হলিউড সিনেমা ‘রাস্ট’ এর শুটিং চলাকালে অভিনেতা অ্যালেক বল্ডউইনের ‘প্রপ গান’ (নকল বন্দুক) থেকে ছোড়া গুলি লেগে মৃত্যু হয় হলিউডের ৪২ বছর বয়সী নারী চিত্রগ্রাহক হ্যালাইনা হাটচিনসের! এই দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন পরিচালক জোয়েল সৌজা। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আলোক নির্দেশক বা গ্যাফার সার্জ ভেটনয় সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করেছেন।
তার সেই বক্তব্য ইতোমধ্যে ছুঁয়ে গেছে দেশ বিদেশের সিনেমা সংশ্লিষ্ট মানুষদের। তার লেখাটি স্থান পাচ্ছে বিশ্বের নামিদামি সংবাদ মাধ্যমেও। সহকর্মী চিত্রগ্রাহক হ্যালাইনার সাথে ঘটে যাওয়া এই মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে সার্জের লেখাটি চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের জন্য ভাষান্তর করেছেন নুসরাত শারমিন:
হ্যালাইনা হাটচিনসের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সেদিনের দুঃখজনক সেই ঘটনার পর থেকে সান্ত্বনা ও সমর্থন জানানো শত শত কল, মেসেজ, চিঠি পেয়েছি। সবার কাছে কৃতজ্ঞ। আমি হ্যালাইনাকে চিনি, অল্প সময় ধরে নয়, তার সঙ্গে তার প্রায় সব ছবিতেই কাজ করেছি। মাঝে মাঝে খাবার-পানি ভাগ করে নিতাম। রোদে পুড়েছি, বরফের ঠাণ্ডায় জমেছি। একে অপরের খেয়াল রেখেছি। শতভাগ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি, তিনি আমার দারুণ বন্ধু। ছিলেন!
বিভিন্ন দেশের অনেক গণমাধ্যম থেকেও ফোন পেয়েছি, সবাই জানতে চেয়েছেন সেদিন কী হয়েছিল। অনেক ইন্সটিটিউট এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ফোন পেয়েছি।
হ্যাঁ, আমি হ্যালাইনার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম যখন সেই প্রাণঘাতী শট তার জীবন কেড়ে নেয় এবং নির্মাতা জোয়েল সৌজাকে আহত করে। তাকে আমি বাহুতে ধরে রেখেছিলাম যখন তিনি মৃত্যুর পথে ছিলেন। তার রক্ত আমার হাতে লেগে ছিল।
এমন ঘটনা কেন ঘটেছিল সেই ব্যাপারে আমার বক্তব্য জানাতে চাই। আমি মনে করি আমার অধিকার আছে জানানোর। আর এই ঘটনাটা পুরোটাই দায়িত্বে অবহেলা এবং অপেশাদারিত্বের কারণে হয়েছে।
যার অস্ত্রটি পরীক্ষা করে নেয়ার কথা ছিল, তার দায়িত্বে অবহেলার কারণে হয়েছে। যার জানানো উচিত ছিল যে শুটিং সেটের অস্ত্রটিতে গুলি ভরা আছে, তার অবহেলার কারণে হয়েছে। ফলাফল, একজন মানুষের মৃত্যু!
আমি নিশ্চিত যে, বাকি সব ডিপার্টমেন্টেই পেশাদারিত্ব ছিল, একটি ছাড়া- যেটি অস্ত্রের দায়িত্বে ছিল। একজন চব্বিশ বছর বয়সী মহিলা অস্ত্রাগার বা অস্ত্র সম্পর্কে ধারণা থাকার কথা নয়। তার সমবয়সী স্কুল, পাড়া-মহল্লা, ইনস্টাগ্রাম, সমবয়সী বন্ধুদেরও এই ব্যাপারে ধারণা থাকার উপায় নেই।
পেশাদার তারাই যারা বছরের পর বছর সেটে কাটিয়েছেন, যারা এই কাজটির আদ্যোপান্ত জানেন। তারা সেটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। ট্রাইপডের নিচে স্যান্ডব্যাগ দেয়ার জন্য তাদেরকে আলাদা করে বলে দিতে হয় না, স্টেজে মইটাও ঠিকঠাক ভাবে সেট করেন। যেই সেটে বিস্ফোরণ হবে, তার চারিদিকে বেড়াজাল দিয়ে দিতেও ভুল হয় না তাদের। এগুলো তাদের রক্তে মিশে আছে।
প্রযোজকদের উদ্দেশে বলছি। আমাদের কাজটি দারুণ, তবে বিপজ্জনকও। আমরা পাহাড়ে, পানিতে, পানির নিচেও শুটিং করি। আমরা বিস্ফোরণ দেখাই, গুলি ছোড়া হয়, গাড়ি ক্রাশ হয়, আরও অনেক কিছুই করা হয়। টাকা বাঁচাতে মাঝে মাঝে আপনারা এমন কিছু মানুষকে কাজে নিয়োগ করেন যারা জটিল ও বিপজ্জনক কাজে পুরোপুরি দক্ষ নন, অন্যদের জীবন এবং নিজেদের ঝুঁকিতে ফেলে দেন।
আমি বুঝি যে বাজেট সামলাতে আপনাদের হিমশিম খেতে হয়, কিন্তু এরকম কিছু তো হতে দিতে পারেন না আপনারা। অন্তত একজন দক্ষ কর্মী প্রতিটি ডিপার্টমেন্টে থাকা উচিত যারা কাজ সম্পর্কে জানে। হ্যালাইনার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার মতো এরকম দুঃখজনক পরিস্থিতি এড়াতে এটা অবশ্যই প্রয়োজন। আমি চাইনা আর কারো এমন কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হোক যেমনটা আমার যেতে হয়েছে, যেতে হচ্ছে তার স্বামী ম্যাট হাচিনস এবং ছেলে আন্দ্রোস এবং অভিনেতা অ্যালেক বল্ডউইনের, যার হাতে অস্ত্রটি ছিল। অপেশাদার মানুষগুলোর কারণে এই অভিনেতার জীবন কাটাতে হবে একজন মানুষ হত্যার দায় নিয়ে।
প্রিয় প্রযোজকবৃন্দ, পেশাদার মানুষ নিয়োগ দেয়া মানে অর্থের বিনিময়ে মানসিক আপনার এবং আশেপাশের মানুষদের মানসিক শান্তি কেনা। এটা সত্যি যে দক্ষ লোক নিতে খরচ কিছুটা বেশি হয়, মাঝে মাঝে তারা অনেক বেশি চায়, তবে সেটা তাদের প্রাপ্য। মানুষের জীবনের বিনিময়ে অর্থ বাঁচানোর কোনো মানে নেই।
সবশেষে, প্রিয় প্রযোজকবৃন্দ, মনে রাখবেন শুধু আপনারাই যে মানুষকে কাজের সুযোগ দিয়ে অর্থ কামানোর সুযোগ দিচ্ছেন তা নয়, যাদের কাজের সুযোগ করে দিচ্ছেন তারাও আপনাকে অর্থ কামাতে সাহায্য করছে। মনে রাখবেন!
ক্যামেরা অপারেটর রিয়েদ রাসেলকে ধন্যবাদ যিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন এবং হ্যালাইনাকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। ধন্যবাদ চেরলিন শাইফেরকে যিনি হ্যালাইনার জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করার জন্য সব করেছেন।
আমরা হ্যালাইনাকে ভালোবাসি। সৃষ্টিকর্তা তার আত্মার শান্তি দিক। শান্তিতে থাকুন। সৃষ্টিকর্তা আমাদের রক্ষা করুন।