বাংলাদেশের লোনা পানির মাছের একমাত্র উৎস হল বঙ্গোপসাগর। দেশের সামুদ্রিক জলসীমার পরিমাণ ১,১৮,৮১৩ বর্গ কিলোমিটার এবং উপকূলীয় অঞ্চলের বিস্তৃতি ৭১০ কিলোমিটার। মৎস্য ও প্রানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী দেশের এই জলসীমায় প্রাপ্ত মৎস্য প্রজাতির মোট সংখ্যা ৪৭৫টি। তবে এই তথ্যটি বেশ পুরানো। দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন উপকূলীয় অঞ্চলে সম্পূর্ণভাবে কোন অনুসন্ধান না হওয়াতে সামুদ্রিক মাছের সংখ্যা অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে যতই দিন যাচ্ছে মৎস্য প্রজাতির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে এমন কিছু মাছ জেলেদের জালে ধরা পড়ছে যা পূর্বে কখনোই দেখা যায়নি। এমনই দুটি মাছ পাওয়া গেছে ভোলাসহ সুন্দরবনের জলসীমায়।
ক্যালিওনিমাস বর্গের অন্তর্ভুক্ত মাছ দু’টি ড্রাগনেট নামে পরিচিত। যদিও সারা বিশ্বের গবেষকরা এখন পর্যন্ত ১৮২ প্রজাতির ড্রাগনেট মাছ সনাক্ত করতে পেরেছেন, তবে সমষ্টিগতভাবে তাদের সংখ্যা খুব কম এবং সচরাচর দেখা যায় না। অধিকাংশ ড্রাগনেট মূলত সামুদ্রিক, তবে কিছু সংখ্যক মোহনা এবং স্বাদু পানিতেও পাওয়া যায়। ড্রাগনেট মাছ গভীর সমুদ্রে (১৩০ থেকে ১৩৫ মিটার) বেশি পাওয়া যায়, কিন্তু বাংলাদেশে অনেক কম গভীরতায় পাওয়া গেছে। সম্ভবত খাদ্য গ্রহণ বা প্রজননের জন্য তারা কম গভীরতায় আসতে পারে।
কানকোর পার্শ্বীয় কাঁটা ড্রাগনেট মাছ সনাক্ত করণের মূল বৈশিষ্ট্য। এ মাছের আরেকটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হল যে, এদের ফুলকা উন্মুক্ত হওয়ার ছিদ্র কানকোর নিচের দিকে না হয়ে পৃষ্ঠদেশে হয়ে থাকে।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি ও জেনেটিক্স বিভাগ থেকে মাস্টার্স করা ছাত্র মোঃ আবু হানিফ ড্রাগনেট মাছ দুটি সনাক্ত করেছেন, সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডক্টর মুহাম্মাদ এ বি সিদ্দিক। তারা দীর্ঘদিন যাবত উপকূলীয় মৎস্য প্রজাতির উপর বিভিন্ন গবেষণা করে আসছেন। যদিও তারা মাছ দুটি সনাক্ত করেছেন ২০১৮ সালের জুলাই মাসে, তবে গবেষণা প্রবন্ধ লেখা ও প্রকাশ করতে প্রায় দুই বছর সময় লেগেছে।
তাদের এই গবেষণা প্রবন্ধটি স্বনামধন্য প্রকাশক এলসিভিআর ((Elsevier) একটি আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘রিজিওনাল স্টাডিজ ইন মেরিন সায়েন্স’ এ প্রকাশ করেছে। মাছ দুটির একটি (Callionymus carebares) এর আগে এডেন উপসাগর, ওমান উপসাগর, পারস্য উপসাগর, মানার উপসাগর এবং আন্দামান সাগরে দেখা গেলেও অন্যটি (Callionymus profundus) কেবলমাত্র লোহিত সাগরের আকাবা উপসাগরে (ইসরাইলি জলসীমায়) দেখা গেছে।
এর আগেও বাংলাদেশে নতুন তিনটি মাছের উপর তাদের নথি প্রকাশ হয়েছে এবং বর্তমানে আরও কয়েকটি প্রকাশনা ভিন্ন ভিন্ন জার্নালে প্রকাশের জন্য জমা দেওয়া আছে, যা খুব শিগগিরই প্রকাশ পাবে বলে জানান। এছাড়াও কয়েকটি প্রজাতির মাছ ইতিমধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে, যা বাংলাদেশে আগে দেখা যায়নি।
অন্যান্য সনাক্তকৃত মাছের মধ্যে রয়েছে গারফিস, স্ক্যাড, ম্যাকেরেল, গারনার্ড, স্নাপার, অরব্ ফিস, কার্ডিনাল ফিস, ল্যান্টার্ণবেলি, গ্রুপার, পনিফিস, ব্রাস্সি চুব, ব্লু-ফিস, স্করপিয়ন ফিস ইত্যাদি। এদের মধ্যে ব্লু-ফিস সারা বিশ্বে বিপন্নের পথে।
উপকূলীয় অঞ্চলে ড্রাগনেট মাছের আগমনের কারণ জানতে চাইলে আবু হানিফ বলেন, মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই নতুন নতুন মাছ দেখা যাচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলে।
ডক্টর এ বি সিদ্দিক সিদ্দিক ও আবু হানিফ ধারণা করছেন, সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষা করা হলে দেশের লোনা পানির মাছের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে যাবে। তবে সেজন্য প্রয়োজন প্রযুক্তি নির্ভর গবেষণা ও অর্থায়ন।
একদিকে দেশের স্বাদু পানির অনেক মাছ বিভিন্ন কারনে যেমন বিপন্নের পথে, অন্যদিকে লোনা পানিতে দেখা মিলছে নতুন প্রজাতির মাছ। তাই উপকূলীয় অঞ্চলের সঠিক বাবস্থাপনা যেমন অনেক প্রজাতির মাছকে বিপন্নের হাত থেকে রক্ষা করবে তেমনি মৎস্য খাতকে সমৃদ্ধ করে জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদানকে এগিয়ে নিতে পারবে বলে তাদের ধারণা।