বাল্যবেলায় বিশ্বাস করতাম, কেউ ইচ্ছে করলেই সাংবাদিক হতে পারে না। এর জন্য তার বিশেষ একটি শক্তি দরকার হয়। যে শক্তি ঐশ্বরিকভাবেই লাভ করতে হয়। সাংবাদিক মানে বিরাট এক বটবৃক্ষ। যার ছায়ায় অনেক কিছু দাঁড়াতে পারে। এই বিশ্বাস আসার পেছনে বড় কারণ ’ইস্পাত’। একটি সংবাদপত্রের নাম ’ইস্পাত’। কুষ্টিয়া শহরের আগেকার কেন্দ্রীয় বাসস্ট্যাণ্ড সংলগ্ন এলাকায় ইস্পাতের অফিস। ইস্পাত শব্দটি কার কাছে কী ছবির সৃষ্টি করে জানিনা, আমার কাছে মনে হয় কঠিন চকচকে এক ছুরি। কোনো কারণ ছাড়াই স্কুল বয়সে ইস্পাত অফিস দেখলে ভয়ে পেতাম। বন্ধুদের কাছে শুনতাম, ইস্পাত অফিসে একজন কঠিন মানুষ থাকেন। বিশ্বাস করতাম, ইস্পাতের ছুরিতে যিনি নিয়মিত ধার দেন তিনিই নিশ্চয়ই সেই মানুষ। মানুষটিকে প্রথম কাছ থেকে দেখলাম নব্বইয়ের দশকের শুরুতে কুষ্টিয়া প্রেস ক্লাবের কোনো এক অনুষ্ঠানে। তখন আমিও ছুটকো সাংবাদিক। কিন্তু ইস্পাত শব্দ শুনে যে ভয়, সে ভয়টি কাটেনি। তখনও বিশ্বাস করি, সাংবাদিক হতে চাইলেই হওয়া যায় না।
তার নাম বহু শুনেছি। কিন্তু তাকে যে কখনো দেখিনি, সে কথা তখন স্বীকার করি না। আমি সাংবাদিক হতে চাই কিন্তু তাকে চিনি না বা তিনি আমাকে চেনেন না এর চেয়ে বড় অযোগ্যতা নেই। তার বক্তৃতা শুনলাম। রাশভারী মানুষের শক্তিশালী কথা। একেবারে গভীর মৌলিক স্বর। এই স্বরই চকচকে ছুরির জন্মদাতা। এই রাশভারী মানুষটির হাতেই তৈরি হয় ‘ইস্পাত’। বুঝলাম সাংবাদিকের কণ্ঠস্বর সহজে কারোর সঙ্গে মেলার কথা নয়। সাংবাদিক পৃথক ভাষায় কথা বলেন। সবাই ঠিক যে জায়গা থেকে সত্যকে দেখতে পায়, সাংবাদিকে দেখে অন্য একটি জায়গা থেকে। ওয়ালিউল বারী চৌধুরীর বক্তৃতা শুনে সদ্য কৈশোর পেরুনো স্বপ্নচারী হৃদয়টি কিছুটা ভেঙেও গেল। আমি তো তাকে দেখলাম। কিন্তু তিনি তো আমাকে চিনলেন না। এই শহরে সাংবাদিকতা করার জন্য তার সঙ্গে পরিচিতিই যথেষ্ট। আমার বন্ধুদের অনেকের সঙ্গে তার জানাশোনা। আমার সঙ্গে নেই। আমি বহুদূর পিছিয়ে আছি। আমার প্রাথমিক অর্জনটাই তো হলো না।
তারপর বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে। আমি দৈনিক সূত্রপাত পত্রিকায় টানা তিন বছর যুক্ত থেকে গিয়ে পড়েছি আন্দোলনের বাজার পত্রিকায়। কুষ্টিয়া শহরের মতো জায়গায় তখন সাংবাদিকতার মেইনস্ট্রিম বলতে যা মনে হয়েছিল, সেটি আন্দোলনের বাজার পত্রিকা। পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন মনজুর এহসান চৌধুরী। আন্দোলনের বাজার রীতিমত এক তথ্য ত্রাস। জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সকল সরকারি বেসরকারি দপ্তর, রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ সবাই পত্রিকাটিকে হিসাব করে চলে। রাখঢাকহীনভাবে বাস্তব চিত্র তুলে ধরে। খালি চোখে যার কোনো দোষ দেখা যায় না, আন্দোলনের বাজার