চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

দেশে দেশে নৃশংসতা: ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন’

পৃথিবী যেন সত্যিই এক কঠিন অসুখে আক্রান্ত। কবি জীবনানন্দ দাশ যাকে বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন’ ! চারদিকে কেবলই নৃশংসতা, হিংসা, রক্তপাত আর মানুষ হত্যার খবর। বাংলাদেশে হচ্ছে। ভারত-পাকিস্তানে হচ্ছে। তুরস্কে হচ্ছে, কাবুলে হচ্ছে, ইরাকে হচ্ছে। আফ্রিকায় হচ্ছে। আমেরিকায় হচ্ছে। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানিতে হচ্ছে। এমনকি জাপানেও হচ্ছে।

কতগুলো হচ্ছে ধর্মের নামে, জিহাদের নামে। কিছু হচ্ছে ক্ষমতা দখল আর ক্ষমতা রক্ষার নামে। আর কতগুলো হচ্ছে কার্যকারণহীন ভাবে, স্রেফ পৈশাচিক উন্মত্ততায় মানুষ খুনের উৎসব! বন্দুক দিয়ে, কুড়াল দিয়ে, বোমা-গ্রেনেড দিয়ে, ছুরি দিয়ে, এমনকি উৎসবে ট্রাক চালিয়ে দিয়ে মানুষ খুন করা হচ্ছে। যারা এই খুনের ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে -বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা নবীন বা যুব। তারা নিজেরাও আত্মঘাতী হচ্ছে!

আমরা জঙ্গিদের নিয়ে কত কথা বলি। ওরা বঞ্চিত, অপমানিত, ওদের মগজ ধোলাই করা হয়েছে, ওরা ধর্মব্যবসায়ীদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ওরা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর চক্রান্তের ফসল। আরও কত কী!

কিন্তু জার্মানিতে যে ছেলেটি অনেক যত্ন করে কিছু কিশোরকে ডেকে এনে গুলি করে হত্যা করল, তার ব্যাপারে কী বলব? আমরা কী ব্যাখ্যা দেব জাপানে যে নরপিশাচটি নির্বিচারে ছুরি চালিয়ে ১৯ জন প্রতিবন্ধিকে হত্যা করল এবং আরও প্রায় অর্ধশত ব্যক্তিকে মরণাপন্ন করল, তার আচরণের? আমেরিকায় প্রায় প্রতিদিন যারা বন্দুক হাতে ঠা-ঠা গুলি চালিয়ে পাখির মত মানুষ হত্যা করছে, তাদের আচরণেরই ব্যাখ্যা কী? কেন এমন হচ্ছে? কেন মানুষ মানুষকে এভাবে হত্যা করছে? এর ব্যাখ্যা কী?

জার্মানিতে যে ছেলেটি অন্তত ৯ জনের জীবন কেড়ে নিয়েছে তার নাম আলি ডেভিড সনবোলি। ইরানি বংশোদ্ভূত এই জার্মান কিশোরের পিঠে ছিল একটা লাল রঙা রুকস্যাক। ৩০০ রাউন্ড গুলির সঙ্গে তাতে ছিল একটা বইও। নাম ‘হোয়াই কিডস কিল: ইনসাইড দ্য মাইন্ডস অব স্কুল শ্যুটারস’। লেখক পিটার ল্যাঙ্গম্যানের এই বইটা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করেছিল ছেলেটা। গবেষণা করেছিল বিশ্বের নানা প্রান্তের নানা স্কুলে বন্দুকবাজদের হামলার ঘটনা নিয়েও। কারণ?

ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের গুলি করে খুন করার মতো নৃশংস ঘটনা ভীষণ ভাবে টানত তাকে! আর সম্ভবত সেই জন্যই ফেসবুকে এক মহিলার অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে নিখরচায় খাওয়া-দাওয়ার জন্য ওই দিন সে ম্যাকডোনাল্ড রেস্তোরাঁয় ডেকেছিল অল্প বয়সি ছেলে-মেয়েদের। টোপ দেওয়ার জন্য আবার লিখেছিল,‘‘আমি এমন কিছু দেব, যেটা তোমরা চাও।’’ গুলি করে সে নিজেও আত্মহত্যা করেছে। মিতভাষী, নাদুস-নুদুস আলি কী করে শপিং মলে গিয়ে এতগুলো লোককে মেরে ফেলল, তা ভাবতে পারছেন না কেউ-ই।

কেন মানুষ এত হিংস্র হয়ে ওঠে। কেন ‘মান’ আর ‘হুঁশ’ হারিয়ে মানুষগুলো অমানুষ হয়ে যায়? কেন এই নিষ্ঠুরতা?

মানুষের এই অমানবিক আচরণগুলো মূলত তার পাশবিক প্রবৃত্তি। মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে এই ধরনের আচরণের পেছনে রয়েছে মানুষের অবদমিত কামনা-বাসনা, যাকে তিনি তুলনা করেছেন অবচেতন মনের খিড়কি খুলে দেওয়ার সঙ্গে। অবচেতনে মানুষ যা কামনা করে, চেতন মনে সে তার শিক্ষা, সভ্যতা, সামাজিকতা আর নৈতিকতা দিয়ে সেগুলো ঢেকে রাখে। সেই অবদমিত কামনা -সরাসরি পূরণ হয় না বলে হিংস্রতা আর নৃশংসতার মধ্য দিয়ে ঘুরপথে পূরণ করার চেষ্টা চলে। কখনো এই হিংস্রতা সে একাই প্রকাশ করে আবার কখনো প্রকাশ করে যূথবদ্ধভাবে। এই যূথবদ্ধ হিংস্রতার প্রকাশ -‘মবসাইকোলজি’ বা ‘ক্রাউড সাইকোলজির’ব্যাখ্যা দিয়েছেন ফরাসি সমাজ-মনোবিজ্ঞানী গুস্তাভলি বন। তিনি বলেন, এই অবদমিত কামনার প্রকাশ কখনো কখনো ছোঁয়াচে হয়ে যায় এবং দলবদ্ধভাবে নৃশংসতাকে প্রকাশ করে।

ইংরেজরা ১৪৩১ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি বীরকন্যা জোয়ান অব আর্ককে অপবাদ দিয়ে আগুনে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করেছিল। আজকের সভ্য মার্কিন মুলুকের মিসিসিপি, জর্জিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে ১৮৮০ সাল থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে প্রায় ২ হাজার ৪০০ মানুষকে কেবল জাতিগত বিরোধের জেরে মিথ্যা বা তুচ্ছ অভিযোগে বিনা বিচারে বা প্রহসনের বিচারে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।

১৯৭১-এ মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনা আর তাদের এদেশীয় দোসরদের কলঙ্কজনক নৃশংসতা দেখেছে এই বাংলাদেশ। এরপর ১৯৭৫, মধ্য আগস্টের কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয় নিদারুণ হিংস্রতার ছোবলে। জগৎ জুড়ে নৃশংসতা ও নির্মমতার প্রদর্শনী চলছেই। দিন দিন তা যেন আরও বাড়ছে।

মানুষের মধ্যে এই হিংস্রতার ব্যাখা বিজ্ঞান দিয়েছে এভাবে যে একজন হতাশ মানুষ নিজের হতাশাকে কাটাতে, নিজের অপ্রাপ্তিবোধের তাড়না থেকে নিজের চাইতে দুর্বল কাউকে বেছে নেয়। আর সেই দুর্বলের ওপর হিংস্রতা দেখিয়ে একধরনের মানসিক পরিপূর্ণতা পেতে চায়। এই তত্ত্বকে বলা হয় ‘ফ্রাস্ট্রেশন-অ্যাগ্রেসনহাইপোথিসিস’। এ কারণেই আমরা দেখি দুর্বল রাজন ও নারায়ণগঞ্জের ছোট্ট শিশুটির ওপর পাশবিক নির্যাতন ও হিংস্রতা।

