চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ধান কাটা তত্ত্ব, ছবি প্রদর্শন ও কৃষকের কান্না

ফেসবুকের কল্যাণে সারা দেশে বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও গ্রুপের সৌজন্যে কৃষকের খেতের ধান কাটার দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়েছে। তবে একটি বিষয় মোটামুটিভাবে লক্ষণীয় যে, প্রায় সকলেই ধান কাটার দৃশ্য ফেসবুকে শেয়ার করেছে। যারা শেয়ার করেছে তাদের যুক্তি এরূপ-অন্যদেরকে উৎসাহিত করার জন্য ফেসবুকে ছবি পোস্ট করা হয়। দুঃখের বিষয় হচ্ছে; যে আয়োজন করে ধান কাটার ছবি ফেসবুকে দেয়া হয়েছে সেখানে তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অবশ্যই। কারণ অনেককে দেখা যায়, জুতা স্যান্ডেল পরিহিত অবস্থায় ধান ক্ষেতে গেছে ধান কাটার জন্য। ধান ক্ষেতে জুতা স্যান্ডেল পরে গেলে আর যাই হোক কৃষকের লাভ হবে না কোনমতেই। লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন নিয়ে যখন ক্ষেতে যাওয়া হয় তখন উদ্দেশ্য ফটোগ্রাফ ফটোশুট এই সীমাবদ্ধ হওয়ার কথা।

ধানের দামের এই অবনমনের সময় ধানগাছের পুরো অংশটাই যদি কৃষক ব্যবহার করে তাহলে কিছুটা হলেও কৃষকের উপকার হবার কথা। কেননা, ধানের ছড়ার নিচের অংশ খড় হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং খড়ের নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে। কাজেই খড় বিক্রির মাধ্যমে কৃষকের সামান্য হলেও লাভবান হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু ফেসবুকের কল্যাণে যে ছবিগুলো আমরা দেখেছি, সেই সব ক্ষেতের খড় ব্যবহার করার কোন সুযোগ থাকে না। কেননা, ছবি পোষ্ট করা থেকে বোঝা যায়, তারা ধানের ছড়াটুকু কেটে কোনক্রমে দায় সেরেছে, সেখানে কৃষক লাভবান বা লোকসান এ নিয়ে তাদের লেশমাত্র নেই। তার মানে এই দাঁড়ালো প্রকারান্তরে তারা কৃষকের ক্ষতিই করেছে। আমারও মনে হয়, তারা কখনোই কোন ধান ক্ষেত সম্পূর্ণ শেষ করে কেটে আসে না। ফটোসুট করেই ধান ক্ষেত থেকে বেরিয়ে আসে। তবে কিছু মানুষের উদ্যোগ যে ইতিবাচক হবে না তা অবশ্য বলা যাবে না। নিজস্ব উদ্যোগে ঐ সকল মানুষ এবং ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান প্রকৃতঅর্থে কৃষক সমাজকে সহযোগিতা করেছে এবং যার অধিকাংশই প্রচার প্রচারণার বাইরে থেকেছে।

এইযে ধানের ন্যায্য দামের জন্য কৃষকদের হা হুতাশ সে বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপের অভাবও কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার পরিপন্থী। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ধানের দাম নির্ধারণ নিয়ে খামখেয়ালী বক্তব্য বাংলাদেশের কৃষক সমাজকে আশাহত করেছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতির পেছনে কৃষি/কৃষক/কৃষিভিত্তিক সমাজের ভূমিকা অগ্রগণ্য। বাংলাদেশের আজকের যে উন্নয়ন অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে তার জন্য হাতিয়ার হিসেবে বাংলাদেশের কৃষক সমাজের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি কৃষি পণ্য উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় পর্যায়ে রয়েছে এবং যেগুলো রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশের কোষাগার সমৃদ্ধ হচ্ছে। কাজেই, কৃষি, কৃষক সমাজ ও কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ ছাড়া বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কোনভাবেই সম্ভব হবে না।