পত্রিকার হাতে পড়লে তারও দোষ ছাকনিতে উঠে আসে। কুষ্টিয়ার প্রথম আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারকারী পত্রিকা আন্দোলনের বাজার। আমি প্রথম দিন থেকেই সেখানকার কঠিন দৌড়ঝাঁপের মধ্যে অন্তর নিংড়ে দিয়ে যুক্ত হয়ে গেলাম। কিছুদিন বাদেই পত্রিকার কিছু সংবাদ প্রতিবেদনের সূত্র ধরে ওয়ালিউল বারী চৌধুরী আমাকে সামান্য চিনলেন। আমি তাকে কখনো আন্দোলনের বাজার অফিসে আসতে দেখিনি। পুত্রের সঙ্গে পিতার সম্পর্ক অন্যরকম। ব্যক্তিত্ব ও চিন্তায় দুজনের যথেষ্টই ভিন্নতা। যদিও খুঁজে পাইনি। অনেকে বলেন পিতা-পুত্র চিন্তা চেতনায় একই রকম। তবে ওয়ালিউল বারী চৌধুরী যে তার সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে আপাত.দৃষ্টিতে সবকিছুর উর্দ্ধে ওঠার যে ধী শক্তি রাখতেন, তার পুত্র মনজুর এহসান চৌধুরী কিংবা হাসান ইমাম চৌধুরীর মধ্যে তার কিছুটা হলেও আছে।
কুষ্টিয়া শহরের সামাদ কমিশনার দুবৃত্তদের হাতে খুন হয়েছেন। আমি সংবাদটি লিখেছি। ফোন পেলাম বড় চৌধুরীর। বললেন, ‘কমিশনার সামাদ আর নেই, তার মানে কি? তার কি থাকার কথা ছিল?’ ফোন ধরে হকচকিয়ে গেলাম। বললেন, ‘মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, সন্তানসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। মানে কী? এগুলো রেখে যাবেন না তো নিয়ে যাবেন’ খবরটি কে লিখেছে? বললাম, আমি। জীবনে কোনোদিন এমন ধরণের কোনো প্রশ্ন শুনিনি। বললাম, চাচা, এভাবেই তো পত্রিকায় লেখা হয়, তাই লিখেছি। বুঝলাম, জবাবটি তার মনোপুত হলো না। আমি সেদিন চরম ভড়কে গিয়েছিলাম।
আন্দালনের বাজারে আমি নিয়মিত একটি কলাম লেখা শুরু করলাম। নাম ‘নন্দঘোষের কলাম’। মাঝে মাঝে কলামের বিষয় তত্ত্বাবধান করতেন সম্পাদক। একসময় কলামটি তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রচুর পাঠকের ফোন আসতে থাকে। একদিন চাচা ফোন দিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। বললেন, জানো তুমি কি লিখছো? রীতিমত আগুন। খুব ভালো, লিখে যাও। শুধু এই কথাটিই স্বপ্নের চূড়ায় ওঠার মতো মনে হলো। তখন টানা ছয় সাত বছর সাংবাদিকতা করে নিজের কোনো অর্জনই খুঁজে পেতাম না। চাচার এই কয়েকটি বাক্যই মনের ভেতর প্রত্যয় এনে দিল, চাইলে সাংবাদিক হতেও পারি। এত বড় মানুষের স্বীকৃতি পেয়ে গেলাম। আর কিছু লাগে না। চাচা একদিন নন্দঘোষের কলামের জন্য একটি বিষয় দিলেন। কোনো দপ্তরের দীর্ঘ অনিয়মের বিষয়। মনে আছে, চাচার দেয়া বিষয়টির শিরোনাম করলাম, ‘কর্তা যাহা করেন তাহাই কর্ম’। কলামটি প্রকাশিত হওয়ার একদিন পর চাচা ফোনে জানালেন, শোনো ওই কর্মকর্তা সাসপেণ্ড হয়ে গেছে। সংবাদপত্রের খবরে এত দ্রুত কাজ হতে পারে, এই সত্য আজকের দিনে বিস্ময়কর মনে হতে পারে। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে সংবাদের শক্তি নিয়ে যদি গভীরতর গবেষণা করা হয়, তাহলে ওয়ালিউল বারী চৌধুরীর নাম আসবে। তিনি এক কলামে কয়েক লাইন খবর লিখে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারের চেয়ার নড়িয়ে দিতেন। ইস্পাত সম্পাদনা করতে দিয়ে ভুরিভুরি মামলা খেয়েছেন। সাবলীল ও স্বপ্রতিভ থেকেছেন। কোনোকিছুতে সামান্যতমও টলেননি।
