প্যান্ডোরার বাক্স খুলবেন না…। ধর্ষককে ক্রসফায়ারে দেবেন না। তাকে দ্রুত বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্ত তৈরি করবার জন্য কঠোরতম শাস্তি নিশ্চিত করুন।
ফেসবুকে দেখছি, ধর্ষককে ক্রসফায়ারে দেবার বা প্রকাশ্যে বিচার করার জনদাবী ওঠেছে। জনপ্রিয়তা ধরে রাখার খাতিরে ‘জন দাবী’ মেটাতে গিয়ে ফাঁদে পা দেবেন না। অন্যায়ের বদলে আরেকটা অন্যায় করে শোধ নেয়ার প্রক্রিয়ায় রাগ ও ক্ষোভ মিটতে পারে বটে। কিন্তু দীর্ঘ সময়ের জন্য এটি কোনো সুষ্ঠু সমাধান নয়। বরং চোখের বদলে চোখ নেয়ার তরিকা একটি প্যান্ডোরার বাক্স। এই বাক্সের মুখ খুলে গেলে পরিণতি ভয়াবহ।
ক্রসফায়ার বা প্রকাশ্যে নৃশংস শাস্তি বা ফায়ারিং স্কোয়াড বা সৌদি স্টাইলে গর্দান নেয়া কোনো সমাধান নয়। এন্টি-বায়োটিক খেতে খেতে মানুষের শরীরে যেমন এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী দশা তৈরি হয়, তেমনি বিপজ্জনক এই ক্রসফায়ার ও গর্দান নেয়ার বন্দোবস্ত।
সৌদি আরবে বছরে কত লোকের গর্দান নেয়া হয়? সেই হিসেব দেখুন আর সেখানে ধর্ষণের সংখ্যা দেখুন। এতো গর্দান নেয়ার পরো সেখানে নারীদের জীবনের বাস্তবতা কি আপনাকে আশাবাদী করে? সেই দেশ থেকে ধর্ষিত হয়ে ফিরে আসা আপনার দেশের নারী কর্মীদের কথা মনে করে দেখুন। নারী সম্পর্কে সেই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী কি আপনাকে আশাবাদী করে?
আর ক্রসফায়ারের কথা বলছেন? এটি নিজেই একটি প্রশ্নবিদ্ধ তরিকা। একটি অন্যায়ের জবাবে আরেকটি অন্যায় কখনোই সামগ্রিক অর্থে সমাজের কল্যাণ বয়ে আনে না। একদিন রিফাতের খুনীকে ক্রসফায়ারে দেয়া হবে। আরেকদিন হারকিউলিস চিরকুট রেখে খুন করে যাবে। অন্য একদিন, মারা যাবে একরাম। আরেকদিন হয়তো মজনু বা মিজান বা আর কারো নাম লেখা হবে অন্য কোনো বুলেটে। এইভাবে কি একটি সুস্থ্য সমাজ নির্মাণের পথে এগিয়ে যাওয়া আদৌ সম্ভব? এইভাবে কি মানুষের মধ্যে, ধর্ষকদের মধ্যে আইন মানার মানসিকতা আসবে?
তাই আমার বিনীত অনুরোধ, ধর্ষককে আইনানুগ পন্থায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিশ্চিত করা হোক। তাহলে, সেটি সমাজের ধর্ষক-মানসিকতার অন্যান্য পুরুষদের জন্য সতর্ক সংকেত হবে। পাশাপাশি এই ধর্ষণকাণ্ডের অপরাধী যত দ্রুত ধরা পড়েছে বাড্ডায় স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণকারী এবং ধর্ষকের সহযোগীদেরো দ্রুততম সময়ের মধ্যে কঠিনতম শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।
এছাড়া সরকারী যে নারী কর্মকর্তাকে যৌন হয়রানির অভিযোগ করার পর চাকুরী থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে সেটিরও সুষ্ঠু তদন্ত করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হোক।
সরকারের জন্য আমার প্রস্তাব
দেশব্যাপী নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ বিরোধী একটি বিশেষ ক্যাম্পেইন বা প্রচার অভিযান চালানোর প্রস্তাব করছি। এই ক্যাম্পেইন হতে পারে এক বা তিন বা ছয় মাসব্যাপী। এই ক্যাম্পেইন চলার সময়েই সরকারকে একটি ‘বিচার-মাস’ চালু করার প্রস্তাব করছি। এই বিচার-মাসের আওতায় সারাদেশে ঝুলে থাকা ধর্ষণ মামলাগুলোকে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হোক। আর ক্ষমতাবান যেসব আসামী পালিয়ে বেড়াচ্ছে তাদের দ্রুত গ্রেফতার করা হোক। এই কাজগুলো করা গেলে আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যেই সারাদেশে মানুষের মধ্যে একটা কড়া বার্তা পৌঁছে যাবে। ধর্ষণ করার আগে ধর্ষক জানের ভয় করবে।
এ ধরণের ক্যাম্পেইন এর আগেও বাংলাদেশে সফল হয়েছে। এসিড সন্ত্রাস বিরোধী ক্যাম্পেইন এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ ছিল সরকারে পক্ষ থেকে নেয়া তেমনি একটি উদ্যোগ। নব্বইয়ের দশকে দেশে এসিড মারা একটা মহামারী সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন সরকারের কঠোর মনোভাবের কারণে এসিড সন্ত্রাস অত্যন্ত দ্রুত হারে কমে যায়।
যৌনসন্ত্রাস বন্ধের ক্ষেত্রেও বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হোক। কিছু ঘটনার বিচার অতি-দ্রুত হবে আর কিছু ঘটনার বিচার চলবে শম্বুক গতিতে, তেমন যেন না হয়। ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত সরকারী, বেসরকারী সকল রাঘব-বোয়ালকে অভিযান চালিয়ে ধরা হোক। পুলিশকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হোক। ধর্ষণের মামলাগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা যেন বিশেষ তৎপর হয়।
আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এই কাজগুলো করে দেখালে ধর্ষক-প্রবন মানসিকতার পুরুষেরা একটু হলেও ভয় পেতে বাধ্য। আর যদি তা না করা হয় তাহলেই মানুষ ভাববে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী বলে, তার পক্ষে আন্দোলনে শহর অচল করে দেয়ার জন্য মানুষ আছে বলে এবং তার পক্ষে মিডিয়া দেশ সরগরম করে ফেলতে পারে বলেই এই ধর্ষক ধরা পড়েছে।
ব্যাপারটা যদি তাই হয়, তাহলে এমন বিচার আদতে সৎ কোনো দৃষ্টান্ত তো তৈরি করবেই না, উল্টো খারাপ উদাহরণ হয়ে থাকবে। ধর্ষন-প্রবণ পুরুষেরা রেপ করার ক্ষেত্রে আরো সাবধানী হবে। হয়তো ঝামেলা এড়াতে ভিক্টিমকে মেরেই ফেলবে। হয়তো লাশ গুম করে ফেলবে। তাছাড়া, বিচার চাইবার ভাষা-শক্তি-সামর্থ্য-সুযোগ না থাকা নারীরা যে তিমিরে আছে সেই তিমিরেই থেকে যাবে। অর্থাৎ আদতে এই বিচার হবে আরো অসংখ্য বিচার না হওয়া ঘটনার উৎকৃষ্ট বিজ্ঞাপন। তাছাড়া এই বিচারের ফলে প্রকৃত প্রস্তাবে নারীর প্রতি পুরুষের মানসিকতার বিশেষ কোনো বদলই ঘটবে না।
তাই, ‘আল্লাহ-খোদার দোহাই লাগে’ অপরাধীকে ক্রসফায়ারে দেবেন না। তাকে বিচার-প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে শাস্তি নিশ্চিত করুন। তাহলে, আইনের প্রতি মানুষের আস্থা আসবে। নইলে, ফেসবুকে যা দেখছি, আইনের প্রতি আস্থা হারানো মানুষ প্রকাশ্যে বিচার দেখার নামে নিজেদের আস্থাহীনতার কথা জানান দিতেই থাকবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)