কয়েকজন কৃষকের সাথে সরেজমিনে কথা বলে তাদের দুরবস্থার কথা জানা যায়। তারা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, ধানের ন্যায্যমূল্য না পেলে এ পেশা থেকে অনেকেই বিচ্যুত হয়ে যাবে। আবারও অনেকেই আশাবাদ ব্যক্ত করেছে, সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়ে কৃষকের সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হবে। মোটা দাগে যে সব সমস্যার কথা উঠে আসে তার মধ্যে প্রথমেই তারা বলেন; শিল্প ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা গঠনের সাথে সাথে দৈনিক ভিত্তিতে শ্রমিক পাওয়া মোটামুটিভাবে দুষ্কর হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয়ত: দৈনিক ভিত্তিতে শ্রম দেয় এমন শ্রমিকদের কিছু গ্রুপ তৈরি হয়েছে যাদের কাছে কৃষকরা জিম্মি এবং যার ফলে শ্রমিকের দৈনিক মজুরীর পরিমাণও বেশি। তৃতীয়ত: কাজের বৈচিত্র্যতা থাকায় দৈনিক ভিত্তিতে শ্রমিকদের অপ্রতুলতা দেখা যায় প্রতিনিয়ত। চতুর্থত: সারা বছর মজুরী ভিত্তিতে শ্রম প্রদানের সুযোগ না থাকায় অন্যান্য পেশার দিকে ঝুঁকছে শ্রমিকেরা। এ বিষয়গুলো কৃষকদের স্বাভাবিক দামে শ্রমিক পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে।

সুতরাং ধানের বীজ বপন থেকে শুরু করে ধান ঘরে তোলা অবধি একজন কৃষককে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। সাথে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হুমকি ও সম্ভাবনা তো থাকেই। নানা রকম প্রতিকূল পরিবেশে থেকেও নিরবচ্ছিন্ন শ্রম দিয়ে কৃষক যখন পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পায় সেটা তখন কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার জন্য বিপরীত পর্যায়ে অবস্থান করে। বর্তমানে গ্রামে দৈনিক মজুরী ৮০০ টাকা করে সেখানে ১ মণ ধানের মূল্য ৫০০ টাকা, বিশ্লেষণে সহজেই কৃষকের শোচনীয় অবস্থা ফুটে উঠে। কাজেই, কৃষককে বাঁচাতে হবে বাংলাদেশের সমৃদ্ধির স্বার্থেই। অন্যথায় বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার যে সোপানের যাত্রা বহমান সেটি বাধাগ্রস্ত হবে।

উদ্ভূত পরিস্থিতি ও সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারকে জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে ধানের যে ফলন হয়েছে তা আমাদের কৃষিব্যবস্থা ও কৃষকদের অনুপ্রাণিত করবে যদি ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা যায়। ধানের মূল্য বৃদ্ধির জন্য যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন তা নিম্নরূপ:

১. কৃষিতে ধান কাটা ও ধান মাড়াইয়ের জন্য উদ্ভাবনীমূলক ও আধুনিক প্রযুক্তি সম্মত মেশিন ও যন্ত্র বাংলাদেশের কৃষিতে অন্তর্ভুক্ত করা।

২. বেশি উৎপাদন সাপেক্ষে চাল আমদানি বন্ধ করতে হবে।

৩. বেশি উৎপাদন সাপেক্ষে চাল রপ্তানি বৃদ্ধি করতে হবে।

৪. দেশীয় বাজারে বাংলাদেশী চালের চাহিদা বৃদ্ধিকরণকল্পে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

ধানের ন্যায্যমূল্যের দাবিতে কৃষকেরা অভিনব পদ্ধতিতে প্রতিবাদ জানিয়েছে। কৃষকদের এই প্রতিবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। সাড়া জাগানোর পরেই বিভিন্ন মাধ্যম থেকে কৃষকদের স্বার্থে ছোট বড় পদক্ষেপ নেওয়া হলেও বাজারে ধানের মূল্য বৃদ্ধি পায়নি। কিছু জায়গায় সরকারি উদ্যোগে ধান কেনা হয়েছে কিন্তু সেটা কৃষকদের মাঝে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি।

কাজেই কৃষকদের স্বার্থে সরকারি উদ্যোগে যুতসই ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। কেননা কৃষিবান্ধব সমাজে কৃষকই মূল প্রাণের চাবিকাঠি। আমরা যতই শিল্পবান্ধব সমাজের দিকে ধাবিত হই না কেন আমাদের শেকড় কিন্তু কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায়। সে দিক বিবেচনায় নিয়ে কৃষকদের স্বার্থে নীতি নির্ধারকদের কৃষি ও কৃষক বান্ধব নীতি প্রণয়ন প্রয়োজন।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)