চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

নগরীতে বৃদ্ধা ভিক্ষুকের সংখ্যা বাড়ছে

‘কাল রাতে কী খেয়েছিলেন?’ সাহায্যপ্রার্থী বৃদ্ধা হনুফা বিবির উত্তর ‘ভাতের সাথে কলমি শাক আর ডাল। সকালে কিছু মুড়ি খেয়েছি। সাথে এক গ্লাস পানি। আর কিছু খাইনি।’ বেলা তখন একটারও বেশি, ৩০ জুলাই শুক্রবার। বৃদ্ধা হনুফা বিবি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের মোহাম্মাদীয়া হাউজিং লিমিটেডের চার নম্বর রোডে অবস্থিত মসজিদের পাশে বসে অসহায় চোখে সবার কাছে হাত পাতছিলেন।

কণ্ঠেও তেমন একটা জোর নেই। চেহারায় ভীষণ বিষন্নতা। ক্ষীণ কণ্ঠে বারবার আহবান করছিলেন ‘বাবারে, কিছু সাহায্য করেন। আপনারা না দিলে কী খাব?’

বৃদ্ধা হনুফা বেগমের বাড়ি ভোলার লালমোহনে। জীবনের দ্বারপ্রান্তে তিনি। দুই মেয়ের মা, ছেলে নেই। মেয়ে দুটোর বিয়ে হয়েছে অনেক আগে। লালমোহনে গ্রামের বাড়িতেই থাকতেন এই বৃদ্ধা। কিন্তু বছর দশেক আগে স্বামী গত হওয়ার পর শহরমুখী হয়েছেন। উপায়ন্তর না পেয়ে চলে এসেছেন ঢাকাতে। বড় মেয়ের কাছেই সেই থেকে শেষ ঠিকানা। থাকেন মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পাশে গলি-ঘুপচির এক ঘরে। বৃদ্ধা হনুফার মেয়ের স্বামী রিকশা চালক। অভাবী পরিবার। কিন্তু দুই সপ্তাহের লকডাউনের কারণে আয় রোজগার আগের মতো নেই। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে। অগত্যা নিরুপায় হয়ে নিজেই ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমেছেন।

করোনার আগে এভাবে রাস্তায় নামেননি। কিন্তু এখন নামতে বাধ্য হয়েছেন। হনুফা বিবি আরও জানান, করোনার আগে ভালোই ছিলেন। কিন্তু করোনা আসার পর জীবনের চিত্র পাল্টে গেছে। খাওয়ার কষ্ট, চলার কষ্ট। যে ঘরে থাকেন সেই ঘরের ভাড়া দুই হাজার টাকা। পানি, গ্যাসের টাকা আলাদা। মেয়ের স্বামীর একদিন আয় না থাকলে সংসার চলে না। বলেন, এই ঢাকা শহর এখন ভাল লাগে না। এর চেয়ে গ্রাম অনেক ভাল। কিন্তু গ্রামে যাওয়ার উপায় নেই। সেখানে গেলে কে দেখবে? কে খাবার দেবে? তাই শত কষ্ট বুকে নিয়েই শহর ধরে আছেন। তবে তিনি এও বলেন, এই শহরে হাত পাতলে কিছ নগদ পয়সা পাওয়া যায়। একজন না দিলে আরেকজন দেয়। কিন্তু গ্রামে সেই অবস্থা নেই। শহরের মতো কেউ টাকা-পয়সা দিতে চায় না।

বৃদ্ধা হনুফা বিবির কাছ থেকে জানা গেল এবারের লকডাউনে সরকারের থেকে কোনো সহযোগিতা পাননি। চাল, আটা, তেল লবণ কিছুই পাননি। সরকারি বা বেসরকারি কোনো উদ্যোগ থেকেই কিছু পাননি। তবে আগের লকডাউনে পেয়েছিলেন। বললেন, আগের লকডাউনের সময় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও চাল, আটা, তেল দিয়ে সহযোগিতা করা হয়েছিল। সেগুলো তিনি পেয়েছিলেন।