ওই এক কলামের সুবাদে চাচার স্নেহদৃষ্টির কিছটা গ্রহণ করতে পেরেছিলাম। তিনি আন্দোলনের বাজার সম্পাদককে ফোন করে আমার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেয়ার তাগিদ দিয়েছিলেন। আমার জন্য নির্ধারিত মাসিক বেতনের বাইরে প্রতিদিন পঞ্চাশ টাকা বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা হয়েছিল।
আমরা ঠিক বুঝতাম না ওয়ালিউল বারী চৌধুরী কত বড় মাপের সাংবাদিক ছিলেন। সর্বজনশ্রদ্ধেয় সাংবাদিক বলেই আমরা আমাদের কর্তব্যের ইতি টানতাম। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের সাংবাদিক সমাজে তার ছিল অন্যরকম খ্যাতি। এশিয়া মহাদেশের প্রথিতযশা সাংবাদিক হিসেবেও তিনি খ্যাতি ও সম্মান পেয়েছেন। কিন্তু থেকেছেন নিশ্চুপ, ধীমান। কখনও নিজের খ্যাতি ও সম্মান প্রচারের পক্ষপাতি ছিলেন না। ১৯৯৬ কি ৯৭ সালের কথা। চাচার সঙ্গে বেশ দহরম মহরম হয়েছে। আমি বলি, চাচা আত্মজীবনী লেখার কাজে হাত দেন। বিপুল বিস্তৃত বর্ণাঢ্য জীবন আপনার। চাচা বলেন, আমি নজরুলের লেটো গানের দল নিয়ে বড় একটি কাজ করতে চাই। এ সম্পর্কে অনেক তথ্য ও নথি যোগাড় হয়েছে। কাজটিতে তুমি আমার সঙ্গে থেকো। আমি বলি, এটি তো আমার জন্য অনেক বড় সুযোগ হতে পারে। ঠিক এই সময়টিতে চাচা একটি আমন্ত্রণ পেলেন চীনের পিপলস্ ডেইলি থেকে। পিপলস্ ডেইলির অর্ধশতাব্দী উদযাপন অনুষ্ঠানে তিনি বিশেষ অতিথি। কি বিশাল ব্যাপার। চীনদেশ থেকে ওয়ালিউল বারী চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী পত্রিকার বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে। মনে আছে, এই গর্বের উষ্ণতায় আমি কিঞ্চিৎ হলেও আলোকপ্রাপ্ত হয়েছিলাম।
‘একজন নির্ভীক সাংবাদিকের কোনো বন্ধু নেই’ শুধু কথার কথা নয়। এমন সাহসী উচ্চারণ ইস্পাত পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামের ওপরে স্থায়ীভাবে যুক্ত করে রাখা এবং এই একই চেতনা সম্পাদক হিসেবে গভীরে লালন করা এক বিশাল ব্যাপার। যতদিন যত ফোরামে ওয়ালিউল বারী চৌধুরীর বক্তব্য শুনেছি, যেখানেই যে কথা শুনেছি, সেখানেই তার তৃতীয় স্বর পেয়েছি, যেটি কারো সঙ্গে মিলবে না। যে যুক্তি কখনো কারো মাথায় কাজ করেনি। উচ্চারণের সেই পরিশীলিত সাহস কারো মধ্যে আসেনি। তার মুখাবয়ব ছিল উদ্বেগ উৎকণ্ঠাহীন ও নির্লিপ্ত। ’কোনো বন্ধু নেই’ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তিনি সত্যের শক্তি প্রত্যাশী সাধারণ জনগণের বন্ধু হয়ে যেতেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থে তার সঙ্গ ও নিত্যকার জীবনে যুক্ত থাকতেন হাতে গোনা মানুষ। তিনি গয়রাহ সবার সঙ্গে মিশতেন না। সব সমাজে নিজের প্রভাব সৃষ্টির উটকো প্রত্যাশাও কখনো কেউ দেখেনি। কুষ্টিয়া শহরের কেন্দ্রস্থলের বড় একটি অংশ তার পূর্বপুরুষের জমিদারি সম্পত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে উনিশ শতকের বড় বড় কবি, সাহিত্যিক তার বাবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে বাড়িতে আসতেন। সেই ঐহিত্যের উচ্চতা তিনি ধারণ করতেন। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের রণাঙ্গনে প্রথম সংবাদপত্র ‘স্বাধীন বাংলা’ প্রকাশের যে গভীর ও বিশাল জাতীয় দায়িত্ব তিনি পালন করেছিলেন, সেই শক্তি ও গর্ব তিনি ধারণ করতেন। যদিও তার মুখে কখনো এসব কথা শোনা যেত না। সময়ের সুগভীর পর্যবেক্ষণ তার স্বভাবের সঙ্গে লেগে থাকতো। একজন আদর্শ সম্পাদক বা সাংবাদিকের জীবন কেমন হওয়া উচিৎ, বোধ করি তার জীবনের কাছাকাছি গভীর পর্যবেক্ষণ করলেই পাওয়া যেত। আমরা যদিও অত বেশি কাছে যাওয়ার সুযোগ পাইনি।
১৯৯৯ সালে কুষ্টিয়া থেকে ঢাকা চলে এলাম। চাচা তখন ঢাকা-কুষ্টিয়া করেন। দেশের শীর্ষ পর্যায়ের স্কাউট সংগঠক হওয়ার কারণে কাকরাইল স্কাউট ভবনে তার জন্য কক্ষ বরাদ্দ থাকতো। একবার গিয়েছিলামও। ঢাকার সাংবাদিকতা সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন। তারপর বহুদিন যোগাযোগ নেই। কয়েক বছর আগের কথা। আমি তখন নিয়মিত ক্রিটিক প্রকাশ করছি। চাচার ঠিকানায় ক্রিটিক যায়। আমি বান্দরবানে রিপোর্টিং বিষয়ক কাজে। মাতামুহরি নদীর পাড় দিয়ে যাচ্ছি। চাচার ফোন পেলাম। ক্রিটিক দেখে উচ্ছ্বসিত তিনি। আমি সবিনয়ে নানা সীমাবদ্ধতার ভেতর পত্রিকা প্রকাশের কিছু অভিজ্ঞতা বললাম। তিনি বললেন, এভাবেই হয়। ‘তিলডা কুড়াতে কুড়াতেই বেলডা পাওয়া যায়’। অসাধারণ এক বিশ্বাস জাগানিয়া প্রবচন শুনে ভেতর থেকে সাহসী হয়ে উঠলাম। পরে চাচা আমাকে উৎসাহ দিতে ক্রিটিকের জন্য একটি লেখাও পাঠিয়েছিলেন। তারপর নানা বিষয় নিয়ে একদিন ফোনে কথাও হলো। আমার কাজকর্মের খোঁজ নিলেন। বললেন, আমি খবর রাখি।
আমি বুঝে গেলাম, এই খবর রাখা মানে মাথার উপর আশির্বাদের ছায়া ফেলে রাখা। বহুদিন ভেবেছি কুষ্টিয়া গিয়ে দীর্ঘ সময় আলোচনা করবো চাচার সঙ্গে। অসাধারণ ও নির্ভুল কথা বলেন তিনি। তার কথা টানা মোবাইলে রেকর্ড করলেই একটি অন্যরকম অভিজ্ঞতা মাখা সমৃদ্ধ লেখা হয়ে যায়। কিন্তু সেই সুযোগটি আর হলো না। খুব মনে বাজছে, তিনি বলতেন, ‘ভালো বলনেওয়ালী ভালো লেখনেওয়ালী হয় না। কেউ যদি লিখতে চায়, বেশি বলার অভ্যাস আগে তাকে ছাড়তে হবে।’ এই গুরুবাক্য আজ খুব বেশি মনে পড়ছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)