নিপীড়িতের লড়াই মূলত আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই। আধিপত্যের এক রূপ হলো ‘পুরুষতন্ত্র’। পুরুষ নয়, পুরুষতন্ত্র। সব পুরুষই পুরুষতান্ত্রিক নন। কখনও কখনও নারীরাও ‘পুরুষতান্ত্রিক’। কারণ, পুরুষতন্ত্র আধিপত্যেরই সমানুপাতিক।
আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন প্রচণ্ড পরাক্রমশালী একজন শিক্ষক ছিলেন। নারী। ক্ষমতার চর্চা এতোটাই করতেন যে, তার হুকুম ছাড়া মনে হতো গাছের পাতাও নড়ার জো ছিল না! আজ তার সেই ক্ষমতা আছে কি না খবর রাখি না। অতিকায় হস্তিদের ভুলে যেতেই তো বলা হয়েছে নীতিশিক্ষায়!
তো এই নারী শিক্ষকের মধ্যে যেটা কাজ করত সেটা হলো—প্রচণ্ড পুরুষতান্ত্রিকতা, আধিপত্যকামিতা; ক্ষমতার চর্চা ও ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতা।
২.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে লড়াই চলছে, সেটাও মূলত এই আধিপত্যের বিরুদ্ধেই লড়াই। দেখে ভালো লাগছে যে, সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনও সেই লড়াইয়ে সামিল হয়েছে। এটা ডাকসু কার্যকর থাকার প্রতিফলন কি না বোঝা যাচ্ছে না। কেননা, ডাকসু তো মূলত তাদেরই দখলে। ডাকসুর নেতারা মাঠে নামলে, তাদের কর্মীদের তো না নেমে কোন উপায় নেই!
কিন্তু, প্রশ্নটা হলো, এই লড়াইটাকে একটা প্রচণ্ড আধিপত্যবাদী সংগঠন ‘আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই’ হিসেবে দেখবে তো? তারা সেটা বুঝতে পারছে তো?
ছাত্রলীগ অন্তঃপ্রাণ এক মেধাবী ছোট ভাই একবার উদাহরণ হিসেবে বহুল-ব্যবহৃত সেই কথাটা বলেছিল, ‘ধর্ষকের থেকে মুক্ত হওয়ার উপায় যখন থাকে না, তখন ধর্ষণ উপভোগ করাই শ্রেয়’! ক্রোধ প্রশমন করে আমার ৫ মিনিটের কাউন্সিলিংয়ে সেই ছোট ভাই বুঝেছিল, ধর্ষণ কোন উপভোগের বিষয় নয়। এটি একটি নিকৃষ্টতম অপরাধ এবং এই অপরাধের বিরুদ্ধে কোন ‘যদি… কিন্তু…’ না করে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখাতে হবে।
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা, যারা আন্দোলন করছেন, তারা এই কথাটা বুঝতে পারছেন তো?
যদি না বুঝে থাকেন, তাহলে এই আন্দোলন সাংস্কৃতিকভাবে একদমই বৃথা। এটা হয়ে উঠবে শুধুই পলিটিক্যাল স্ট্যান্ডবাজি। শুধু আন্দোলন করলেই হবে না। আন্দোলন থেকে নৈতিক শিক্ষাও নিতে হয়। প্রশ্ন তৈরি করতে হয়, কেন করছি, কী করছি, কীভাবে করছি?
আমি তাদের শুভবোধোদয় কামনা করি। তাদের এই পুরুষতন্ত্র ও আধিপত্যবাদ বিরোধী লড়াই যেন এক আন্দোলনেই শেষ হয়ে না যায়, তারা যেন পদে পদে এর চর্চা করতে পারেন।
৩.
পরক্ষণেই একটু খটকা লেগে যায়, যা ভাবছি, তার গ্যারান্টি কী?
যেদিন আন্দোলন দানা বাঁধে, তার আগের দিন রাতে শাড়ি নিয়ে কী কাণ্ডটাই না ঘটালেন ঢাবির বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ওই ঘটনা মনে করলে, গ্যারান্টির নিজেরই তো কোন গ্যারান্টি দেখি না!
উপরে এ কারণেই ওই পুরুষতান্ত্রিক নারী শিক্ষকের কথা বলেছি। ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে ধরাসরা জ্ঞান করতেন না। বঙ্গমাতা হলের এই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দশাও তাই। ক্ষমতার দম্ভে রীতিমতো শিক্ষককে লাঞ্ছিত করে বসলেন তারা!