আদাবর শ্যামলীর টিক্কাপাড়ার নাবিরনের গল্পও এরকম। বয়স হলেও নাবিড়ন আগে এ বাসা ও বাসাতে টুকটাক কাজ করতেন। সিঁড়ি ঝাড় দেয়া, ঘর মোছা-এসব কাজ করে কিছু টাকা পেতেন। কিন্তু করোনাকাল শুরু হওয়ার পর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এখন তাই ভিক্ষার জন্যে পথে পথে দাঁড়ান। মানুষের কাছে অনুনয় বিনয় করেন। কেউ কিছু দেয়, কেউ দেয় না। অনেকে আবার খারাপ ব্যবহার করে। আবার কারো কারো কাছ থেকে বেশিও পান। নাবিরন জানান, খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে। অসুস্থ স্বামী নিয়ে তার সংসার। স্বামী আগে থেকেই পঙ্গু, কাজ করতে পারেন না। এবারের লকডাউনে অন্যদের মতো নাবিরনও কোনো সহযোগিতা পাননি কাউন্সিলর বা অন্য কারো কাছ থেকে। এ কারণে ভিক্ষাবৃত্তিই এখন সম্বল।

বৃদ্ধা হনুফা, নাবিরনের মতো শত, সহস্র বৃদ্ধা এখন দু-হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন রাজধানীর রাজপথে, বিভিন্ন অলিতে গলিতে, দোকান, শপিং মলের সামনে। বিভিন্ন গলির মোড়ে, বাসাবাড়ির সামনে প্রতিদিনই এরকম বৃদ্ধা ভিক্ষুকের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের অসহায়ত্ব চোখে পড়ে। তাদের অস্ফুট আর্তনাদ, করুণ আর্তি শুনতে পাওয়া যায়। এই সব নারীরা কেউই করোনার আগে সেভাবে ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িত ছিলেন না। কিন্তু করোনা দুর্যোগ, লকডাউন তাদের ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য করেছে। ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া এখন যেনো তাদের আর বিকল্প কোনো উপায় নেই।

বাংলাদেশের সংবিধানে শিক্ষা, খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়সহ যে সব মৌলিক অধিকার অনুসৃত আছে তার সব কিছু থেকেই এরা বঞ্চিত। বিভিন্ন বস্তি, ঝুপড়িতে এখনও বিদ্যুৎ, পানি, পয়োনিষ্কাশন এবং যাতায়াত ব্যবস্থার সংকটও প্রকট। ফলে তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হয় আগে থেকেই। যেখানে থাকেন সেখানে প্রয়োজনীয় টয়লেট সুবিধাদির ব্যবস্থাও নেই। গ্রামের তুলনায় সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধাদি প্রাপ্তি থেকেও এরা বঞ্চিত।

সংঘবদ্ধ, বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্তভাবে নগরের বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী নগর হতদরিদ্রদের মধ্যে বয়স্ক নারীদের দুঃখ-কষ্ট সীমাহীন। নানান কষ্ট, সংগ্রাম আর বঞ্চনার গল্প বুকে ধরেই এসব নারীরা রাজধানী ঢাকাতে বসবাস করছেন। অভাব, রোগ-শোকে ভরা এদের জীবন সংসার। অনেকেই নানা টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে ঢাকাতে এসেছেন। অনেক বৃদ্ধা আছেন যারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সহায় সম্বলহীন। ছেলে মেয়ে, আত্মীয়স্বজন কেউ হয়ত ভুলেও খবর রাখেন না তাদের। অন্য কারো আশ্রয়ে আছেন। এরকম হাজার হাজার গল্প পাওয়া যাবে-এই সব বৃদ্ধাদের মুখে।

কিন্তু সবশেষে বলতে হয়-এদেরও পেট আছে, ক্ষুধা আছে। সেই ক্ষুধার কাছে কে না পরাজিত। ক্ষুধার কষ্টই তাদেরকে পথে আসতে বাধ্য করেছে। এই সব নারীদের জন্য সরকার গ্রামে যত ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করছে, শহরে ততোটা নেই। আবার গ্রামের তুলনায় শহরের এইসব নারীরা অনেক বেশি নিগৃহীত এবং ক্ষুধাবঞ্চিতও। নগরের এই সব বৃদ্ধাদের জন্য সরকারের সুস্পষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই বললেই চলে। এই সব নারীদের সুরক্ষার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্যই আলাদা পরিকল্পনা গ্রহণ প্রয়োজন।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)