জার্মান মনস্তত্ত্ববিদ এরিক ফ্রম তাঁর দ্য অ্যানাটমি অব হিউম্যান ডেস্ট্রাকটিভনেস বইতে নানা মাত্রায় মানুষের হিংস্র আচরণের কথা লিখেছেন। প্রাগৈতিহাসিক যুগের গুহামানব সম্পর্কে তিনি বলেন, সে সময় মানুষ ন্যূনতম হিংস্রতার প্রকাশ ঘটিয়ে সবচেয়ে বেশি সম্পদ ভাগ করে নিত। একজন একটি পশু শিকার করলে গোত্রের সবাই মিলে তা ভাগ করে নিত। তিনি বলেন, সহিংসতা মানুষের স্বভাবজাত কিন্তু সে সময় তা ছিল কেবল প্রতিরক্ষামূলক এবং নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে। পরবর্তী সময়ে শ্রেণিধারণা, ভূরাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক কারণে মানুষ পরিবেশ আর প্রতিবেশের প্রভাবে অহিতকর মারাত্মক সহিংসতার চর্চা শুরু করে, যাকে তিনি বলেন ‘ম্যালিগন্যান্ট অ্যাগ্রেসন’। অর্থাৎ জন্মগত পাশবিক প্রবৃত্তিগুলো পারিপার্শ্বিকতার কারণে ফুটে বেরোয়।

অনেক সমাজবিজ্ঞানী ও মনস্তত্ববিদ বলছেন, এই সমস্যার বীজ নিহিত আছে এ যুগের ছিন্নমূল সামাজিক বা পারিবারিক কাঠামোতে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক বন্ধনগুলো কেমন আলগা হয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রনির্ভর ভোগবাদী সংস্কৃতি মানুষকে মানবিক বানাতে পারছে না। সমাজের একটা বড় অংশের শেকড়গুলো ছিড়ে গেছে, তারা শেকড়হীন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই ছিন্নমূলতা কিন্তু প্রধানত এথিক্যাল -যার ফলে যেগুলোকে আমরা ভয়ানক অপরাধ বলে মনে করি, সেগুলো তাদের কাছে ততটা ভয়ানক বলে মনে হচ্ছে না। তাদের এথিক্যাল বা নৈতিক চেতনাগুলোই আসলে ভোঁতা হয়ে গেছে। আধুনিকতার এই উপসর্গ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আসলে এখন প্রতিদিন এমন সব নৃশংস ঘটনা ঘটছে, যা কোনো রকম কার্যকারণ বা ব্যাখ্যার অতীত!

একবিংশ শতাব্দীতে সন্ত্রাসবাদ সারা বিশ্বে তার ছায়া ফেলেছে৷ যদিও বলা বাহুল্য যে অঞ্চলভেদে সন্ত্রাসবাদের প্রকৃতি ও কারণ ভিন্ন। এসব নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হওয়া দরকার। যে সন্ত্রাসবাদ আর সহিংসতা গোটা দুনিয়াকে নরক বানিয়ে ফেলছে, তার কারণ উদঘাটন করা দরকার। যে গুটিকয় মানুষ নামধারীর জন্য সারা দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় দিন পার করছে, তার নিদান তো মানুষকেই বের করতে হবে।

কবি জীবনানন্দ দাশ ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন’ বলে বিলাপ করে তবুও পৃথিবীর কাছেই মানুষের ঋণ বলে মেনেছেন। পৃথিবী থেকে তো মানুষ এখন বেরিয়ে যেতে পারবে না। আমাদের গভীর অসুখটা কোথায়, তা আমাদের জানতে হবে। নিরাময়ের পথ দেখে ‘এই পথে আলো জ্বেলে’ এগোতে হবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)