এখন, এই যে ক্ষমতা-দাম্ভিক মেয়েরা, তাদের ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভ কি শেষ পর্যন্ত আধিপত্যবাদবিরোধী, পুরুষতান্ত্রিকতাবিরোধী সংস্কৃতিতে কোন অবদান রাখতে পারবে? তাদের চর্চা, তাদের রাজনৈতিক স্কুলিং, তাদের মনন-গড়ন, শারীরিক ভাষা তো সেই কথা বলে না। সর্ষের মধ্যে ভূত রেখে ভূত তাড়ানো যায় না!
ছাত্রলীগের ওই মেয়েদের দ্বারা সেদিন লাঞ্ছিত হয়েছিলেন হলটির হাউস টিউটর ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীন আরা। ঠিক কী হয়েছিল সেদিন, চলুন শুনি তাঁর মুখেই:
“গত পরশুদিন রোববার (০৫ জানুয়ারি) রাতে হল থেকে আমাকে জানানো হয় হলে দুই পক্ষ মারামারি করছে। আমরা খবর পেয়ে গিয়ে দেখি দুপক্ষের একদফা মারামারি হেয়ে গেছে। তখন ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি আমাদের রুম থেকে বের করে দিলেন। বললেন আমরা মিটিং করে মীমাংসা করে নিবো। আমরা বাইরে দেখে বুঝতে পারছিলাম ছাত্রলীগের সঙ্গে যাদের মারামারি হয়েছে তাদের দুইটা মেয়েকে তারা মারবে। শিক্ষক হিসেবে তাদের সেভ করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা তখনই নিচে নামলাম, দেখি একটি মেয়েকে রুম থেকে মারতে মারতে বের করে নিয়ে আসছে। আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম। আমি তখন বললাম, তোমরা কেউ গায়ে হাত দিবানা, গায়ে হাত দিলে শাস্তি দিবো। তখন মেইনগেট বন্ধ করে দিয়ে মেয়েটিকে মারা শুরু করে, সে সময় আমাকেও চুল ধরে মাটিতে ফেলে দেয়। কয়েকজন মিলে আমাকে আক্রমণ করে। কেউ চুলে ধরে, কেউ আমাকে খামচি দেয়।”
ঘটনাটার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ছাত্রলীগ একজনকে ‘দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গে’র দায়ে বহিষ্কার করেছে। বাক্যাংশটা খেয়াল করবেন, ‘দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গে’র দায়ে। শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার দায়ে নয়।শিক্ষককে লাঞ্ছিত করাটা একটি ছাত্র সংগঠনের দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গ অবশ্যই। ধরে নেওয়া যেত, পরিষ্কারভাবে উল্লেখ না করলেও, বহিষ্কারেরকালে সংগঠনটি মানসিকভাবে শিক্ষক লাঞ্ছনাকেই দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু, যে মেয়েটিকে বহিষ্কার করা হয়েছে, বস্তুত তাকেই মার খাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়েছিলেন শিক্ষক ড. জোবায়াদা নাসরিন। আর তখনই তাকে লাঞ্ছিত করা হয়। অথচ, এই যে নিজেদের কর্মীবাহিনীর দ্বারা একজন শিক্ষক লাঞ্ছিত হলেন, সেজন্য ক্ষমা চেয়েও বিবৃতি দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেনি একটি ছাত্রসংগঠনটি! প্রবল পুরুষতান্ত্রিকতা বিরাজ না করলে, সাধারণত এ ধরনের ‘কাণ্ডজ্ঞানহীনতা’ বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে বিরলই বলতে হবে।
অন্যদিকে, না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ঘটনার কোন প্রতিবাদ জানিয়েছে, না শিক্ষক সমিতি কোন প্রতিবাদ জানিয়েছে, না হল প্রশাসন প্রতিবাদ জানিয়েছে। দায়িত্বশীলরা বলছেন, তদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষা করছেন তারা। সত্যই? শিক্ষার্থীরা এতো বড় অপরাধ করার পরও, হল প্রশাসন অপরাধীদের হল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করতে পারল না? উপাচার্য তার নিজের ওপর অর্পিত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারলেন না এ ঘটনায়? এমন ঘটনায় তো সিন্ডিকেট না ডেকেও উপাচার্য নিজস্ব ক্ষমতাবলে কোন শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করতে পারেন।সাধারণত, তদন্ত প্রতিবেদনের সাপেক্ষে পরবর্তী সময়ে চূড়ান্ত বিচার করে সিন্ডিকেট। তিনি তাও করলেন না!
