ফেসবুক এসে ভালোই হলো; রূপকথার স্বচ্ছতোয়া পানিতে সন্তরণ শেষে থকথকে কাদায় নামাও হলো। ফেসবুকে এসেই প্রথম জানতে পারলাম আমি মুসলমান আর আমার বন্ধু তাপস হিন্দু। আরো জানা হলো আমি আর আমার বন্ধু সুপ্রিয় র্রলডক্লিফের নিষ্ঠুর কালোরেখার দু’পাশের প্রতিপক্ষ। অবশ্য তাতে আমার, তাপসের বা সুপ্রিয়র কিছু এসে যায় না। কিন্তু এই যে একটা সামান্য ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে ক্যাচাল; একটা মিউজিক্যাল কনসার্ট নিয়ে বুকের অলিন্দ-নিলয়গুলো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলা; একটা মানসিক দাঙ্গার পরিপার্শ্ব; তাতে খুবই বিবমিষা জাগে।
রাষ্ট্র ভারত ও রাষ্ট্র বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত আর মানুষ ভারত ও মানুষ বাংলাদেশের সম্পর্ক কেন আলাদাভাবে মূল্যায়িত হবে না! খুব সাধারণ জিজ্ঞাসা এটি। বা বাংলাদেশ ও ভারতের কিছু সংখ্যক দাঙ্গাবাজ লেঠেল কেন উভয় দেশের মানব সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল হবে! বাংলাদেশের মানুষ ভারতীয় শিল্পীর গান শুনে মুগ্ধ হয়; ভারতের মানুষ বাংলাদেশের শিল্পীর গান শুনে মুগ্ধ হয়। বাংলাদেশের পাঠক ভারতের লেখকের লেখা পড়ে শিহরিত হয়।
ভারতের পাঠকও একই রকম শিহরিত হয় বাংলাদেশের লেখকের লেখা পড়ে। এই যে সংগীত-শিল্প-সাহিত্য; এর ভূগোলে কোন কাঁটাতারের বেড়া থাকে না। আর মানুষের মন কিংবা ভালোবাসার ভূগোল তো জন লেননের গাওয়া “ইমাজিন দেয়ার ইজ নো হেভেন;” কারণ মনের স্বর্গ তো ধরিত্রীতেই। সুতরাং কেন ক’দিন পরে পরেই এমন ভার্চুয়াল নোয়াখালীর দাঙ্গা বনাম কলকাতার দাঙ্গা। এগুলো করে কতদূর যাওয়া যায় সেতো আমরা ১৯৪৭ সাল থেকে আজ অবধি দেখছি। ভারত সরকারের কোন বৈদেশিক নীতি অপছন্দ হলে বাংলাদেশের নাগরিকের উচিত তা নিজের সরকারের সামনে তুলে ধরা।
ভারতের নাগরিকদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই। রাষ্ট্রিক নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ভ্রান্তির জন্য রাম-রহিম কেন ফেসবুকে একজন আরেকজনের মাথা ফাটিয়ে দিতে উদ্যত হবে। এতো হিংস্রতার ক্ষুধা কেন! আর কত পরস্পরের মৃতদেহ খাওয়ার বিকৃত বাসনা লালন।
কোন একটি ছোট সমস্যা তৈরী হলে কিছু পচা মুসলমান আর কিছু পচা হিন্দু থকথকে কাদায় নেমে উস্কানির কাদা ছুড়তে থাকে। আরিচা ঘাট কিংবা শেয়ালদহ রেলস্টেশনের চুলকানির মলম বিক্রেতার মতো জমিয়ে রগড় করতে নেমে যাওয়া কুবুদ্ধির খই ভূমিবাস্তবতায় দেখার সুযোগ হয়নি।
ফেসবুকের আয়নায় এই কাদা থকথকে ঘৃণা সমাজকে দেখে বিস্মিত হই; মানুষের ভেতরটা এতোটা কুতসিত হয় কীভাবে!
বাংলাদেশ-ভারতের সামষ্টিক সমাজ কিন্তু মোটেই এমন নয়। তবে তাদের সরলতাবশতঃ গুজব ও হেইটস্পিচ শুনে চকিতে তেতে ওঠার একটা বোকামী রয়েছে। এই বোকামীটির যথাযথ ব্যবহার করেছিলো বৃটিশ শাসকেরা। তারা এরকম ছোট ছোট ঘটনায় কিছু পালতো নেটিভ হিন্দু-মুসলমান সারমেয় মাঠে নামিয়ে দিতো একই বৃন্তে দুটি ফুল হিন্দু-মুসলমান সমাজের যৌথ স্বপ্নগুলোকে পুড়িয়ে দিতে। এভাবে কত স্বপ্ন পুড়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
আজ এতো বছর পর; এতো ঠেকে, এতো দেখে, এতো শিখেও কী আমরা সেই ঘৃণা ব্যবসায়ীদের প্রেতায়িত সারমেয়দের কামড় খেয়ে জলাতংক বাধাবো। মানুষকে দূরে ঠেলে দেয়া সহজ; কাছে টেনে নেয়া কঠিন। আজকাল সেটা আরো কঠিনতর হয়ে উঠছে। খুব সম্ভব এখন এইসব কাদা থকথকে ঘৃণার মলম বিক্রেতাদের যাবতীয় উস্কানি উপেক্ষা করে “মানুষ”কে কাছে টেনে নেবার সময় এসেছে। আমরা কী আকাশের ঠিকানায় অবিভাজিত বাংলাভাষী সমাজে সে চেষ্টাটা আরেকবার করে দেখতে পারি না! ব্যর্থ হলেও দুঃখ থাকবে না; অন্ততঃ এতোটুকু সান্ত্বনা থাকবে; আমরা চেষ্টা করেছিলাম “আমরা” হতে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)