন্তু বেচাবিক্রি তেমন হয় না। করোনা আর লকডাউনের কারণে তার আয় রোজগার একদম কমে গেছে। বণি আমিন বলেন, ‘কীভাবে যে এখন দিন চলছে বলতে পারবো না। বেচাকেনা একেবারে নেই। খুব কষ্ট হচ্ছে। কোনোরকমে দিন কাটছে। পরিবার নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন চলে।’ বণি আমিন জানান তিনি আগে প্রতিমাসে সাত থেকে দশ হাজার টাকা বাড়িতে পাঠাতেন স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের জন্য। কিন্ত প্রতিমাসে এখন টাকা পাঠানো কঠিন হয়ে পড়েছে। নিজেই ভালোমতো খেতে পারেন না।
ভ্যানে করে বিভিন্ন ধরনের পাপোস বিক্রি করেন রহমত আলী। রহমতের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলাতে। মোহাম্মদপুর এলাকার অলিগলি তার প্রিয় জায়গা। আগের মতো তার বিক্রি নেই। সপ্তাহে যা বিক্রি করেন তা দিয়ে তার নিজেরই পেট চলে না। রহমত জানান, আগে বিভিন্ন মহল্লায় মেলা হতো। মেলাতে পাপোস ভাল বিক্রি হতো। কিন্তু লকডাউনের কারণে মেলা বন্ধ হওয়ায়-ব্যবসা আর ভালো চলছে না।
বশির, রহমত বা বণি আমিনের মতো হাজার হাজার এরকম ক্ষুদ্র হকার রয়েছেন যাদের পেশা হলো পাড়া-মহল্লার সাধারণ ক্রেতাদের ছোট ছোট চাহিদা মেটানো। মোহাম্মদপুর এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে নিম্নআয়ের মানুষেরা এ ধরনের কয়েকশত রকমের কাজের সাথে যুক্ত। যাদের জীবন জীবিকা একেবারেই পাড়া-মহল্লা ভিত্তিক। পাড়া মহল্লার অলিগলিই যাদের দুমুঠো অন্নের সংস্থান করে। পাড়া মহল্লার অলিগলিতে যে সব পেশার মানুষদের ভ্যান গাড়িতে বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি বা অন্যান্য সুবিধা প্রদান করতে দেখা যায় এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-সবজি বিক্রেতা, মুরগি বিক্রেতা, মুড়ি-ছোলা বিক্রেতা, রসুন- পেঁয়াজ বিক্রেতা, ফল বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতা, চা বিক্রেতা, ঝাড়– বিক্রেতা, পাপোস বিক্রেতা, মশা-মাছি মারার ওষুধ বিক্রেতা, শরবত বিক্রেতা, গামছা বিক্রেতা-এরকম আরও নানান বৈচিত্র্যময় পেশার মানুষ রয়েছে। এই সব পেশার মানুষই দিনে আনে দিনে খাওয়া মানুষ।
একদিন আয়-রোজগার করতে না পারলে এদের জীবন-ধারণ কঠিন হয়ে পড়ে। এই মানুষেরা কেউ-ই আর ভালো নেই। এই সব পেশার বেশিরভাগ মানুষের কাছ থেকে জানা গেছে অন্য কোনো কাজ তারা জানেন না। অন্য কোনো কাজের সাথে তাদের পরিচয়ও নেই। এ ধরনের ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ে তাদের অভিজ্ঞতা বেশি। ইচ্ছে করলেই তারা মাটি কাটা, যোগালী বা অন্য কাজ করতে পারেন না। অলিগলিতে ব্যবসা করার মধ্যে দিয়েই এরা আনন্দ পান। এই মানুষদের এখন একটাই প্রার্থনা- করোনা কবে যাবে। মহল্লার অলিগলিতে এই বিষন্ন, অসহায় প্রণোদনা বঞ্চিত ক্ষুদ্র পেশাজীবী মানুষের ভীড় কেবলই বাড়ছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)