তিনি ধর্ষণবিরোধিতায় উত্তাল ক্যাম্পাসে দায়িত্বশীল কোন ভূমিকা পালন করতে পারেন না, তিনি শিক্ষক লাঞ্ছিত হলে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থাগ্রহণ করতে পারেন না। কিন্তু, তিনি মন্ত্রী-সান্ত্রী নিয়ে ঠিকই ‘টিচার্স ক্রিকেটলীগ’ উদ্বোধন করতে পারেন!
এসব পক্ষপাতমূলক আচরণ শুধু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হয় না। নতুন করে আবারও প্রমাণিত হলো, শিক্ষকদের সঙ্গেও হয়, যদি তিনি ‘সহমত’ গোছের শিক্ষক না হন। উল্টো, ড. জোবায়দা নাসরীনকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, হল প্রশাসন ও শিক্ষক সমিতি বরাবর বিচার চেয়ে আবেদন করতে হয়েছে! তিনি যে বিবৃতি দিয়েছেন, তা তো আমরা দেখলামই। কিন্তু, খবরে প্রকাশ, ড. জোবাইদা নাসরিন যে ‘অপরাধে’ লাঞ্ছিত হয়েছেন, তা হলো, ‘ছাত্রলীগের সমালোচনা করে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি’ (দৈনিক প্রথম আলো)। ভাবুন কী অবস্থা, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক মান ও মানসিকতার! বিরুদ্ধ মত, রাজনৈতিক সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না, তাই শিক্ষকের গায়ে হাত তুলে বসলেন! এই হলো আমাদের এখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধচারণ করে যে প্রতিষ্ঠানটি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। সেসব সম্ভবত আজ মিথ হয়ে গেছে!
এজন্যই উপরে বলেছি, এদের দিয়ে আধিপত্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের সাংস্কৃতিক উন্নতি সম্ভব, সেই গ্যারান্টির নিজেরই কোন গ্যারান্টি দেখি না! নইলে, আক্রমণকারীরা একবারও ভাবলেন না, ড. জোবাইদা নাসরীন কে? নারীর ক্ষমতায়নের পক্ষে যিনি হামেশা সরব, যিনি একজন নারী-অধিকার অ্যাক্টিভিটিস্ট, যার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার একটা বড় অংশ জুড়ে নারীর উন্নয়ন, নারীর প্রতি বৈষম্য, নারী বিষয়ক যে কোন ইস্যুতে যিনি একদম ‘অর্গানিক ইন্টেলেকুচুয়ালে’র মতো শাণিত কলম ও কণ্ঠে মাঠে নেমে পড়েন, সেই তাকেই দল বেঁধে আক্রমণ করে বসলেন তারই শিক্ষার্থীরূপী কিছু নারী!
শিক্ষক হিসেবে নিশ্চয়ই এ এক বড় জ্বালা। কখনও কখনও এসব দুর্ঘটনা হীনমন্মতারও সৃষ্টি করে।অথচ, তিনি কিন্তু, তার কর্তব্যের থেকে পিছুপা হননি এতটুকুও। এই জ্বালার মধ্যেই তিনি চলমান ধর্ষণ-ইস্যু ও ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন নিয়ে নিজের মতামত দৈনিক সমকালকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন: “দুটি কারণে দেশে ধর্ষণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। প্রথমত, দেশে লিঙ্গীয় সমতার দিক দিয়ে নারীরা এগিয়ে চলেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। ব্যক্তিক অর্জন দিয়ে নারীর উন্নয়ন মাপা হচ্ছে। এতে নারী নিপীড়নের বিষয়গুলো আড়ালে থাকছে। এতে নিপীড়নকারীরা উৎসাহিত হচ্ছে। এ কারণে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে।
