১২ এপ্রিল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হচ্ছে দেশের সব সিনেমা হল। সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে ডেকে এমন ঘোষণাই দিয়েছিলেন হল মালিক সমিতির সংগঠন ‘প্রদর্শক সমিতি’র নেতারা।
দেশের সিনেমা হল টিকিয়ে রাখার জন্য পর্যাপ্ত কনটেন্ট (সিনেমা) নেই। দীর্ঘদিন ধরে লোকসান গুনতে গুনতে হলের মালিকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। সিনেমা হলগুলোকে বাঁচানোর কিংবা দেশের ছবির উৎপাদন বাড়ানোর এবং উপমহাদেশের ছবি আমদানির বাঁধা-নিষেধ অপসারণে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না পাওয়ায় দেশের হল বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত প্রদর্শক সমিতির নেতাদের।
তাদের এমন সিদ্ধান্ত চলচ্চিত্র অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এমন সিদ্ধান্তকে অনেকে সাধুবাদ জানালেও কড়া সমালোচনা করেছেন অভিনেতা অভিনেত্রীসহ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কেউ কেউ। চ্যানেল আই অনলাইন জানতে চেষ্টা করেছে, প্রদর্শক সমিতির এমন সিদ্ধান্তকে কীভাবে দেখছে পরিচালক সমিতি।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজারের সঙ্গে। শুক্রবার দুপুরে চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, হল মালিক সমিতি যদি সিদ্ধান্ত নিয়েই থাকে যে হল বন্ধ করে দিবে, তাহলে দিক। এ বিষয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। এতে আমাদের চলচ্চিত্রের কোনো ক্ষতি হবে বলে আমি মনে করছি না। কয়েকজন আছে শুধু ভারতীয় ছবি আমদানি করার পাঁয়তারায় থাকে, তারাই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকার যেনো একটু নমনীয় হয় এজন্য এরকম করছে, এছাড়া অন্যকিছু নয়। বেশ কয়েকজন হল মালিকদের সাথে আমরা কথা বলেছি, তারা সংগঠণের এমন সিদ্ধান্ত মেনে তাদের হল বন্ধ করার পক্ষে নয় বলে আমাদের জানিয়েছে।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, গতবারও এরা এমন আবদার করেছিলো, তারআগেও এমন সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলো।
হল মালিকদের দাবী, ভালো কন্টেন্ট নেই। এ কারণে ভারতীয় ছবি আমদানির কথা বলছেন তারা। এ বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে গুলজার বলেন, ভালো কন্টেন্ট আমরা দেই না? আমরা মনপুরা, আয়নাবাজি, ঢাকা অ্যাটাক-এর মতো সুপার হিট ছবি দেইনি? এগুলোর টাকা দেয় না কেন হল মালিকরা? টাকা ফেরত না দিলে ভালো কন্টেন্ট তৈরী হবে কীভাবে? যে প্রডিউসার মনপুরা, আয়নাবাজি, ঢাকা অ্যাটাক কিংবা এরকম আরো বেশকিছু হিট ছবি নির্মাণে অর্থ লগ্নি করলো, তারা কি হলের টাকাটা বুঝে পাইছে? কেউ পায়নি। আর পায়নি দেখেই ভালো কন্টেন্ট নির্মাণ করেও পরবর্তীতে তারা আর সিনেমাতে লগ্নি করতে আসেনি। এতে সার্বিক ভাবে ক্ষতি হয়েছে আমাদের ইন্ডাস্ট্রির।
তিনি বলেন, মনপুরা সারা বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে। আয়নাবাজি, ঢাকা অ্যাটাক-সারা দেশে তোলপাড় ফেলেছিলো। প্রত্যেকটা হলে সুপার হিট হয়েছে। কিন্তু সেইসব ছবির প্রডিউসাররা কেন পরবর্তীতে আর সিনেমা নির্মাণে আসেননি? কারণ হল থেকে টাকা তারা পায়নি। অনেক প্রডিউসার আমাদের কাছে বলেছেন, হল মালিকদের কাছে কেউ ৮০ লাখ, কেউ কোটি টাকার মতো পায়, এগুলো বাকি পরে আছে। সব হিসেবের টাকা। আর হিসেবের বাইরেতো আছেই, তার ঠিক ঠিকানা নাই। হল মালিকরা কোনো টাকা দেয় না, সব নিজেরায় খেয়ে ফেলে।