দ্বিতীয়ত, বিদ্যমান আইনি ব্যবস্থায় ধর্ষণের ঘটনাগুলো মীমাংসা হতে ১০ থেকে ১৫ বছর সময় লাগে। মামলা ও বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হলেও অধিকাংশ ঘটনারই কোনো শাস্তি হয় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে বছরের পর বছর সেই মামলা চলতে থাকায় নির্যাতিত পক্ষ এক সময় হাল ছেড়ে দেয়। ধর্ষণকারীরাও বুঝে গেছে, ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে কিছুদিন আলোচনা চলবে, তারপর সবাই সেটা ভুলেও যাবে। এ ধরনের আইনি ব্যবস্থাও ধর্ষণকারীদের সাহস জোগাচ্ছে।
ধর্ষণের ঘটনা রোধে নারীর অর্জনকে ব্যক্তিক অর্জন হিসেবে না দেখে অবস্থা বিবেচনার পাশাপাশি ঘর এবং বাইরে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টিতে জোর দিতে হবে। সেই সঙ্গে তাদের মতাদর্শকে প্রাধান্য দিতে হবে।
সাধারণত ঘটনা ঘটার পর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। কিন্তু কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটছে, সেটা বন্ধে কী করা যায় এখন সে বিষয়গুলো চিন্তা করা দরকার। ধর্ষণকারীর মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, সামাজিক রাজনীতি ছাড়া আর কোন কোন বিষয় কাজ করছে সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। শুধুমাত্র আইন নয়, আর কীভাবে ধর্ষণের ভয়াবহতা বন্ধ করা যায় সেদিকেও মনোযোগ দিতে হবে।”
এই যে তিনি দু’টি দিক চিহ্নিত করলেন ধর্ষণের, আমি তো মনে করি, এ দু’টি দিক খুব সহজেই এই আন্দোলনের স্টেকহোল্ডাররা ‘ঔউন’ করে নিতে পারেন। কথাগুলো এতো গভীর যে, এগুলো হতে পারে এ আন্দোলনের সলতেকে আরও প্রজ্জ্বলিত করার জ্বালানি।
একজন ড. জোবায়েদা নাসরীন এভাবে তার বুদ্ধিবৃত্তিক ও অ্যাক্টিভিস্ট সত্তার মাধ্যমে আন্দোলনকে ‘ফুয়েল’ দিতে পারেন। আর এই দেওয়ার চর্চাটা তিনি হঠাৎ শুরু করেননি। রাজনীতির ভাষায় যাকে বলে একদম ‘পাক্কা মাঠের কর্মী’, তিনি শিক্ষার্থী-জীবনে আদতে তা-ই ছিলেন। ড. জোবাইদা নাসরীন নামে যাকে আজ পুরো দেশ চেনে, আমরা তাকে চিনি ‘কণা দি’ নামে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২তম ব্যাচের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। এই ব্যাচের সুনাম আছে জিনিয়াসদের ব্যাচ হিসেবে, কণা দি সেই নক্ষত্রদেরই একজন!
তিনি জাবি ছাত্র ইউনিয়নের একজন নেতা ছিলেন। আরও বড় পরিচয় তার আছে। ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে খুনি ও ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন পুরো দেশের আলোচনার পুরোভাগে ছিল, তিনি ছিলেন সেই আন্দোলনের একজন প্রথম সারির সংগঠক। তারও আগে, যখন জাবিতে ছাত্রশিবিরকে শেষবারের মতো বিতারণ করা হয়েছিল, সেই আন্দোলনেরও সামনের সারিতে ছিলেন তিনি। আমরা যাঁরা অনেক পরে ক্যাম্পাসে আন্দোলনের কর্মী হয়েছি, তাদের কাছে ‘কণা দি’ নিছকই তাই বড় বোন নন, আমাদের একজন নেতা। সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখে যিনি অবলীলায় মিশে যেতে পারেন আমাদের মতো শিক্ষার্থীতুল্য ছোট ভাইবোনদের সঙ্গে।
এহেন ‘কণা দি’র লড়াই-সংগ্রামের অভিজ্ঞতা না জেনে, তাঁর লড়াকু মানসিকতার হদিস না করে, তাঁকে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে আক্রমণ করতে যাওয়ারা কূপমণ্ডুক ছাড়া আর কিছুই না!
ঢাবিতে যে ছাত্র আন্দোলন দানা বেঁধেছে, সে আন্দোলনের পক্ষে ড. জোবাইদা নাসরীন, আমাদের ‘কণা দি’, একজন খুবই শক্তিশালী মুখ তার ধর্ষকবিরোধী লড়াই-সংগ্রামের অভিজ্ঞতার কারণে। পত্রিকায় সাক্ষাতকার দেওয়ার মাধ্যমে ইতোমধ্যেই তিনি আন্দোলনের সুরে সুরারোপ করে ফেলেছেন। রাস্তায় নেমে মিছিল আর বক্তৃতা, এসব তাঁর রক্তমজ্জাতেই আছে।
আপনারা যারা কণা দি’র টুটি চেপে ধরে, পরের দিন ধর্ষণ বিরোধিতার মতো আধিপত্যবিরোধী বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন, তারা আপনাদের এই শিক্ষকটির কাছে আনত হয়ে কী করে প্রকৃত আধিপত্যবিরোধী ও পুরুষতান্ত্রিকতাবিরোধী হয়ে উঠতে হয়, তার পাঠ নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবেন বলে প্রত্যাশা করি।
৪.
শেষের আগে শেষকথা। ধর্ষণের অভিযোগে মজনু নামের একজনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আদৌতেই এ-ই ‘ধর্ষক’ কি না, তা নিয়ে নানা আলোচনা-বাদানুবাদ চলছে স্যোশাল মিডিয়ায়। কিন্তু, তাকে এখনই ‘ধর্ষক’ বলা সর্বক্ষেত্রেই আরেকটি ‘অপরাধ’। আদালতের রায় ছাড়া কোনভাবেই কাউকে প্রকৃতার্থে অপরাধী ঠাওর করে নেওয়ার ব্যধি আমাদের ত্যাগ করতে হবে। নইলে সেটাও যে, আদালত অবমাননাই হয়!
তাহলে, ‘ধর্ষক ধরা পড়েছে’ – এ তুষ্টির ঢেকুর গিলে কি চলমান আন্দোলন এখানেই থেমে যাবে? যদি যায়, তাহলে আরেকটি বিষয় প্রসঙ্গক্রমে একটু মনে করিয়ে দিতে চাই।
নিশ্চয়ই আমাদের এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, ঢাবিতে ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয় মূলত চা বিক্রেতা এক মামার ‘বিশেষভাবে সক্ষম’ মেয়েকে ধর্ষণের প্রতিবাদে। ৬ জানুয়ারি বিক্ষোভের যে ডাক দেওয়া হয়, তা ঘোষিত হয় ৫ জানুয়ারি বিকেলে। কিন্তু, পরিস্থিতি আরও উত্তাল হয়ে ওঠে ৫ জানুয়ারি রাতে, যখন খবর ছড়ায় রাজধানীর কুর্মিটোলায় ‘ঢাবি ছাত্রী ধর্ষিত’। ফলে, ইস্যু ‘ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ’ থাকলেও ‘সাবজেক্ট’ বদলে যায়।
সন্দেহ নেই ‘সাবজেক্ট’ বদলে যাওয়া কিংবা সচেতনভাবে বদলে দেওয়া এলিটিস্ট রাজনীতির একটা খেলা এবং এ খেলায় বাম-ডান-মধ্যম সবপক্ষই সমদোষে দায়ী। এখন আন্দোলনটাও যদি এখানেই থেমে যায়, তাহলে চা বিক্রেতা মামার মেয়ের ধর্ষণকারীর বিচার কী করে হবে? সেই ধর্ষণকারী একদম চিহ্নিত, কিন্তু জামিনে মুক্ত। এমন অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনা অহরহ ঘটছে, যেগুলোর বিচার তো দুরের কথা, অপরাধী সনাক্ত কিংবা ধৃত হয়নি। তনুর মতো আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর ঘটনার কোন সুরাহাই রাষ্ট্র আজও করতে পারেনি।
নিপীড়ককে যেমন শ্রেণিভেদে পার্থক্য করা যায় না। তেমনি, নিপীড়িতকেও শ্রেণিভেদে পার্থক্য করা যায় না। নিপীড়ক ধনী হলে বিচার হবে না, গরীব হলে হবে। নিপীড়িত এলিটিস্ট বা মিডিল ক্লাস শিক্ষিত হলে বিচার পাবেন, নিম্নবর্গ হলে পাবেন না, এমন শ্রেণিকরণ আধিপত্যবাদবিরোধী, পুরুষতান্ত্রিকতাবিরোধী লড়াইয়ের জন্য একটি প্রতিবন্ধক। এই প্রতিবন্ধকতা দুর হয়ে সকল নিপীড়ক সাজা পাক, সকল নিপীড়িত বিচার পাক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)