ভালো ও নিয়মিত প্রডিউসাররা এই ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে যাওয়া ও সিনেমায় ইনভেস্ট না করার অন্যতম কারণ হল মালিকরা। এমনটা ইঙ্গিত দিয়ে পরিচালক সমিতির সভাপতি বলেন, একটা সিনেমা মুক্তি দিতে গেলে হল মালিকদের পদে পদে টাকা দিতে হয়। অথচ সিনেমা হিট হলে কোনো টাকার হিসেব দেয় না, সব গিলে ফেলে। উল্টো অমুক জায়গায় টাকা, তমুক জায়গায় টাকা দিতে হয় প্রডিউসারকেই। আর এভাবে ভর্তুকি দিতে দিতে প্রডিউসাররা ইন্ডাস্ট্রি থেকেই বিদায় হয়ে গেছে। ফলে এখন ভালো ছবিও হচ্ছে না। ভালো কন্টেন্ট যে নাই, এটা কেন নাই? এর উত্তরতো হল মালিকরাই ভালো দিতে পারবে।
তার মানে সিনেমা হল মালিকদের জন্যই প্রডিউসাররা সিনেমায় ইনভেস্ট ছেড়ে দিচ্ছে? প্রশ্নে গুলজার বলেন, অবশ্যই। হল মালিকরাতো প্রডিউসারদের কোনো টাকায়-ই দেয় না। মেশিন ভাড়া কেন প্রডিউসার দিবে? বুকিং করে হল মালিকরা, কিন্তু সেটার কমিশনের টাকা কেন প্রডিউসার দিবে? হলের ব্যানার, পোস্টার, সেটা দেয়ালে দেয়ালে সাঁটানোর টাকা দিবে প্রডিউসার, হলে রিপ্রেজেন্টর রাখতে সেখানে টাকা দিতে হচ্ছে প্রডিউসারকে! সব জায়গায় টাকা দিতে হচ্ছে প্রডিউসারকে, তাহলে হলের দরকার কী! দিনে দিনে হলের অবস্থা গুদাম ঘরে পরিণত হয়েছে। এতো অর্থ লগ্নি করে সেখান থেকে প্রডিউসাররা কী পাচ্ছে?
হল মালিকদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পুরনো। তবে ডিরেক্টর, প্রডিউসার বা সংশ্লিষ্টরা কেন তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করছে না? এমন প্রশ্নে গুলজার বলেন, আর চাপ প্রয়োগের দরকার নেই। ওইসব সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাক। বিভিন্ন সময়ে বহুবার হল মালিকদের বলা হয়েছে তাদের সিনেমা হলের পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে। কিন্তু তারা কোনো সুষ্ঠু সমাধান নেয়নি, আগ্রহও বোধ করেনি। এখন আমরাও বিকল্প ব্যবস্থায় সিনেমা দেখানোর কথা ভাবছি। শিল্পকলা একাডেমির সাথে কথা বলেছি, সরকারি ভাবে জেলাগুলোতে সিনেপ্লেক্স হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা শিল্পকলার অডিটোরিয়ামকে মিনি সিনেমা হলে রূপান্তর করে আমাদের সিনেমা চালাবো।
সিনেমা হলের দর্শক শিল্পকলাতে স্বস্তি পাবে? এমন প্রশ্নেরও উত্তর দিলেন পরিচালক সমিতির এই নেতা। বললেন, এখন বিকল্প ব্যবস্থায় সিনেমা প্রদর্শনীর মাধ্যমেও টাকা উঠে আসছে, দর্শক বিকল্প ব্যবস্থায় ছবি দেখছে। এমন নজির আছে আমাদের। এছাড়া মান্ধাতা আমলের সিনেমা হলে এখন কেউ যেতেও চায় না। কোনো পরিবেশ নাই হলের ভেতরের, বাইরের। বাথরুমের পরিবেশ নাই, একটা ভালো ওয়াশরুম পর্যন্ত নাই। কয়েক যুগ আগে হয়তো দাদা একটা সিনেমা হল তৈরী করেছিলো, সেটার কোনো পরিবর্তন করেনি। মানুষের রুচি পাল্টে গেছে, প্রযুক্তির ছোঁয়া চারদিকে, অথচ একটা হলেও প্রজেকশান ব্যবস্থা ভালো নেই, সাউন্ড ব্যবস্থা ভালো নেই। এসব হলে কেন দর্শক যাবে?
তবে কথায় কথায় গুলজার এও স্বীকার করলেন যে, কখনো কখনো বাধ্য হয়ে মানুষ সেই মান্ধাতা আমলের হলগুলোতেও যায়। বিশেষ করে যে সব সিনেমার খুব প্রচার হয়, যেমন ‘দেবী’ সিনেমা। খুব বেশি প্রচার হওয়াতে সব ধরনের হলেই মানুষ ভিড় করেছে। কষ্ট করে, সব সহ্য করে সিনেমাটা দর্শক দেখেছে। কিন্তু এটা কি সব সময় যাবে? সব সময় সব ধরনের ছবি কেন মানুষ নোংরা পরিবেশের মধ্যে গিয়ে দেখতে চাইবে?